চতুর্থ বর্ষ-দ্বিতীয় সংখ্যা-কবিতা
কেন হে মৃত্যু, কেন হে জীবন
ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্ধকারে
মৌনতাটি বাড়ে
খসে পড়ে মৃতের মুকুট
রাস্তায় পেরিয়ে যায় পণ্যবাহী উট
কে বাজায় স্তব্ধতার এ নীল গ্রামাফোন
অপার্থিব মায়ার কাহন
মৌনতাটি বাড়ে
অন্ধকারে
দিন যায়
হাওয়ার পর্দায়
প্রেরণাদিবস কবে আসে
আশঙ্কা পোষা জন্তুর মত পাশে
বসে থাকে, সমাধি-কাব্য এই দু’হাতে নিথর
পুড়ে খাক প্রিয়তম ঘর
হাওয়ার পর্দায়
দিন যায়
মেঘজল
আছে অবিচল
ঢেউ ভাঙে মননে, শয্যায়
জোনাকির জন্মনাম ডেকে যায়
ধারালো ছুরি যেন, গান্ধর্ব উপকথাময়, স্থির
বলো কতদূরে নদীতীর
আছে অবিচল
মেঘজল
বাহুডোর
অঙ্গে লাগে ঘোর
নক্ষত্রেরা একলা শাম্পানে
মৌরিগন্ধ ভরা ফুল ছিঁড়ে আনে
গ্রীকযুবা হেঁটে আসে, দু’চোখময় খুন
জঙ্গলে চাঁদের উনুন
অঙ্গে লাগে ঘোর
বাহুডোর
স্বপ্নযান
বিদেশী বাগান
চেনা কণ্ঠস্বর কাঁপা
মৃত্যু কী ফুটে থাকা দোলনচাঁপা
বলেছিল সে ফুলে সাজাব আজ কবরীবাহার
খুচরো পয়সায় ছারখার
বিদেশী বাগান
স্বপ্নযান
অন্তরালে
রেখেছি আড়ালে
স্মৃতি হয়ে যাওয়া পাথি
আমারও কি যেন ছিল বলবার বাকি
জ্যোৎস্নায় শুধু ওড়ে কোনও মায়াবী বিড়াল
সে হাত ধরিনি কতকাল
রেখেছি আড়ালে
অন্তরালে
স্নেহবীজ
মোহের ট্র্যাপিজ
উঁচুনিচু বিদ্যুতে মোড়া
নিভে আসে চুল্লির উচ্চকিত সোরা
কারা যেন রাত্রিকে বধূবেশে চুয়াচন্দনে
সাজিয়েছে স্পৃহার আবরণে
মোহের ট্র্যাপিজ
স্নেহবীজ
সিসিফাস
শিকারী বাতাস
ফোটোগ্রাফে ম্লান বাদামগালিচা
সে শরীর তোমাকে ধার দেওয়া মিছা
পাহাড়ি ভালুক তীক্ষ্ণ আঁচড়ায় যৌনতার নখে
মৌবন জ্বলে ওঠে — চোখে
শিকারী বাতাস
সিসিফাস
সীমাহীন
সোনালি হরিণ
দীপ্যমান অথচ ফ্যাকাশে
তারাদের প্রথাগত রাত যেন আসে
ডুবেছে আদিম এই জাহাজের ক্ষীণ মাস্তুল
রিপু জানে অভ্যাসের ভুল
সোনালি হরিণ
সীমাহীন
বীতশোক
আবেগী মড়ক
জ্বলন্ত নীলরঙ কার
প্রেম যেন এক এঁটো শবাধার
সরোদ কাঁধে হাঁটে বুঝি প্রেতকায় ছায়া
অরণ্যে একাকী বেহায়া
আবেগী মড়ক
বীতশোক
বহুদিন
বৃষ্টিস্পর্শহীন
জেগে ওঠে ভুতুড়ে প্রলাপ
বাতিঘর থেকে দিয়েছিল লাফ
সমুদ্রশিবিরে কারা, নেমে এলো পরস্পর
ভাঙা লঞ্চে মেঘের কবর
বৃষ্টিস্পর্শহীন
বহুদিন
শেষ ট্রেন
বিষাদ অহিফেন
কোন্ হাওয়া উতলা শনশন
কেন হে মৃত্যু, বলো, কেন হে জীবন
আয়না ভেঙে পড়ে থাকে খরস্রোতা মোম
নিভৃত আলো, প্রেমিকা নরম
বিষাদ অহিফেন
শেষ ট্রেন
নেই
সেলিম মণ্ডল
নে ই!
