দ্বিতীয় বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা ✦ আলোচনা
‘আট বছর আগের একদিন’ পড়তে বসে
রিয়া চক্রবর্তী
এই পৃথিবীটাতে আমরা ভালো থাকবো বলে এসেছিলাম সেই কবে একদিন। কে যেন কানে কানে বলেছিল জীবন বড় সুন্দর। Life is beautiful. সেই সুন্দরের মরীচিকায় জড়িয়ে পার হয়ে গেছে কতও কতও সময়। আঁধার বেড়েছে শুধু। সুন্দর এসে ধরা দেয়নি। ১৯৯৭ সালে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছিল। যার নাম ছিল ‘Life is beautiful’. পরিচালক ছিলেন রোবার্টো বেনিগনি। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গল্প। একটি বাচ্চা ছেলের কাছে সেই বীভৎসতাকে কীভাবে আড়াল করেছিলেন এক পিতা, কীভাবে তার শৈশবকে অক্ষত রেখেছিলেন হিংসার থেকে বাঁচিয়ে তাই নিয়েই দু’ঘন্টা দু’মিনিটের এই সিনেমাটি ছিল। কিন্তু এমন ভাগ্য কজনেরই বা হয়। সিরিয়া থেকে রোহিঙ্গা কত জায়গায় কত মনের অপমৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন, তার খোঁজ কে আর রাখে?
আচ্ছা ধরুন, এরকম একটা হিংসার পৃথিবীতে থাকতে থাকতে… বঞ্চনা, বেকারত্ব, অপমান আর গলা ধাক্কা খেতে খেতে একদিন আপনি ঠিক করলেন যে, নাহ ! আর বাঁচবো না। খুউব মরে যেতে ইচ্ছে হলো আপনার। আপনার সেই মৃত্যু ইচ্ছেকে আমরা তাও কিছুটা দূর অবধি বুঝতে পারি। কিন্তু সব পেয়েও কেউ যদি বেমক্কা মরতে চায়? অশথের ডালের কাছে একগাছা দড়ি হাতে যায়… তখন ? এমনই এক মৃত্যুকে নিয়ে এই কবিতা। কবিতার নাম ‘আট বছর আগের একদিন’। জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।
আমরা সুন্দর জীবন বলতে কী বুঝি? বুঝি সাফল্য থাকবে, স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে, ভালোবাসা, প্রতীক্ষা, ভবিষ্যের হাসি থাকবে চোখে লেগে… এরকমই কিছু একটা তো? জানেন, এ লোকটির এ সবই ছিলো। তবু সে মারলো। মর্গে থ্যাতা ইঁদুরের মতো পড়ে রইলো। জয় গোস্বামী একবার তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন যে আমাদের আশপাশ দিয়ে এত যে বিপুল জনস্রোত বয়ে চলে রোজ, একসাথে সেতু পার হয়, আপনি জানেনও না যে আপনার ঠিক পাশে পাশে হেঁটে চলা লোকটি হঠাৎই ঝাঁপ দিতে পারে কিন্তু ঐ নীচের অতলে। কখন, কেন, কিচ্ছু না জানিয়েই।
ফড়িং, দোয়েল পারে বেঁচে থাকতে, কিন্তু মানুষ কেবল আজও বাঁচার এ অভিযোজন শিখতে পারলো না? আজও থুড়থুড়ে বুড়ো প্যাঁচা রাতের অপেক্ষায় থাকে ইঁদুর ধরবে বলে। তবে এই মানুষটা পারলো না কেন? কারণ এই প্রতিনিয়ত লড়াই করা, জাহির করা, প্রমাণ করার খেলাটায় কেউ কেউ ক্লান্ত হয়। ক্রমেই ছুটে চলা। ‘এর পর?’ … ‘এর পর?’… সত্যিই কী জানি কী এরপর? কী পেলে জীবনটাকে একটু অর্থপূর্ণ মনে হবে? এই বাঁচাটাকে ‘meaningless’ মনে হবে না? কালকূট একবার তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন – ‘কী চাই জানিনে। পাওয়ার জন্য পাগল হয়েছি।’ কোথায় ঘূণ কাটে, কোথায় অন্ধকার এসে জমা হয়, আমরা কেউই বুঝতে পারি না তা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘পুণ্ণাম’ গল্পের মতো কেবল শারীরবৃত্তীয় চাওয়া পাওয়া আর জাগতিকতাকে নিয়ে অনেকেই তো খুশি থাকতে পারে না। আবার পারেও কেউ কেউ। তারাই তো প্রশ্ন তোলে- মর্গে কী হৃদয় জুড়োলো?
