চতুর্থ বর্ষ-দ্বিতীয় সংখ্যা-ভ্রমণ
মেঘের ভেতরেই কোথাও ছিল কালিম্পং
অভিষেক রায়

ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো, ঘড়ির কাঁটা যেন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। কলকাতার ঘামে ভেজা জানালার ধারে বসে ভাবছিলাম সময় কি সত্যিই এগোয়, না কি সে ঘুরে ফিরে আসে, যেমন এলিয়ট বলেছিলেন,
“Time present and time past
Are both perhaps present in time future…”
আর তাই হঠাৎ করে, একরকম অস্থিরতা থেকে, আমি রওনা দিলাম। গন্তব্য কালিম্পং। এক শহর, যার নামেই যেন কোনো প্রাচীন ধ্বনি লুকিয়ে আছে।
রাতের ট্রেন ধরার সময় যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালাম, শহর তখনও ব্যস্ত। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যেও যেন একরকম থেমে থাকা — যেন কেউ কেউ সময়ের গায়ে হাত রেখেছে, কিন্তু সে ছুটছে না।
পাহাড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে এল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি করে কালিম্পং। পাহাড়ি রাস্তা, একদিকে খাদ, অন্যদিকে ঘন সবুজ। কোথাও দূরে, মেঘে ঢাকা কোন এক অচেনা আশ্রম, আর রাস্তায় মাঝে মাঝে ঝরনার ছায়া। সেইসব মুহূর্তে মনে হচ্ছিল Crack and sometimes break, under the burden,
Under the tension, slip, slide, perish…”
আমার চোখের সামনে দৃশ্য বদলাচ্ছে, অথচ আমি একেই সঙ্গে দেখে চলেছি আমার পুরনো কোনও স্বপ্ন।
কালিম্পং পৌঁছানোর সময় বৃষ্টি শুরু হলো। সে বৃষ্টি ঠিক বৃষ্টির মত নয় মেঘ যেন চোখের জল ফেলছে। হোটেলটি পুরনো ব্রিটিশ আমলের, কাঠের জানালা, কারুকাজ করা ছাদ, আর এক ধরনের নীরবতা, যা শহরে পাওয়া যায় না।
রাতটা নিঃশব্দ ছিল। অথচ সেই নিঃশব্দতায় কত শব্দ! জানালার বাইরে কুয়াশা, মাঝে মাঝে কুকুরের ডাকে মনে হচ্ছিল যেন দূর থেকে কেউ ডেকে উঠছে, আমার ভেতরের অতীতকে।
সকালে বেড়িয়ে পড়লাম দার্জিলিং
ফোট, থংসা গোম্ফা, আর হান্সেনডিং মনাস্টেরি। প্রতিটি স্থানে এক ধরনের ধ্যান ছিল। প্রার্থনার পতাকা, বাতাসে দোল খাচ্ছে যেন নিরব ভাষায় কিছু বলছে। এলিয়টের পঙক্তি মনে পড়লো
“The still point of the turning world.”
কালিম্পংয়ে সময় থেমে যায় না, বরং বয়ে চলে নিঃশব্দে।
এক বিকেলে আমি পৌঁছালাম পাইন ভিউ নার্সারিতে। অর্কিড আর ক্যাকটাসের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো প্রকৃতি এখানে প্রতিটি স্তব্ধতায় গান গায়।
তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত ছিল দূর্গোৎসবের আগের রাতে, এক চায়ের দোকানে বসে থাকা। দোকানটির নাম ছিল “সাইলেন্ট টি” কাকতালীয় নাম, অথচ সেখানে আমি প্রথম অনুভব করলাম, কালিম্পং শুধুই পাহাড় নয়, সে এক স্মৃতির নদী।
এক বয়স্ক ব্যক্তি, নাম ছিল শেরিং দর্জি, বললেন
এই শহর বদলে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু গলি এখনও পুরনো। আপনি যদি কান পাতেন, শুনতে পাবেন… কিশোর বয়সে কারা যেন কথা বলছে।
আমি সেই রাতে অনেকক্ষণ হাঁটলাম নিঃশব্দে, নিজের সঙ্গে। সেই রাস্তা যেন কবিতার মতো শব্দ নেই, কিন্তু ছন্দ আছে। পরদিন সকালে আমি গেলাম ডেলো পাহাড়ে। শহরকে পেছনে রেখে উঠে গেলাম অনেক ওপরে। চারপাশে মেঘ, নিচে সবুজ উপত্যকা। এলিয়ট আবার ফিরে এলেন মনে:
“At the still point of the turning world, there the dance is…”
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, নিঃশব্দে, অনেকক্ষণ। মনে হচ্ছিল পাহাড়ও কি শোনে ?
আমার মধ্যে যে সব গুঞ্জন, ক্লান্তি, কষ্ট সব যেন ধীরে ধীরে পড়ে গেল মেঘের ভেতর।
শেষ ভাবনা:
ফিরে আসার ট্রেনে বসে বুঝলাম ভ্রমণ মানেই শুধু স্থানান্তর নয়। কখনও কখনও, এ হল নিজের ভেতরে প্রবেশ। কালিম্পং এক শহর হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য সে এক কবিতার মতো যেখানে প্রতিটি বাক্য অর্ধসমাপ্ত, প্রতিটি মুহূর্তেই ধ্বনির নিচে চাপা থাকে নীরবতা।
“In my beginning is my end…” এই কথাটি মনে পড়ে যখন ট্রেন পাহাড় ছেড়ে সমতলের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু জানালার পাশে বসে আমি শুধু এটুকুই ভাবছিলাম
Cloud shall fade away, and I will be back someday, under rhododendron shadow… with you.