গাছ নেই
ছায়া নেই
জল নেই
বৃষ্টি নেই
এত নেই-এর পরও চলে যাচ্ছিল দিন
কারণ আকাশ আছে
তুমি নেই
এই শূন্যতার ভিতর যেভাবে—
বৃষ্টি হল, জল পড়ল, গাছ ভাঙল, ছায়া সরলো
তাতে আরেকটু বৃদ্ধ হলাম
আরেকটু বাবা হলাম
পুরোপুরি বাবা হারালাম
ভিড়
রঙ্গীত মিত্র
আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশ্বাসঘাতকতা
টুকরো টুকরো হওয়া চিৎকার।
ঘাসের গায়ে হাওয়া লাগার মতো
গাড়ির তেল থেকে
শহর চলে যায়।
নিজের পরিচিত মুখ
মানুষ হারিয়ে যায় ভিড়ের ভিতরে।
বামপন্থা
রঙ্গীত মিত্র
আসলে লড়াইটা শেষ হয়নি।
মানুষের চুপ করে থাকাটা মানেই
চাহিদা বেড়ে যাওয়া।
মানুষের চুপ করে যাওয়া মানেই স্বাভাবিক নয়।
লড়াই-টা শেষ হয়নি।
মাথা
রঙ্গীত মিত্র
আমরা ধর্মের কথা বলে
আগুন ছড়াচ্ছি।
এতদিনেও অন্ধকারকে আলো ভেবে
শয়তানেরা মন্দির বানাচ্ছি।
শয়তানের-ও শেষ হয়,
কারণ সৃষ্টির স্রষ্টার সৃষ্টির কথা বলা হয়নি।
আমার মাথা ঘুরতে থাকে।
পাকুড়ছায়ার কনসার্ট
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
গবেষণাগারে সালোকসংশ্লেষ দেখে চলেছি আমি
প্রতিটি সবুজপত্রে জীবনের বুদবুদ খুঁজে চলেছি
এমন দিনে তুমি বরণডালা সাজিয়ে এনেছ
ছায়ামাখানো তুলি দিয়ে আঁকতে চাইছি সেই ছবি।
গবেষণাগারে যন্ত্রের কাঁটা সামান্য কেঁপে উঠতেই বুঝলাম
তোমার আমার চিরস্মরণীয় জাগরণ এবার সুনিশ্চিত।
অন্ধকার কেটে যাবে এইবার
পাতার ছায়ায় ঢেকে দেবে মরুপ্রান্তর
সেইখানে বেড়ে উঠবে মৌসুমী বায়ু
ভেসে আসবে আশ্চর্য সুর দূর পাহাড়ের কোল বেয়ে
অস্ফুট শব্দগুলি চিরন্তন কোনও ভাষা হয়ে বেজে উঠবে
ভালোবাসার কনসার্টে।
পাকুড়গাছের ছায়ায় বসে প্রশ্ন করে যাব আমরা অনন্তকাল
উত্তর ভেসে আসবে স্মিত স্নিগ্ধ হাসির ভিতর
তাঁর অনন্তভেদী প্রতিকৃতি। দুই হাত মুদ্রার মতো চেয়ে আছে
এই মুদ্রা আমার বড় চেনা
এই মুদ্রা সুশ্রুষা আনে পাতার শিরার ভিতর
অবশেষে চরাচর শান্ত এখন বনপাকুড়ের আঁচলে ঢেকে যাবে এইবেলা।
অধরা
শুভব্রত সাহা
আবার যদি প্রেমিক সাজি? লুকিয়ে দেখি তোকে?
