চতুর্থ বর্ষ-দ্বিতীয় সংখ্যা-সম্পাদকীয়
“ক্ষমতা যদি শুধু শাসনের নাম হয়, তবে তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে ধ্বংসের বীজ।”
সালটা ২০২৫। বাংলায় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ আশ্বিন মাস। এক অদ্ভুত সংযোগের সময়। দু’টি শতবর্ষ কোনও শান্ত উদযাপন নয়—এ যেন ইতিহাসের দরজা খুলে এক সতর্কবাণী, এক তীব্র শোকসংগীতের পাঠ পড়া। দু’জনের সৃষ্টিই প্রশ্ন তোলে: রাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য কী? শুধু শাসন আর ক্ষমতা, নাকি মানুষের মর্যাদা রক্ষা?
একদিকে নাট্যকার বাদল সরকারের জন্মশতবর্ষ—যাঁর থার্ড থিয়েটার শুধু মঞ্চ ভেঙে দেয়নি, ভেঙেছে প্রচলিত রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্কের মিথ। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী লিখিত আকারে প্রকাশের শতবর্ষ—এক শতাব্দী পেরিয়েও যার রাজনৈতিক তাৎপর্য আজও রক্তের মতো তাজা।
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী কেবল এক রূপক নাটক নয়, এক নির্মম রাষ্ট্রদর্শন। রাজপুত্রের খনির শহর, যেখানে মানুষের শ্রম আর রক্ত মিলিয়ে তৈরি হয় ক্ষমতার অট্টালিকা— এ এক এমন রূপক যা আজকের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে হুবহু মিলে যায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন, আমেরিকা-রাশিয়া, আমেরিকা-চীন, ভারত-পাকিস্তান, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন— প্রতিটি সংঘর্ষই যেন রক্তকরবী–র খনির একেকটি সুড়ঙ্গ, যেখানে স্বর্ণের লোভ আর ভূ-সম্পদের অন্ধকারে রাষ্ট্র যন্ত্র মানুষকে কেবল ‘শ্রমিক সংখ্যা’ করে তোলে।
ভারত যখন প্যালেস্টাইনের পক্ষে ভোট দেয়, আর আমেরিকা ইজরায়েলের— তখন বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আসল খনি হল স্বার্থান্বেষী মনোভাব। নৈতিকতা নিছক অলঙ্কার মাত্র!
বাদল সরকারের নাটক থিয়েটারের ফর্ম প্রসঙ্গে বলতে চেয়েছে, “মঞ্চ যদি মানুষকে না নাড়ায়, তবে সে কেবল সাজসজ্জার ব্যবসা।” তিনি রাস্তার মানুষকে মঞ্চ বানিয়েছিলেন, নাগরিককে করেছিলেন নাটকের অংশীদার।
আজকের পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি, এবং যুবসমাজের হতাশা ক্রমশ ঘনীভূত, সেখানে বাদল সরকারের প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ —রাষ্ট্র কি শুধু ক্ষমতার প্রাসাদ, না কি মানুষের মৌলিক চাহিদার রক্ষক? খাদ্য, শিক্ষা, কাজ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এই গুলো না দিতে পারলে, কোনও সরকার কতদিন টিকে থাকতে পারে?
বাংলাদেশে যুব আন্দোলনের পরিণতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—যখন ন্যায্য দাবি পূরণ হয় না, তখন আন্দোলন প্রাথমিকস্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকলেও, দমন-পীড়ন, মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদ সেটিকে অনায়াসে গ্রাস করতে পারে।
নেপালের সাম্প্রতিক তরুণ প্রজন্মও অন্য এক ধরণের প্রতিরোধের ইঙ্গিত দিয়েছে। এই ভূখণ্ডের অভিজ্ঞতা বলছে: ক্ষমতা যদি মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সেই যত বড় শক্তিই হোক না কেন, ক্ষমতার পতন অবশ্যম্ভাবী—
ভারতকে এখন প্রমাণ করতে হবে— বৃহত্তম বাজারের উর্ধ্বে সে এক শান্তিদূত, এক সাংস্কৃতিক দিশারী, এক অর্থনৈতিক দূরদর্শী রাষ্ট্র।
কিন্তু তা করতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়সঙ্গত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, ধর্ম ও জাতপাতের উর্ধ্বে সমানাধিকার দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই সত্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক অস্থিরতা যতই ভয়ঙ্কর হোক, আমাদের ঘরও অগ্নিকুণ্ড রূপে তৈরি! রিজেন্ট পার্ক থেকে আরজি কর মেডিকেল কলেজ, কসবা ল কলেজ থেকে গ্রামবাংলার প্রান্ত— শাসকের অত্যাচার দাবানলের মতো দিকে দিকে ছড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সবচেয়ে নৃশংস উদাহরণ—শিশু তমন্নার হত্যাকাণ্ড। বিস্ফোরণের শব্দে থমকে গেছে এক শিশুর প্রাণ তার পাশাপাশি একমাত্র মেয়ে হারার শোকে একটি পরিবারের যাবতীয় স্বপ্ন, আশা..! যেখানে শাসকদলের বিজয় উৎসব আয়োজন করে মৃত্যুর ইস্তেহার। অভিযোগ স্পষ্ট: তমন্নার পরিবার বিরোধী মতাদর্শের সমর্থক— তাদের কণ্ঠ রোধ করতে এক শিশুর জীবন পর্যন্ত নিঃসংকোচে পুড়িয়ে দেওয়া গেল। এ কেবল অপরাধ নয়, এ এক রাজনৈতিক বার্তা: ভয় দেখিয়ে চুপ করে রাখা। শতবর্ষ পরে দাঁড়িয়ে আমরা যদি এখনও শুনতে না পাই এই আহ্বান, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে সেই খনিশহরের অন্ধকার— যেখানে আলো শুধু শাসকের সোনার গহনা রূপে প্রতিফলিত হয়!
আজকের পশ্চিমবঙ্গ, আজকের ভারত— এখনই সময় নিজেদের প্রমাণ করার; স্বাধীন শিল্পের জন্য স্পেস না থাকলে, ভাবনা চিন্তা – মত প্রকাশের, অনিয়মের বিরুদ্ধে কন্ঠ তোলার জন্য, প্রতিবাদ জানানোর জন্য স্পেস না থাকলে সমাজের ফুসফুস বন্ধ হয়ে যায়। একদিন শ্বাস নিতে পারবে না রাষ্ট্র নিজেই।
নচেৎ ইতিহাস আবারও সেই পুরনো প্রশ্ন তুলবে—“শক্তি নাকি মানুষের মর্যাদা –কোনটি আরও গভীর সত্য?”
ইতিহাসের থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কি পারছি সত্যের কাছে পৌঁছাতে নাকি শ্রদ্ধা আন্তরিকতার ভান করে আসলে মুখ ঢেকে ফেলছি অপরাধের নিশ্চিন্ত মুখোশে- এই সমস্ত প্রশ্ন এবং উত্তর খোঁজার দৃড় সংকল্প নিয়ে রোয়াক ওয়েবজিনের চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা।
–টিম রোয়াক