না। জুড়োয় না কিছুই। আসলে আমাদের বোধ আমাদের ক্লান্ত করে। জয় গোস্বামী তাঁর আরেকটি কবিতায় বলেছিলেন যে, যে মনটা আজীবন ধরে পোড়ে,পোড়ায়, সেই মনটাই কেবল পোড়ে না ফার্নেসে যখন শরীরটা মৃতদেহ হয়ে সেখানে ঢোকে। আসলে এই মনটাই আমাদের একা করে। বিচ্ছিন্ন করে। সব থাকার মাঝে বসে হাহাকার জাগিয়ে তোলে। প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করে। বলতে ইচ্ছে করে-
“এত যদি ব্যুহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে।”
(বর্ম ।। মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় ।। শঙ্খ ঘোষ)
আসলে ঠিক কী চাই আমরা সেটাই আমরা জেনে উঠতে পারি না। সব পাওয়ার পরও কেন যে মন কাঁদে, কেন যে হাহাকার জাগে কে বলতে পারে? কবি বলছেন হাড় হাভাতের গ্লানি মানুষটিকে কখনও স্পর্শ করেনি। স্ত্রী সন্তানের ভালোবাসায় খাদ মেশেনি এতটুকু। তবুও তার মরতে সাধ জাগলো! কেন? এই প্রশ্নের সামনে জীবনানন্দ আমাদের এনে দাঁড় করাচ্ছেন। বলছেন –
“বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।”
সফোক্লিসের ‘অয়দিপাউস’ নাটকে বলা হয়েছিল অধিক জানা আসলে পাপ। জানার ভেতর এক ধরনের জীর্ণতা থাকে। জানতে জানতে আসলে আমরা ক্লান্ত হই। যা জানার নয়, যা দেখার নয়, সে সবই আমরা দেখি, জানি, জানতে বাধ্য হই। আজকের এই তথ্যের দুনিয়া না চাইলেও প্রতিদিন আমাদের মনে, মগজে, মননে তথ্য পাচার করতে থাকে… করতেই থাকে… আপনি না চাইলেও আপনার চোখের সামনে কখনও ফুটে উঠবে সেইসব ছবি যেখানে মৃতপ্রায় শিশুর শেষ শ্বাসের প্রতীক্ষায় দূরে অপেক্ষমান কোনো এক শকুন। কিংবা ধরুন চারপাশ জুড়ে মৃত্যু, হত্যা, গণহত্যার ছবি। কিংবা ধরুন মহাভারতের ভীষ্মের স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো মৃত্যু ইচ্ছেকে সংবিধান বৈধতা দেবে কিনা তাই নিয়ে চারদিক জুড়ে চলা আলোচনার কয়েক টুকরো তো এসে পড়তেই পারে আপনার জানার রেডিয়াসের মধ্যে। তখন ঠিক কী হয়? সব পাওয়া সত্বেও মনে হয় বড্ড গরল উঠে আসছে জীবনের মন্থন থেকে। এমন একটা পৃথিবীতে তো আপনি বাঁচতে চাননি! এত রক্ত, এত বুলেট, এত বিকলাঙ্গতা, শিরদাঁড়াহীনের মতো এই নুয়ে পড়া তো আপনি চাননি। তবুও এ সবই আপনি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে, দিয়েও যাবেন এই ভার আগামীকে। এ সভ্যতার দ্রুত কোনো আরোগ্য সম্ভাবনা নেই, এটা আপনি আস্তে আস্তে একদিন ঠিক বুঝে যাবেন। তখন আপনার ক্লান্তি বিষণ্ণতা একটা সহজ পলানোর পথ খুঁজবে। পেয়েও যাবে অতি দ্রুত। স্বেচ্ছামৃত্যু নাকি আত্মহনন ? মনে হবে এটাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। এই মৃত্যুর ভেতরেই আছে জানার ক্লান্তি থেকে মুক্তির পথ। কবি তাই বলছেন –
“জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়— আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।”