লাজুক হেসে মুখ ফেরাবো চোখ পড়লে চোখে।
সাহস করে বলবো না হয় মনের কথা যত,
ধরবি তো হাত? ডাকবি কাছে? ফিরিয়ে দিবি না তো?
সদ্য প্রেমের মহাষ্টমী পাড়ার দুর্গাবাড়ি,
পাঞ্জাবিতেই মানায় আমায়, লাল পেড়ে তোর শাড়ী।
নবমীতে প্রেম নিবেদন পাক্কা হিরোর মত,
আমার হবি এই তো দাবী, “না” বলবি না তো?
উতলা ওই শ্রাবণ আসুক, আস্কারা দিক প্রাণে,
মন হারালে মেঘের দলে আর কি বাধা মানে?
বৃষ্টি হয়ে তোর আঙিনায় ঝরবো অবিরত,
ভিজবি সাথে শাওন রাতে? পালিয়ে যাবি না তো?
অনেক শ্রাবণ কাটলো সাথে সময় গেলো বয়ে,
কনের বেশে বিদায় নিলি অন্য কারো হয়ে।
এই জনমে অধরা তুই প্রাপ্য শুধুই ক্ষত,
পরজনমে আমার হবি? ভুলে যাবি না তো?
লেটার বক্স-
বিদিশা নাথ ভৌমিক
আয়নার গায়ে হাত বোলাই,
অদৃশ্য, প্রাক্তন রূপের খোঁজ করি তাতে,
বহুদিন তোমার খবর আসে না কোনো!
এবার গেলে ডক্টর বলেছেন ন্যাড়া হয়ে যেতে ।
এক দু গাছি চুলও উঠে গেছে রশ্মির তীব্রতায়।
পরম মমতায় মা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে লাল লেটার বক্স,
বাবার চিঠি আসত ওতে একসময়।
বোকা রমণী ভাবে,
এই বুঝি শূন্য হয়ে যাওয়া মেয়েটার নাম ধরে ডাকবে পিওন!
|| পাপ ||
শোভন
রাত নামে মন্থর সরীসৃপের মতো চুপিসাড়ে।
যখন ঘুমাচ্ছে পৃথিবীর সব শিরীষ গাছ,
সেই গাছ বেয়ে, পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়
রাত নেমে গেছে―
কয়লার মতো কালো, নিকষ এক অন্ধকার রাত
যাকে তুমি অমাবস্যা বলে জানো।
এ আঁধার কখনও বলে না কোনো কথা।
এ রাত্রি কখনও ডাকে না কোনো নাম ধরে।
এ কৃষ্ণপক্ষের আকাশ কখনও ঝিঁঝিঁদের দেয়নি তো সাড়া।
আজ হঠাৎ ভিড় যতো বাদল পোকাদের।
বৃষ্টি নামলে বেরিয়ে আসে ওরা, আলোর খোঁজে…
যতোই রাত গভীর হোক।
কোনো এক রাস্তার ধারে
যখনই তাকিয়ে দেখো শালিকেরা ইতিউতি চায়,
একে অপরের সাথে অধিকতর চঞ্চলতায়;
মনে হয় না কি―
কী বিষম ঝগড়ায় ব্যস্ত রয়েছে তারা?
আসলে হৃদয় যদি পুড়ে থাকে বিমর্ষ রোদে,
গেঁথে থাকে প্রত্যাশার চিরচেনা সুর,
সুশীতল ছায়া কিংবা নতুন বাঁশীও থাকে অবহেলা হয়ে।
শালিকেরা ঝগড়া করে না তো রোজ,
বিষন্ন চোখ দিয়ে পৃথিবীর সব প্রেমই বিষাদগ্রস্ত মনে হয়।
ক্রমাগত চাই শুধু সহজ, সরল কিছু ফুল
কঠিন পাষাণ কিংবা ধাতব পাত্রে ভরে নিতে।
পাপড়ির কোমলতা বুঝবার আগেই
প্রতিবার দলিত হয় তারা;
পেতে চায় জীবনের জটিলতাবিহীন
নির্বাক সাজি এক, বহনের যোগ্যতা নিয়ে।
কিন্তু যে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে যায় প্রেমের গহীনে,
আছে সে তো অন্য কোথাও, কোনো ছায়াময় তেপান্তরে।
ভিনদেশী ঘোড়াদের পিঠে বসে
যে আরাম ছিল এতোদিন,
হঠাৎ নতুন হরিণ কীভাবে মেটাবে সেই চাওয়া?