কখন বিষণ্ণতা আসে, কখন অভিমানের মেঘ এসে জমে কে বলতে পারে? কোন গোপন ক্ষয়, গোপন কোন পাপ, কোন দায়ভার পোড়ায় আমাদের কে বলতে পারে? এই বিষণ্ণতার মুখোমুখি আমরা প্রত্যেকেই একবার না একবার এসে দাঁড়িয়েছি । বিপন্ন বোধ করেছি। অস্থির এই পৃথিবীকে মন খারাপের কর্কট ক্রমেই কেটে চলেছে। আমাদের পূর্ব প্রজন্মও সুন্দর একটা জীবন, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু পারেনি সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে, আমাদেরই মতো। তাই আজ থেকে আট বছর আগের যে কোনও একটি দিনেই এমন ভাবে কেউ বাঁচার খেলাটার থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াতে চেয়েছিল হয়তো। কে খোঁজ রেখেছে তার। ধুলো পড়ে ধূসর হয়ে গেছে সেই ফ্রেম কবেই। আর আমরা এই মৃত্যুর কোনও অর্থ খুঁজে না পেয়ে আহার নিদ্রা মৈথুনের গতিচক্রে মগ্ন হয়ে কাটিয়ে দিয়েছি কালের পর কাল…
কবে প্রকাশ পাচ্ছে এই ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ? ১৯৪৪ সালে। অর্থাৎ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ছিল ১৯৩৯ খ্রি. থেকে ১৯৪৫ খ্রি. অবধি। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলেছিল ১৯১৪ খ্রি. থেকে ১৯১৮ খ্রি. অবধি। জীবনানন্দ দাশের জীবনকাল – ১৮৯৯ খ্রি. থেকে ১৯৫৪ খ্রি.। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন তিনি। বলা ভালো হানাহানির পৃথিবীকেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন আজীবন।
এই দুই বিশ্বযুদ্ধ আসলে সারা পৃথিবীর ভাববিশ্বের ওপরেই প্রভাব ফেলেছিল। ততদিনে ডারউইনের কাছ থেকে আমরা জেনে গেছি, যে যোগ্যতম হবে, সেই কেবল টিঁকে থাকবে। মৃত ঈশ্বর আর স্থবির মনুষ্যত্বের পৃথিবীতে মানুষ কেবল প্রাণীজগতের এক শ্রেণি মাত্র। ফ্রয়েড চিনিয়েছেন মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা অন্ধকারকে, অবচেতনকে। এসবের ওপর ভর করে ১৯১৮ সালে জন্ম নিচ্ছে ডাডাবাদ ত্রিঁস্তা জারার হাত ধরে। সব কিছুকে নাকচ করে এক নতুনতর পৃথিবীকে খুঁজছে তাঁরা। তাঁরা সবকিছুকে অগ্রাহ্য করতে চাইছে। যে পৃথিবীতে সুন্দরের মৃত্যু ঘটে প্রতি সেকেন্ডে, সেখানে কেন গাওয়া হবে সুন্দরের গান? তাঁরা বললেন –
“No more painters, no more writers, no more musicians, no more sculptors, no more religions, no more republicans…. no more, no more, NOTHING, NOTHING, NOTHING. “
(– Maurice Nadeau ।। Dada ।। The History of Surrealism ।। Penguin Books)
কিন্তু সব নাকচ করে দিলে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? নাকচ করলেই তো আর সব মিথ্যে হয়ে যায় না। ফলে এমন একটা পথ চাই যেখানে আমার চেতন অবচেতনের স্তরে স্তরে জমা হওয়া রক্তক্ষরণ, চিৎকার, কান্না, ক্রোধ, হাহাকারগুলো মুক্তি পেতে পারে। আত্মরক্ষার জন্য আমরা যেমনভাবে পাথর ছুঁড়ে মারি, ঠিক সেভাবেই আমরা ছুঁড়ে মারতে চাই আমাদের ঘৃণা, যন্ত্রণা আর হতাশাকে।
পরবর্তীতে এই নেতিবাচক মনোভাবে ক্লান্ত হয়ে ১৯২৪ সালে আঁদ্রে ব্রেতোঁর হাত ধরে ডাডাবাদ থেকেই জন্ম নিচ্ছে পরাবাস্তববাদ বা অধিবাস্তববাদ বা সুররিয়ালিজম। যার মূল ভিত্তিই হল এই ক্ষতবিক্ষত মনের অতল অবচেতনগুলি। আঁদ্রে ব্রেতোঁ বললেন তাঁর ম্যানিফেস্টোতে –
“Surrealism… pure psychic automatism, by which an attempt is made to express, either verbally, in writing or in any other manner, the true functioning of thought. The dictation of thought, in the absence of all control by the reason, excluding any aesthetic or moral preoccupation. “
(-Maurice Nadeau ।। The Foundation of the Movement ।। History of Surrealism ।। Penguin Books)
কেন এই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালাম? কারণ জীবনানন্দ দাশ নিজেই তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ – র ভূমিকায় বলছেন –
“আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাসের ও সমাজ চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার ; কারও মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ন অবচেতনার ; সুররিয়ালিস্ট ।”
চাওয়া-পাওয়ার ভাগবাটোয়ারার মধ্যেই আপেক্ষিকতাবাদের বাসা আছে। নইলে কেন থেকে থেকেই পিকাসোর আঁকা নীল মৃত্যুর মতো কোনও এক উটের গ্রীবার মতো বেখাপ্পা আর গভীর অন্ধকার এসে ডাক দেয় আমাদের কাউকে? আসলে আমাদের জিনের গভীরে কোথাও যেন স্তরে স্তরে জমতে থেকেছে বঞ্চনা, রক্ত, ক্লেদের ম্লান কুয়াশাগুলো, যুগের পর যুগ ধরে। মানুষের হিংসার দায়ভারও বুঝি অবচেতনে এসে জমা হয় আমাদের স্বগত সত্তায়। প্রশ্ন জাগে এই অর্থ, নারী, সন্তান… এই কী আমাদের চাওয়ার ছিল? সবাই দেখছে পাওয়াটাকে। কিন্তু যে মানুষটা চেয়েছিল, আর যে মানুষটা সব পেলো তারা দুজনে কী একই মানুষ? যে কোনও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল, চেয়েছিল সহজ একটা জীবন, সে পাওয়ার দাম চোকাতে চোকাতে সম্পূর্ণ একটা অন্য মানুষ হয়ে গেছে হয়তো এতদিনে। বাইরের খোলসটা শুধু এক রয়ে গেছে তার। সে আসলে জিততে জিততে হেরেছে ক্রমাগত। প্রতিনিয়ত সে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সমাজের আঘাতে, সময়ের ষড়যন্ত্রে, বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে। তাই জীবন ক্রমাগত অর্থহীন হয়েছে। এই অবচেতন, সুররিয়ালিস্ট এই দৃষ্টিভঙ্গিই এই কবিতায় উন্মোচিত হয়েছে। লুইস বুনুয়েলের সুররিয়ালিস্ট সিনেমাগুলো যেভাবে আমাদের শান্তি দিতো না, কেবল অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলতো, ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় এই মৃত্যুও ঠিক তেমনি, আমাদের বিব্রত করে, অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বুনুয়েলের সিনেমা “Un Chien Andalou” সম্বন্ধে বলতে গিয়ে Ado Kyrou বলেছিলেন –
“In turning to the cinema, Bunuel had not wanted to make an attractive film but rather one that embarrassed. That is why he opens the film with an unbearable scene : “… The razor blade passes over the young girl’s eyeball, sectioning it.” For the first time in the history of the cinema, a director tries not to please but rather to alienate nearly all potential spectators. “
(-Ado Kyrou ।। Un Chien Andalou ।। Luis Bunuel )