জোনাকীর মতো যদি নিভে যেতে পারো
জোনাকীর মতো করে জ্বলে ওঠা শিখে নিতে হবে।
ভেলা পারাপার করা যতো সহজ
ততোধিক কঠিন মাঝনদীর সাঁতার― বুঝে নিতে হবে।
অনাগত স্রোতের প্রতিকূলে লাফ দিতে হবে ভয়হীন পরিসরে।
এখানেই বয়ে যাবে সব রোদ্দুর মাখা অভিমান,
এখানেই রয়ে যাবে সব পরিযায়ী সাদা বক।
আদিগন্ত কষ্ট নিয়ে তোমার অপেক্ষা শুধু
হলুদ এক সর্ষের ক্ষেতে বসা ফিঙে কিংবা
সূর্যমুখী গাছেদের অভিসম্পাত নিয়ে বেঁচে থাকা।
জীবনের সাথে রোজ যাপনের সম্মুখসমরে
ক্ষমা চলে যায় নতুন রাস্তা খুঁজে,
বদলে যায় চাওয়া-পাওয়া-ডিঙি বাওয়ার সব হিসাব কিতাব।
একান্ত নীরব থাকে আত্মোপলব্ধির জাদুস্পর্শ।
অনুশোচনার ভারে যদি ঋদ্ধ হয় অপরাধবোধ,
তখনই বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে ওঠা দুঃখ
ডানা ঝাপটে উড়তে চায়।
এর কোনো ঔষধ নেই, পথ্য নেই, বৈদ্য নেই;
এ ক্ষতির কোনো ক্ষতিপূরণ নেই।
নিজস্ব পাপের ক্রুশ কাঁধে নিয়ে এসো আমরা অনুতপ্ত হই,
কেননা অনুতাপই মানুষের কৃত পাপের একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত।
কোটেশন অংশ জীবনানন্দ দাশ।
অচিন্ত সেনগুপ্ত
সবেমাত্র রূপসী বাংলা শেষ করেছি,
হঠাৎ পরিচারকের ডাক, বাবু আদিবাসী নাচ দেখতে যাবেন?
অনেকক্ষন ধরেই দূর থেকে মাদলের মৃদু শব্দ ভেসে আসছিলো। আমি বললাম, চলো তাহলে যাওয়া যাক। বাংলোর জিপেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম দুজনে। সন্ধ্যে নেমেছে বেশ কিছুক্ষন। হাওয়ায় শিমুল-পলাশের গন্ধ, আর আকাশ জুড়ে চাঁদের আলোর খেলা, কত কি মনে পড়ে যায়, “আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে”।
গাড়ির সামনের সিটে বসে একটা সিগারেটে ধরালাম। দূরে ওই যে অযোধ্যা পাহাড়, কিছুটা আবছা। একদল পুরুষ ধুতি পরে আর মেয়েরা লাল শাড়ি পরে হাঁটছে পথের এক প্রান্ত দিয়ে। মাথার খোঁপায় পলাশের সাজ। অবশেষে পৌঁছে গেলাম। মাদলের তালে তালে তাদের এক ই ছন্দে নাচ, মনে হলো, এইতো জীবন, বাঁধনহীন-মুক্ত আকাশের নীচে কত জীবনসংগ্রাম, কত না পাওয়া-ভালোবাসাহীন অভিযোগ মহুয়ার গন্ধে ম্লান হয়ে আসছে। মাদলের আওয়াজ সময় ভেদ করে যেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি দিয়ে গেলো মনে। বেশ রাত করে ফিরলাম বাংলোয়। পরের দিন সকালে। কলকাতা ফিরে মনে হলো, এখানে আকাশ দেখা যায়না, কেবল ধোঁয়ায় ঢাকা সমস্ত শহরটা যেন অন্ধকূপ, যান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন। আমার শহরে যেন
“আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে”।