খেয়াল করলে দেখবো বাদল সরকারের ‘বাকী ইতিহাস’ নাটকেও এই ক্লান্তির কথা, এমনই এক মৃত্যুর কথা বলা আছে। পরিচিত একজনের আত্মহত্যার খবর কাগজে পড়ে এক দম্পতি সেখানে ভাবতে বসেছে যে লোকটি কেন আত্মহত্যা করলো? দুজনে দু’ভাবে ভাবলো। কিন্তু সব শেষে সেই চরিত্রটি, যার আত্মহত্যার খবর কাগজে বেরিয়েছিলো, সে এসে দাঁড়ায়। হাতে একটি অ্যালবাম। তাতে অসংখ্য মানুষের অসমাপ্ত বিপ্লব, স্বপ্নের ভাঙাচোরা টুকরো, মানবতার-অবমাননার খবরের পেপার কার্টিং আটকানো রয়েছে। ইতিহাসে জায়গা বড় কম। তাই সাধারণ মানুষের এইসব ওঠা পড়া কোনোদিন সেখানে ঠাঁই পাবে না। কিন্তু মানুষ হয়ে সময়ের এই বিপর্যয়ের দায় কীভাবে এড়াবে কোনো এক মননশীল মন? ‘বাকি ইতিহাস’ – এর এই দায় নিতে তাই তার বাঁচার সাধ চলে যায়। তাই সে আত্মহত্যা করে। সভ্যতার বীভৎসতার দায়ভার কেমনভাবে অসহ হয়ে ওঠে এক সময়, সেই কথা বলা আছে সেখানে। শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকেও লখিন্দরের দ্বিতীয় মৃত্যু তথা আত্মহননও সভ্যতার মন্থনে উঠে আসা এই ক্লান্তিরই ফলশ্রুতি। মনসামঙ্গলে লখিন্দরকে বাঁচিয়ে এনেছিল বেহুলা, স্বর্গ সভায় লাস্যময়ী নৃত্যে দেবতাদের তুষ্ট করে। কিন্তু তারপরের কথা মনসামঙ্গল লেখেনি। লিখেছেন শম্ভু মিত্র। দেখিয়েছেন এত কলুষ পার করতে করতে বেহুলা ও লখিন্দর হারিয়ে ফেলেছে তাদের জীবনের স্বপ্নটাকেই। বড্ড ক্লান্ত তারা। বাসর রাতের সেই লখিন্দর আর সেই বেহুলা আসলে মধ্যে মধ্যে মরে গেছে কবেই। তাই তারা জীবন ফিরে পেয়ে, ইচ্ছে পূরণের পরেও আত্মহত্যাকে বেছে নেয়।
একমাত্র মানুষেরই পাঁজরের তলায় শুধু একটা হৃৎপিণ্ড নয়, একটা হৃদয় থাকে, মনন থাকে, মেধা থাকে। তাই সে বিশ্লেষণ করে, স্বপ্ন দেখে, ক্লান্ত হয়, নুয়ে পড়ে ক্রমে। কেবল টিঁকে থাকা নয়, আরও গভীর এক বেঁচে থাকার সন্ধানে ফেরে মানুষ। আর সেই জীবনটার মুখোমুখি কোনোদিনই সে হতে পারে না। একটা একটা করে স্বপ্ন হাতছাড়া হয় তার। হাত ফসকে মূল্যবোধ তলিয়ে যায় কোন অতলে… প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যু এসে জমে। কবেই যেন কারা মনে মনে বাঁচাটাকে থামিয়ে দিয়েছে। প্রাত্যহিকের দায়ভার নিয়ে শরীর হাজিরা দেয় শুধু। চারদিকে ক্ষয় লাগা মানুষের মুখ…
এমন মৃত্যুর কাল, ঘূণে কাটা মন, আর কোলকুঁজো হয়ে আসা শিরদাঁড়ার গল্পটা যে কোনও জায়গায়, যে কোনও দিন, যে কারুর জন্যই সত্যি হয়ে উঠতে পারে… ডিপ্রেসানের পারদ নাকি আজকের পৃথিবীতে বড্ড দ্রুতই চড়ছে। আমরা ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার করেছি, কিন্তু মনের এই গহন অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ আজও খুঁজে পাইনি। খুঁজে পাইনি বাঁচার মতো করে বেঁচে থাকার কোনও পন্থা। বারে বারে তাই মৃত্যু পেরোতে পেরোতে একদিন আমাদের পুরো মরে যেতে ইচ্ছে করে। আর যতবার এই ইচ্ছে মনের ভেতর জেগে ওঠে ততবারই সত্যি হয়ে ওঠে এই কবিতা। পরদিনের খবরের কাগজ খুলে দেখি এই কবিতাটাই নতুন করে সেখানে আবারও লেখা রয়েছে।
বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার কূর্ম
হোমাগ্নি ঘোষ
হিন্দুধর্মে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ভাস্কর্যে দেখা গেছে তাদের বিবরণ, এই কচ্ছপ এবং কাছিমদের নিয়ে নানা উপকাহিনী নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। জীববিজ্ঞানের হিসেব বলছে এই কচ্ছপ দের বাস ছিল প্রায় কুড়ি কোটি বছর আগে ডাইনোসর এর সাথে, তাই তাদের আজ বর্তমান পৃথিবীতে প্রাচীনতম এক ঐতিহাসিক প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমরা সবাই এই কাছিম আর কচ্ছপের মধ্যে গুলিয়ে ফেলি, আসুন আজ তাদের নামের রহস্যভেদ করি। এই বাংলায় গঙ্গা ও ব্রম্মপুত্রের অববাহিকা অঞ্চলের জলাভূমি মূলত কচ্ছপ এবং কাছিমের বাসভূমি, শীতল রক্তের এই প্রাণীরা সাধারণত মাংসাশী উভয়চর এবং স্থলচর ও বটে। যারা জলে থাকে তারা কাছিম (turtle) আর যারা স্থলে থাকে কিন্তু জলও যাদের প্রয়োজন তারা হল কচ্ছপ (tortoise)। আসলে কচ্ছপ বা ইংরেজিতে turtle হল সব জাতের কচ্ছপ কাছিম দের একটা চলতি নাম, মুলত পুকুর, নদী, বড়ো জলাশয় এবং ডাঙায় যারা থাকে তাদের আমরা কচ্ছপ বা tortoise বলি আর যারা শুধুমাত্র সমুদ্রে(কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাদু জলে )থাকে তাদের কাছিম বা turtle বলে থাকি। এই কচ্ছপ এবং কাছিমের মাঝামাঝি আর একটি প্রাণী আছে যাকে আমরা বলে থাকি টেরাপিন (terrapin) যেটি জীবনের একটি সময় জলে কাটায় বাকিটা থাকে ডাঙায় তারা ডাঙায় থাকলেও থাকে কিন্তু জলাধারের আশেপাশেই, এদের বেশি সংখ্যায় দেখা যায় নদী ও সমুদ্রের মোহনা অঞ্চলে। তাই বলা যেতে পারে সব টেরাপিন কচ্ছপ কিন্তু সব কচ্ছপ টেরাপিন নয়।
কাছিম এবং কচ্ছপের বহিরাগত অনেক পার্থক্য থাকলেও তাদের সবচেয়ে ভালো পার্থক্য তাদের পায়ের,দেখা গেছে যে সব সময় জলে থাকার জন্য কাছিমের পাগুলো জলে থাকার জন্য অভিযোজিত তাদের পায়ের আঙ্গুল দেখা যায়না, বৈঠার মতন প্যাডেল তৈরী হয় যেটি তাদের সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। কচ্ছপের পায়ের গড়ন কিন্তু পুরোপুরি সাঁতার কাতার উপযোগী নয় তাদের পা নখযুক্ত এবং হাঁটার জন্যে অভিযোজিত। কাছিম ও কচ্ছপ বাঁচে অনেকদিন তাই মানুষ মজা করে বলে কচ্ছপের মতন আয়ু, এদের বয়েস নিয়ে অনেক মজার মজার কাহিনী আছে যেমন তুই মালিলা নামে একটি কচ্ছপ কে ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন কুক 1777 সালে চীন দেশের তঙ্গান রাজপরিবারকে উপহার দিয়েছিল যা রাজপরিবারের সযত্নে লালিত পালিত হয়ে 1965 সালে 188 বছর বয়সে মারা গেছিল। আমাদের কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা যখন তৈরি হয় তখন 1875 সালে লর্ড ওয়েলেসলি 1 টা দৈত্যাকৃতি কচ্ছপ চিড়িয়াখানাকে উপহার দিয়েছিল যার নামকরণ হয় অদ্বৈত, অনেকেই বলেছিলেন এই কচ্ছপ নাকি রবার্ট ক্লাইভের পোষা ছিল এই অদ্বৈত আলিপুর চিড়িয়াখানায় 2006 সালে মারা যায় মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল 150 বছর আবার অনেকে বলে তার বয়স আসলে দুইশ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি।
প্রায় সাড়ে চার শর বেশি প্রজাতির কচ্ছপ কাছিম আছে আমাদের পৃথিবীতে এরমধ্যে 294 প্রজাতি IUCN এর লাল সারণীতে (রেড ডাটা লিস্ট )বিপন্নতার বিভিন্ন স্তরে আছে, আমাদের ভারতের হিমালয় অঞ্চলে পূর্ব দিকে প্রায় 16 টি প্রজাতির কচ্ছপ পাওয়া যায়, উত্তর-পূর্ব দিকে 12 টি প্রজাতির এবং গাঙ্গেয় সমভূমি তে 15 টি প্রজাতির স্বাভাবিক বাসস্থান। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে আছে 18 প্রজাতির কচ্ছপ কাছিম, সবথেকে বেশি যে কাছিম আমরা বাজারে দেখতে পাই পুকুরেও দেখি টার নাম বোষ্টমীখোলোক কাছিম ওরফে সুন্দি কাছিম, বাংলায় বলে হুন্ডি কাছিম, আসামে বলে বামনি কাসো কাছিম।
এই কচ্ছপ এবং কাছিম রা ডিম পাড়ে ডিম গুলো গোলাকৃতি এবং লম্বাটে ধরণের হয়, পরিবেশের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে ডিম ফুটে বাচ্চা গুলো বের হয়। অনেক প্রজাতির কচ্ছপ এর ডিম রাখার বাশার তাপমাত্রার তারতম্য বাচ্চাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করে, যে বাসায় কচ্ছপরা ডিম পাড়ে সেই বাসার আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা যদি উচ্চ হয় তাহলে সেটি স্ত্রী বাচ্চার জন্ম দেয় পরিবেশের তাপমাত্রা কম হলে এবং বাসের ভেতরের তাপমাত্রা কম হলে সেই বাচ্চাটি পুরুষ হয়।
কচ্ছপের দেহ বর্মের মত দুটোপ্লেট দ্বারা আবৃত। একে সেল বা খোলস বলা হয়, প্লেট বা বরবটি সমান্তরালভাবে দেহকে আবৃত করে রাখে তাদের এই গরমে আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র যখন কোন প্রাণী কচ্ছপ কে আক্রমণ করে থাকে তখন কচ্ছপটি সারা শরীর গুটিয়ে নিয়ে সেই বর্মের মধ্যে আত্মগোপন করে। তাদের দেহের উপরের প্লেট টাকে বলা হয় ক্যারাপেস (carapace) এবং বক্ষদেশের প্লেট টাকে বলে প্লাসট্রন (plastron)। এই প্লেটগুলো দেহের হাড় দিয়ে তৈরি প্রায় 59 থেকে 61টা হাড় দিয়ে এই প্লেট তৈরী (carapace = neural plates, nuchal plates, pygal plates, costal plates, marginal plates)(plastron =entoplastron, epiplastra, hypoplastra, xiphilplastra)…
সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন খোলাবাজারে কচ্ছপ বিক্রি হয়, কচ্ছপের মাংস এবং ডিমের জন্যে প্রচুর কচ্ছপ কে মরতে হয়। এছাড়াও চোরাকারবারীদের কাছে বিভিন্ন কচ্ছপ কাছিম প্রচুর দামে বিক্রি হয়। এছাড়াও মানুষ দিনের পর দিন যেভাবে জীববৈচিত্র কে শেষ করছে তাতে কচ্ছপের প্রজাতির সংখ্যা ধ্বংস হতে চলেছে, যারা ফিল্ড ওয়ার্ক করে তাদের কথা অনুযায়ী কচ্ছপের স্বাভাবিক ডিম পাড়ার চর প্রকৃতপক্ষে নেই, এইটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সঠিকভাবে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করতে হবে এবং গবেষণা করতে হবে, এই সমস্ত কচ্ছপের সামগ্রিক ব্যবহার সম্পর্কে আমরা তাদের চাষ করতে পারি (mass cultivation ), এভাবেই আমরা বিশ্বপ্রকৃতিকে আমাদের জঙ্গলকে, সমুদ্রকে,নদীকে,জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রে তাদের প্রিয় যোদ্ধা কে ফিরিয়ে দিতে পারবো।
সমস্ত ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত