তৃতীয় বর্ষ ✦ প্রথম সংখ্যা ✦ আলোচনা
ধর্মাবতার, শুধুমাত্র থিয়েটারের জন্য
সর্বজিৎ সরকার
‘শুধুমাত্র থিয়েটারের জন্য ধর্মাবতার’— এই বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজীবন কত থিয়েটারকর্মী এই বাংলায় নিজের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুধুমাত্র থিয়েটার নিয়েই ভেবেছেন, চর্চা করেছেন। তবু এই বাংলার থিয়েটার চিরটাকাল গুটিকয় মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। আজকাল যারা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত, তারাই থিয়েটার দেখেন। তারাই নিজেদের বাহবা দেন। আবার পিঠ পিছে গালমন্দ করতেও ছাড়েন না। আর থিয়েটারের মান? এই বাংলার বহু নাট্যদল শুধুমাত্র নাট্য প্রযোজনা করেন রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে গ্রান্ট আদায় করার জন্যে। এরফলে যেন তেন প্রকারেণ একটা নাট্য নির্মাণ করা যায়। যে সকল সাধারণ দর্শক পরিচিতির সুবাদে সেই নাট্য দেখতে আসেন, ভবিষ্যতে তারা কখনওই থিয়েটারের টানে হলমুখী হবেন না। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই যখন ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামের রিল স্ক্রোল করতে ব্যস্ত, সবটাই যখন ভার্চুয়াল, তখন জ্যান্ত থিয়েটার দেখতে মানুষ ভিড় করবে কেন? কীসের টানে?
বাংলা থিয়েটারের বর্তমান হাল সম্পর্কে অবগত করার জন্য দুটো ঘটনা বলি। দুটি ঘটনাই নিজের চোখে দেখা। ধরা যাক, দলটির নাম ‘ক’। দলটি একটি নাটক মঞ্চস্ত করছে, তার নাম ‘খ’। নাট্যে একটি মুখ্য চরিত্র। চরিত্রাভিনেতার নাম ‘গ’। নাটকের শো হলে দলের বাকি লোকজন প্রযোজনাটিকে ‘গ’-এর নাট্য বলে উল্লেখ করেন। তখন তা আর ‘ক’ দলের নাটক থাকে না। এইবার কোনোভাবে সেই নাট্যের পরিচালক যদি ‘গ’-ই হন, তাহলে তো কথাই নেই। শো-এর আগের দিন নাট্যের কোনো সেট বা প্রপস্ খুঁজে পাওয়া না গেলে কী হবে, সেটার ভাবনার দায়িত্ব এসে পড়ে ‘গ’ এর ওপর। ফলে সমস্ত দায় নিয়ে বসে আছেন ‘গ’। কিন্তু এটা তো কাম্য নয়। নাট্যটি দলের। আর থিয়েটার তো একা একাও হয় না। আরেকটা ঘটনা বলি। একটি দল, একটি নাটকের কল শো পেয়েছে। সেই নাট্যের অভিনেতারা রিহার্সাল শুরু করেছে। হঠাৎ সেই নাট্যটির বদলে অন্য নাট্য ঠিক হল। কিন্তু সেই খবর আগের নাট্যের অভিনেতাদের জানানো হল না। সোশ্যাল মিডিয়া মারফত খবর পাওয়া গেল, সেই নাট্যটি হচ্ছে না। ডিরেক্টর প্রয়োজন মনে করলেন না এই ভুল স্বীকার করার। এই আমাদের সাধের বাংলা থিয়েটার। এরম অজস্র ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে বহু নাট্যদল। এইভাবে অনেক নাট্যদল ভেঙে যাচ্ছে, আবার নতুন দল গজিয়ে উঠছে। বিংশ শতকে বাংলা থিয়েটারের হাল কি এমনই ছিল? শুনেছি, তখনকার সময়ে নাটক ছিল এক উন্মাদনার জায়গা। গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার তো ছিলই, এর সঙ্গে জোরদারভাবে ছিল সাধারণ রঙ্গালয়। পেশাদার থিয়েটারের মঞ্চ। ছিল মাস মাইনের কর্মচারী। সৎভাবে থিয়েটার করার তাগিদ ছিল। আজকের দিনের মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে গ্রান্টের টাকা বাগিয়ে শখের থিয়েটারের নেশা ছিল না। ছিল থিয়েটারের মজবুত লৌহ বাসর। কিন্তু সেই লৌহ বাসরেও ফুটো ছিল। সাপ ঢুকে পড়ল। কেড়ে নিল লক্ষীন্দরের প্রাণ। সাধারণ রঙ্গালয়ের সেই দশাই হল। এখানে শুধু বেহুলা ছিল না। তাই পুনর্জীবন পাওয়া হল না সাধারণ রঙ্গালয়ের।
এই বছর সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। বঙ্গনাট্যে যে দুটি ধারা পাশাপাশি হেঁটে চলেছিল বেশ কিছু বছর আগেও, তাঁদের মধ্যে পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। টিকে আছে গ্রুপ থিয়েটার। অথচ এই গ্রুপ থিয়েটার কিন্তু পেশাদার রঙ্গালয়ের বিপরীতেই তৈরি হয়েছিল। যেন এক প্রতিস্পর্ধী ধারা। কিন্তু লাভ তো কিছু হল না। কোনো সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেন না এই পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয়কে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। অথচ বাংলা থিয়েটারের সার্বিক উন্নতির কথা মাথায় রেখে পেশাদার মঞ্চ, গ্রুপ থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার, বর্তমানে ইন্টিমেট থিয়েটার— সবকিছুরই একসঙ্গে জেগে থাকার প্রয়োজন ছিল।এক রুশ ভদ্রলোক ছিলেন। নাম গেরাসিম লেবেদেফ। এই বঙ্গের মানুষের কথা চিন্তা করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রথম পেশাদার রঙ্গালয়। ১৭৯৫ সালের জুনে ২৫ নম্বর ডোমটোলায় (বর্তমানে এজরা স্ট্রিট) জগন্নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’। স্থানীয় দর্শকরা টিকিট কেটে প্রথম থিয়েটার দেখেছিলেন। একটি অনুবাদ নাটকের অভিনয় হয়েছিল মাত্র দুদিন। তারপর এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে রঙ্গালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর লেবেদেফ পুনরায় নতুন কিছু করার কথা ভাবতে পারেননি। দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।
১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। জোড়াসাঁকোর চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’র উঠোন ভাড়া নিয়েছিলেন কিছু নাট্য উৎসাহী মানুষজন। মাসে ৪০ টাকা ভাড়া ছিল সেই উঠোনের। সেখানেই শুরু করেছিলেন টিকিট বিক্রি করে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের আয়োজন। মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণে ছিলেন ধর্মদাস সুর। সহায়তায় ছিলেন ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অন্যান্য ব্যবস্থাপণায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শকাসনে তিনটি শ্রেণি ছিল। প্রথম শ্রেণির জন্য ছিল ভাড়া করা চেয়ার। দক্ষিণা ২ টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য বাঁশের কাঠামোর ওপর পাটাতন তৈরি করে বেঞ্চি। দক্ষিণা ১ টাকা। তৃতীয় শ্রেণির জন্য দালানের সিঁড়ি ও রোয়াক। দক্ষিণা ৫০ পয়সা। এরপর সমুদ্রে উঠেছে একের পর এক ঢেউ। সে ঢেউ মিলিয়েও গেছে। যে বাঙালি দেশীয় নাট্যরসে (যাত্রা, কবিগান, পাঁচালি ইত্যাদি) এতকাল মজেছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে ঢলে পড়লেন শেক্সপিয়রের দিকে। কলকাতার ইংরেজি রঙ্গালয়গুলিতে যে নাটকগুলি পরিবেশিত হত, সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু হল নতুন ধরনের নাট্যনির্মাণ। মূল পথিকৃৎ ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসুরা। তাঁদের অসামান্য নাট্যপ্রতিভা দেখে সাধারণ দর্শক মোহিত হয়ে যাচ্ছেন। গুণমুগ্ধ ভক্ত সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অ্যামেচার নাট্যচর্চা থেকে বেরিয়ে তাঁরা শুরু করলেন পেশাদার থিয়েটার। ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’র উঠোনে প্রথম মঞ্চস্ত হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি। এই নাটকে সাতজন নারী চরিত্র ছিলেন। সেইসময় কোনো নারীকে পাওয়া যায়নি বলে পুরুষরাই সেই চরিত্রে রূপদান করে। প্রথম শো-তে ১০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। মঞ্চের দু-পাশে গ্যাসের আলো জ্বালিয়ে প্রথম অভিনয় হওয়ার পর দ্বিতীয় অভিনয়ের সময় পর্যাপ্ত আলোর বন্দোবস্ত করা হয়। ৪৫০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। বহ মানুষ টিকিট না পেয়ে ফিরে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। এইভাবে নির্মাণ হয়েছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ বা ‘সাধারণ রঙ্গালয়’। একঝাঁক তরুণদের স্বপ্ন সেদিন বাস্তবায়িত হয়েছিল। এইসব আজ ভাবলে সারা শরীর কেমন যেন শিউরে ওঠে।
গিরিশযুগ শেষ হওয়ার পর এল শিশিরযুগ। পেশাদার মঞ্চ পেয়েছে শিশির কুমার ভাদুড়িকে। তাঁর নাটক দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহের বাইরে লাইন পড়ত। টিকিট কেটে মানুষ উপভোগ করেছেন তাঁর থিয়েটার। রাষ্ট্রের কাছে চেয়েছিলেন নিজস্ব থিয়েটার স্পেস। সেই চাহিদা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র যখন তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে, তিনিও তখন সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ আজকের সময় দাঁড়িয়ে তাঁরই উত্তরসূরীরা রাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলনে নাটক মঞ্চস্ত করছে কিছু অনুদানের আশায়।
পেশাদার মঞ্চের ঠিকানা বলতে আমরা হাতিবাগান, শ্যামবাজার চত্বরের মঞ্চগুলিকেই বুঝি। সেখানে ছিল স্টার থিয়েটার, যেখানে নিয়মিত অভিনয় করেছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নটী বিনোদিনী। ছিল বিশ্বরূপা, রংমহল, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার, সারকারিনা। থিয়েটার পাড়া ছাড়িয়ে তৈরি হল কয়েকটি হল। তাদের মধ্যে অন্যতম কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। এছাড়া ছিল খাল পাড়ের প্রতাপ মঞ্চ, যেখানে সারা শহর তোলপাড় করা নাটক ‘বারবধূ’ অভিনীত হয়েছিল কত শত রজনী। আজ বিশ্বরূপা ভেঙে হয়েছে বহুতল বাড়ি। থিয়েটারের চিহ্ন বলতে রয়েছে ভাদুড়ি মশাইয়ের মূর্তি। রংমহল নাট্যমঞ্চ এখন শপিংমল। বলে রাখা ভালো, এটিই ছিল কলকাতার বুকে প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ভস্ম হয়েছিল ঐতিহ্যমণ্ডিত স্টার থিয়েটার। সরকারের বদান্যতায় আজ স্টার থিয়েটারর নতুন করে গড়ে উঠলেও সেটি এখন শুধু সিনেমার হল। রঙ্গনা থিয়েটার এখন তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন থিয়েটার করেছিলেন এই মঞ্চেই। পেশাদার থিয়েটারের অবস্থা খারাপ হওয়ার পর এই মঞ্চও বন্ধ হয়ে যায়। বিজন থিয়েটারের অবস্থাও সেই একইরকম। সারকারিনা মঞ্চের জৌলুস শেষ। কী এমন হল যে একে একে নিবিল দেউটী! পেশাদার থিয়েটারের এমন হাল হবে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিল?
এই পেশাদার মঞ্চের বুকে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন কত গুণী অভিনেতা অভিনেত্রী। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেতকী দত্ত, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ছয় থেকে নয়ের দশকে বৃহস্পতি, শনি, রবি এবং ছুটির দিনে থিয়েটার প্রেমী মানুষজন টিকিট কেটে হল ভর্তি করে ফেলতেন। বাইরে ঝুলত ‘হাউজফুল’ লেখা বোর্ড। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ঘটনা ঘটে এসেছে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘শ্যামলী’ নাটকের ৫৫২টি অভিনয় হয়েছিল। প্রথমদিকে এই নাটকে অভিনয় করতেন উত্তম কুমার। বিশ্বরূপার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিশির কুমার ভাদুড়ির নাম। এই মঞ্চে তিনি ‘সেতু’, ‘আগন্তুক’ এর মতো নাট্যে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় মঞ্চস্ত হয় শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’। রংমহলে দাপট দেখিয়েছেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, নির্মলেন্দু লাহিড়ির মতো ব্যক্তিত্বরা। ‘শতবর্ষ আগে’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘মায়ামৃগ’, ‘উল্কা’-র মতো নাটক মঞ্চস্ত হয়েছে এই ঘূর্ণায়মান মঞ্চে। রঙ্গনায় চলেছিল ‘জয়জয়ন্তী’, ‘মোসায়েব’, ‘কনে বিভ্রাট’, ‘বাদশাহি চাল’-এর মতো নাটক। বিজন থিয়েটারে ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’, ‘জজ সাহেব’, ‘হারিয়ে পাওয়া’-র মতো নাটকে দিনের পর দিন গেটের বাইরে ‘হাউজফুল’ লেখা বোর্ড ঝুলত। মানিকতলার খালপাড়ের কাছে ‘কাশী বিশ্বনাথ’ মঞ্চে অভিনীত হত বহু আলোচিত নাটক ‘নাম জীবন’। অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’ নাটকে অ্যান্টনির ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্তের গানে দর্শকরা মোহিত হয়ে যেতেন। কেতকী দত্ত ছিলেন সৌদামিনী এবং জহর গঙ্গোপাধ্যায় ভোলা ময়রা-র চরিত্রে অভিনয় করতেন। এই মঞ্চেই দর্শক দেখল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘মল্লিকা’, সন্ধ্যা রায়ের ‘সুজাতা’, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ‘না’, অনুপ কুমারের ‘অঘটন’, অপর্ণা সেনের ‘পান্নাবাঈ’।
শোনা যায় কেতকী দত্ত অভিনয়ের আগে মঞ্চ বন্ধ করে মশার উপদ্রব আটকানোর জন্য স্প্রে করতেন। তারপর হল খোলা হত। দর্শক ঢুকতেন। মশা, গরম সবকিছুকে উপেক্ষা করে মানুষ ভিড় করত হলে। প্রথমদিকে পেশাদার মঞ্চের অভিনেত্রীদের ‘মা’ বলে সম্বোধন করা হত। তৃপ্তি মিত্র ‘সেতু’ নাটক নিয়ে পেশাদার মঞ্চে পদার্পন করার পর সকলে তাঁকে ম্যাডাম বলে ডাকতেন। পেশাদার নাটকের ঘর ছিল একেকটা পরিবার। লাইভ মিউজিক হত। মঞ্চ করেছেন খালেদ চৌধুরীর মতো মানুষ। আলো সামলেছেন তাপস সেনের মতো ব্যক্তিত্ব। শিফ্টিং-এ লাইভ মিউজিক বাজত। সবাই ছিল হাউসের লোক। মাস মাইনের চাকরি। এই পেশাদার মঞ্চে মূল ছিল অভিনয়। অভিনয়ের জোরেই দর্শককে ধরে রাখতেন স্টার অভিনেতারা। জমজমাট ছিল পেশাদার থিয়েটার।
কেন বন্ধ হল এই পেশাদার থিয়েটার? কী সমস্যা হল তবে? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে আট-নয়ের দশকের দিকে। প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হচ্ছে। ঘরে ঢুকছে টিভি। দূরদর্শনে প্রথম বাংলা সিরিয়াল শুরু হল জোছন দস্তিদারের হাত ধরে। বহু দর্শক থিয়েটার দেখতে আসতেন গ্রাম-মফস্সল থেকে। কীভাবে আসতেন তারা? ট্রেনে, কখনও-বা বাস ভাড়া করে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের বোর্ড থিয়েটারে দেখতে আসতেন। এই তথাকথিত স্টারেরা গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছোতে শুরু করলেন। যাত্রা, থিয়েটার নিয়ে একেবারে দর্শকদের বাড়ির উঠোনে পৌঁছে গেলেন তাঁরা। এছাড়া টেলিভিশন ঢুকে গেল ধনী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরে ঘরে। ফলে ভাঙন ধরল পেশাদার থিয়েটারে। এই থিয়েটার মঞ্চকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন ছিল। দর্শকরা টিকিট কেটে নাটক দেখছে মানেই যে থিয়েটারে পেশাদারিত্ব বজায় থাকছে, এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। বোর্ড মালিক নিজে যদি নাটক লেখা শুরু করেন অথবা নাট্যপরিচালনাতর ভার নেন, তবে সেই থিয়েটার কি আর থিয়েটার থাকে! শেষের দিকে বেশিরভাগ থিয়েটার মানুষের পাতে দেওয়ার যোগ্যও ছিল না। দর্শক এমনিতেই কমছিল। বোর্ড মালিকরা লাভের থেকে লোকসানের মুখ দেখছিলেন বেশি। একে একে বন্ধ হতে শুরু করেছিল নাটকের হলগুলি। কোনো বড়ো সংস্থা এগিয়ে এল না পেশাদারি থিয়েটারকে বাঁচাতে। অন্য দেশে সরকার থিয়েটারের পাশে দাঁড়ায়। প্রচুর অর্থ থিয়েটারে ব্যয় করে। আমাদের দেশ ব্যতিক্রমী। থিয়েটারের কথা ভাববার সময় তাঁদের নেই। বিধান চন্দ্র রায় স্বয়ং শিশির কুমার ভাদুড়িকে বলেছিলেন, ‘লোকে খেতে পাচ্ছে না, তুমি এখন বলছ থিয়েটারের কথা’। কিন্তু এই বিধানচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আর্থিক সাহায্যে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ মুক্তি পেয়েছিল।
আমাদের দেশের থিয়েটার চিরকালই অভাগা। ১২৫ বছরের মাথায় আমাদের দেশের সাধারণ রঙ্গালয়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটল, এবং তার ২৫ বছর পর সেই সাধারণ রঙ্গালয়ের সার্ধশতবর্ষ পালন করছি আমরা। এই ঘটনা গোটা বিশ্বে বোধহয় আর কোথাও নেই। গ্রুপ থিয়েটারের পাশাপাশি এখন বাজারে এসেছে কোম্পানি থিয়েটার। আদলটা গ্রুপ থিয়েটারের মতোই। সেও তো সেইভাবে চলল না। কোনো একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে থিয়েটার কোনোদিনও বেশিদিন টেঁকেনি। কোভিড এল। লকডাউন হল। লকডাউন উঠে গেলে বিভিন্ন দল তৈরি করল নিজেদের ইন্টিমেট স্পেস। নিজের মতোন করে থিয়েটার করার লক্ষ্যে। জানি না, এই উদ্যোগ কতদিন কার্যকরী থাকবে। তবে এতকিছুর পরেও এতগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া হলকে পুনরুদ্ধার করা গেল না। থিয়েটারের মানুষদের এই নিয়ে বিশেষ হেলদোল আছে বলেও মনে হয় না। আজকাল থিয়েটারের থেকে বেশি মন দিতে হয় গ্রান্টের জন্য কাগজপত্র তৈরিতে। আছে সেন্ট্রাল, আছে রাজ্য। দু-পক্ষকে খুশি করে চলতে পারলে তো কথাই নেই। ফুলে ফেঁপে ওঠা নিশ্চিত। আজকাল বহু দলের নাটকে দর্শকাসনে বিশেষ লোকজন হয় না। অবশ্য লোক আনার জন্য যে মানের থিয়েটার করার প্রয়োজন, তার দিকে খেয়াল দেওয়ার মতন সময়ই বা কই! মানুষ আজও স্টারের অপেক্ষা করে। কোনো এক দেবশংকর হালদার, গৌতম হালদার বা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের দিকে চেয়ে থাকে সাধারণ দর্শক। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আর ব্যতিক্রম থাকে বলেই থিয়েটার এখনও বেঁচে আছে। সাধারণ রঙ্গালয় মরে গিয়ে প্রমাণ করেছে থিয়েটার এখনও খানিকটা জীবিত। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে। তাই তো ১৫০ বছর পালন হচ্ছে। ধর্মাবতার, শুধুমাত্র থিয়েটারের জন্য সাধারণ রঙ্গালয়ের আরও অনেকগুলো বছর নিশ্চয়ই পালন করা হবে! বন্ধ হলগুলোর সামনে ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে নাট্যচঞ্চুরা সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে কাঁদুনি গাইবেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন নেতা, মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মীরা। বাংলা থিয়েটারের নবযুগ আসছে বলে রাতে মোচ্ছব হবে। মোদ্দা কথা, যতদিন সরকার ভোটের বাক্সকে তাজা রাখতে সরকারি অনুদান দিয়ে যাবে, ততদিন বাংলা থিয়েটার এইভাবেই যুগ যুগ জিও!
গহরজান : একটি জীবন ও অফুরন্ত বিস্ময়
দেবজ্যোতি রায়
হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সংগীতের বিভিন্ন রূপ ও রীতিতে বিরল সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী গহরজান। যেমন তাঁর প্রতিভা তেমনি বিপুলবিস্তৃত শিক্ষা। অন্তত দশটি ভাষায় সংগীত পরিবেশন করতে পারতেন। তাঁর গাওয়া গানের রেকর্ডের সংখ্যা আনুমানিক ৬০০। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যাঁর কণ্ঠের সংগীত রেকর্ড করে গ্রামাফোন কোম্পানি। ১৯০২ সালে। খেয়াল, ঠুংরি, দাদরা, কাজরি, তারানা, গজল, ভজন, ধ্রুপদ, ধামার— প্রায় সব ধরনের সংগীত রীতিতে ঝরে পড়েছে আশ্চর্য কণ্ঠমাধুর্যের ঐশ্বর্য। কত রাজা জমিদার, বাবুসমাজ, ধনাঢ্য ব্যক্তি, সংগীতরসিক ছিলেন তাঁর মুগ্ধ শ্রোতা। আর রূপলাবণ্যে যেন সাক্ষাৎ অপ্সরা। সে যুগের বিখ্যাত ওস্তাদদের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছেন বিচিত্র ধারার সংগীতের। কত্থক নৃত্যের লখনৌ ঘরানার স্রষ্টা পণ্ডিত বৃন্দাদিন মহারাজের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পণ্ডিত বৃন্দাদিন মহারাজ সম্পর্কে পণ্ডিত বিরজু মহারাজের দাদু। গহরজানের নৃত্যকলার অলৌকিক তরঙ্গ কত জলসা, মহফিল ও বাগানবাড়িকে মুগ্ধবিস্মিত করেছে। সেই সুষমা যেন অপার্থিব। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়ি সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা ও তারিফের জন্য সুবিখ্যাত। ভারতের নামজাদা ওস্তাদরা সেখানে আসেন সংগীত পরিবেশন করতে। মালকাজান কোনো এক নবমীর রাতে পাথুরেঘাটার ঘোষবাড়ির আসরে আমন্ত্রিত। সঙ্গে গহরজানও যাবেন। তিনি তখন কিশোরী। সেবার সপ্তমীর দিন মালকাজান ও গহরের অনুষ্ঠান ছিল শোভাবাজারের দেববাড়িতে। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের জাঁকজমক, সমঝদারি ও বিলাসিতার পরম্পরা বহন করছে দেববাড়ি। কিন্তু ঘোষবাড়ির সংগীতসভার ঐতিহ্য বিভিন্ন প্রদেশের নামী ওস্তাদদের সম্মিলনে সমৃদ্ধ। তাই আলাদা প্রস্তুতি নিয়েছেন বড়ি মালকাজান, গহরের মা। ওস্তাদজির কাছে রেওয়াজ করেছেন গহরজানও। অনেক রাতে গহর এলেন মায়ের ঘরে। মাকে বললেন— ‘আমি ঘোষবাড়িতে বাংলা গান গাইব’। বড়ি মালকাজানের আশঙ্কিত উত্তর— ‘শেষে একটা কেলেঙ্কারি হবে! কী সব পাগলের মতো ভাবছিস!’ গহর তখন মাকে শোনালেন যদুভট্টর গানের সরগম। খালি গলায় গানের দু-এক কলি শুনে মা স্তম্ভিত। মেয়ের প্রতিভায় বাক্যহারা। আনন্দিত হয়ে সম্মতি দিলেন। নতুন রীতির শিক্ষাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ ও অবিস্মরণীয় ভঙ্গিতে পরিবেশনের সামর্থ্য ছিল গহরজানের।
নতুন চ্যালেঞ্জে নতুনভাবে আবিষ্কার করতেন নিজেকে। তাই বাংলা, হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, আরবি, ফারসি ছাড়াও ফরাসি ও ইংরেজি গানে তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। গানের বহুমুখী ভাষা ও ঘরানা তাঁর সুরে মোহজাল বিস্তার করত। তুলনাহীন জনপ্রিয়তা ও প্রাচুর্য অর্জন করেছিলেন। ছিল খামখেয়ালিপনা, বিলাসিতা। ছয় ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি চড়তেন। যা পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের চোখে ঔদ্ধত্য। এজন্য তাঁকে ১০০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। তবু ফিটন গাড়ি ছাড়েননি। তাঁর জনপ্রিয়তা এতদূর বিস্তৃত ছিল যে পোস্টকার্ড, দেশলাইবাক্স ইত্যাদিতে ছবি ছাপা হতো। সান্নিধ্য লাভের জন্য ছিল শ্রোতৃমণ্ডলীর অধীর প্রতীক্ষা। ১৮৮৭ সালে বিহারের দারভাঙা রাজসভায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর সংগীতজীবনের আত্মপ্রকাশ। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্গতা ও বেদনা আর্ত করেছে গহরজানের ৫৭ বছরের অবিস্মরণীয় জীবন। অনেক ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন, নাটকীয়তায় ভরা জীবনের ক্যানভাস বিচিত্র রঙে রক্তিম, আবার কখনও ধূসর। চারদিকে উজ্জ্বল আলোর রোশনাই। অন্যদিকে একাকিত্বের অন্ধকার। তুমুল তারিফ, করুণ বিষণ্ণতা। খাতির ও প্রতারণা। যাঁর নৃত্য, সংগীত, শরীরী বিভঙ্গ তামাম ভারতকে আলোড়িত, পুলকিত করেছে। তিনিই অন্তরালে যাপন করেছেন অতৃপ্তি ও রক্তক্ষরণের জীবন। ইতিহাস গহরজানকে চিহ্নিত করেছে আশ্চর্য প্রতিভার বিস্ময়ে। সমকাল অতিক্রম করে যাওয়া গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে।
গহরজানের সার্ধশতবর্ষ সদ্য পার হলো। এখনও তাঁর জীবনরহস্য ও প্রতিভা নিয়ে ভারতবাসীর পর্যাপ্ত কৌতূহল। তাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। সম্প্রতি প্রকাশিত বিক্রম সম্পদ রচিত— ‘MY NAME is GAUHAR JAAN!’ The Life and Times of A Musician. এই গ্রন্থের ভূমিকায় ভুবনবিখ্যাত সরোদশিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলি খান তুলে ধরেছেন তাঁর বাবা ওস্তাদ হাফিজ আলি খানের সমসাময়িক শিল্পী গহরজান সম্পর্কে সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ— ‘Gauhar Jaan was a legend even her own life time and commanded a huge amount of respect in the music circles of the time’. ওস্তাদ আমজাদ আলি খানও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন গহরজানকে— ‘the colourful life of one of the most successful and historically important singers of this century.’ গায়ক ও নৃত্যশিল্পীর পরিচয়ের পরেও গীতিকার গহরজান সম্পর্কে অনেক গুণী মানুষ আপ্লুত ছিলেন। তাঁর লেখা ঠুংরি আজও আবেশ ছড়ায়। পণ্ডিত যশরাজ বলছেন — ‘As a matter of fact thumries written by Gauhar Jaan……. are still sung today by many across India.’ ভারতশ্রেষ্ঠ বাইজির জীবনে সম্মান ও প্রাপ্তির অভাব ছিল না। পতঙ্গের মতো কত রাজপুরুষ তাঁর রূপবহ্নিতে ঝাঁপ দিতে চাইতেন। কিন্তু মোহান্ধের স্তুতি তাঁকে ক্রমশ ক্লান্ত করেছে। আজীবন গভীর নিঃসঙ্গতা ও ভেতরে ভেতরে রিক্ত মনের বিপন্নতা বহন করেছেন গহরজান।
গহরজানের জীবনকথা নাটকীয়তায় ভরা, চমকপ্রদ। তাঁর মা, সে যুগের বিখ্যাত বাইজি, নর্তকী ও গায়িকা বড়ি মালকাজানের আদি নাম ছিল ভিক্টোরিয়া হেমিংস। তখন তিনি ধর্মমতে খ্রিস্টান। ভিক্টোরিয়া হেমিংসের মা রুকমিনি এবং বাবা ব্রিটিশ সৈনিক হার্ডি। ১৮৭২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদের হোলি ট্রিনিটি চার্চে আর্মেনিয়ান সাহেব রবার্ট উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন ভিক্টোরিয়া হেমিংস। বিয়ের সময় ভিক্টোরিয়ার বয়স ১৫, আর ইওয়ার্ড ২০। ইওয়ার্ড পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করতেন বরফকলে। তাঁদের একমাত্র মেয়ের জন্ম ১৮৭৩ এর ২৬ শে জুন, উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে। জন্মের দু’বছর পর এলাহাবাদের মেথডিস্ট গির্জায় মেয়েকে ব্যাপটাইজ করানো হলো। তার নাম রাখা হলো অ্যালেন অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। পরবর্তীকালের গহরজান। এর কিছুদিন পর ইওয়ার্ড স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা আনেন। ১৮৭৯ সালে ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ। মেয়ে রইল মায়ের হেফাজতে। আজমগড়ে তাঁদের জীবন ছিল অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত। এই বিপদের সময় খুরশেদ নামে এক ব্যক্তি ভিক্টোরিয়ার পাশে এসে দাঁড়ান। খুরশেদের পরামর্শেই আজমগড় ছেড়ে তাঁরা চলে এলেন বেনারস। সেখানে ধর্মান্তরিত হলেন ভিক্টোরিয়া। গ্রহণ করলেন ইসলাম ধর্ম। নতুন নাম বড়ি মালকাজান। মালকাজানের নবজন্মের কারিগর তাঁর নিভৃত প্রেমিক খুরশেদ। একদিন ভাগ্যান্বেষণে বেনারসের বাইজি মহল্লা ছেড়ে কলকাতায় পদার্পণ মালকাজানের। সঙ্গে মেয়ে গহরজান ও সখা-সচিব-প্রেমিক খুরশেদ। সাল ১৮৮৩। কলুটোলার কাছে একটি পুরোনো বাড়িতে বাসা বাঁধলেন। অভিভাবক খুরশেদ একদিন নিহত হলেন। মা ও মেয়ের জীবনে নেমে এল অনিশ্চয়তা। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। একটি বিপদ থেকে জীবন সরে যায় অন্য প্রস্তুতির দিকে। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস অপেক্ষা করছে গহরজানের জন্য। ধীরে ধীরে কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতব্যাপী খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে গহরজানের।
কলুটোলার বাড়িতে কিছুদিন পর চলে এলেন মালকাজানের পুরোনো পরিচারিকা আশিয়া, তাঁর ছেলে ভাগলুকে নিয়ে। আশিয়া অত্যন্ত বিশ্বস্ত। অনেক বৈভবের মালিক মালকাজান এমন একজন বিশ্বস্ত পরিচারিকার ওপর নির্ভর করতে চাইছিলেন। কিছুদিন পর কেনা হল ৪৯ চিৎপুর রোডে, নাখোদা মসজিদের কাছে একটি বিলাসবহুল হর্ম্য। কলুটোলা ছেড়ে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হলেন সপরিবার মালকাজান। চিৎপুর রোডের বাড়ি মালকাজান ও গহরের অনেক সাফল্য ও গরিমার সাক্ষী। অনেক রাজা জমিদার বাবুদের উপস্থিতিতে ঝলমলে আসর বসেছে এই বাড়িতে। কলকাতা মা ও মেয়েকে প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি দিয়েছে। এই শহর ও বিভিন্ন রাজ্যে আসরের পর আসর মদির হয়ে উঠেছে তাঁদের সুরঝংকারে, নৃত্যের তালে। ক্লান্তি ও মদের নেশা বড়ি মালকাজানকে অত্যন্ত অসুস্থ করে তুললেও নেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। ১৯০৬ সালে পাড়ি দিলেন জগৎ সীমার ওপারে। মায়ের মৃত্যু গহরজানকে যেমন বেদনার্ত ও নিঃসঙ্গ করে, তেমনি অসহায় করেছিল। তবু জীবনের নিয়মেই চলতে থাকে তাঁর সংগীতের আসর, মুজরো, গ্রামাফোন কোম্পানির রেকর্ড। গহরজানের স্বীকৃতি ও ঐশ্বর্য বাড়তে থাকল। কিন্তু শত্রু তৈরি হলো বাড়ির ভেতরেই। মালকাজানের আশ্রিত ও পরমস্নেহে পালিত ভাগলুই আশিয়া ও মালকাজানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির লোভে গহরজানের জীবন ভয়াবহ রকম অতিষ্ঠ করে তুললেন। ভাগলুর দাখিল করা মিথ্যা মামলায় বিপর্যস্ত সংগীতসম্রাজ্ঞীর জীবন। নানা অপকৌশলে তিনি মালকাজান ও গহরজানের বিপুল সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে চায়। ১৯১০ সালে হাইকোর্টের শমন পান গহরজান। ভাগলুর অ্যাটর্নি জি. এন. দত্ত অ্যান্ড কোম্পানি। আদালতে পাগলুর আবেদন, তিনি মালকাজানের একমাত্র বৈধ সন্তান। ১৮৬৮ সালে তাঁর বাবা শেখ ওয়াজির ও মালকাজানের বিয়ে হয়। নর্তকীর পেশা গ্রহণের পর মালকাজান কিছুদিন একজন আর্মেনিয়ান সাহেবের রক্ষিতা ছিলেন। তাঁদের অবৈধ সন্তান গহরজান। আর্জিতে ভাগলু আরও জানান ১৯০৬ সালে মালকাজান মৃত্যুর সময় কোনো উইল করে যাননি। তাই একমাত্র বৈধ পুত্র হিসেবে আইনত সমস্ত বিষয় সম্পত্তির মালিক ভাগলু। স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির একটি তালিকাও ভাগলু আদালতে পেশ করেন।
গহরজানের অ্যাটর্নি গণেশ চন্দ্র চন্দ্র বুঝতে পারলেন একটি বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছে। মামলাটিও অত্যন্ত জটিল, কারণ মামলার কেন্দ্রে রয়েছে একজন দেহপসারিনীর জীবন, যে জীবন নিয়ে সহজেই বিতর্ক সৃষ্টি করা যায়। ইতোমধ্যে গহরজানের জীবনে নেমে আসে আরও বৈরিতার অভিজ্ঞতা। বাড়ির পুরোনো ম্যানেজার ওয়াজির হাসান, দারোয়ান দিল নারায়ণ গহরজানেরর বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত। পারিবারিক চিকিৎসক ও অত্যন্ত শুভানুধ্যায়ী ডাক্তার মাসুম এসব জানতে পেরে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন। ডাক্তার মাসুম গহরজনের জন্য একজন ম্যানেজার নির্বাচন ক’রে ভাবলেন এই ছেলেটি শিক্ষিত, মার্জিত ও দায়িত্বশীল— গহরজানকে সুরক্ষা দিতে পারবে। নাম সৈয়দ গোলাম আব্বাস। একজন পেশোয়ারি। গহরযানের পিতৃপরিচয় ও সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা জেতার জন্য ভাগলু অনেক মিথ্যা সাক্ষ্য, প্রমাণ জোগাড় করলেন। গণেশ চন্দ্র চন্দ্র এই স্মরণীয় মামলায় সমানতালে লড়ে গেলেন। আর নতুন ম্যানেজার আব্বাসও প্রচুর পরিশ্রম করে প্রকৃত সহকারীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এরই মধ্যে পেশাগত কারণে প্রচুর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয় গহরজানের। কলকাতার বাইরেও যেত হয়। বিখ্যাত সারেঙ্গি বাদক এনায়েৎ আলিকে নিয়ে গেলেন হায়দ্রাবাদের নিজামের বাড়ির সংগীতানুষ্ঠানে। সর্ষের মধ্যে ভূত প্রবাদের প্রতিফলন আমরা দেখব গহরজানের জীবনে। একদিন গোলাম আব্বাসকে বিশ্বাস করে প্রেমিকের মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি। তারপর সেই প্রেমিকের কাছ থেকে পেতে হল প্রবল প্রতারণা। মামলা চলতে থাকে বিচারপতি হ্যারি লাশিংটন স্টিফেনের এজলাসে। গহরজানকে দেখবার জন্য আদালতে ভিড় উপচে পড়ে। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব চলে কলকাতা থেকে আজমগড় পর্যন্ত। হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে আজমগড়ে কমিশনার নিযুক্ত হয় এবং সেখানে ১৯১১ সালের ১১ মে সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ হয়ে যায়। গহরজানের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন তাঁর জন্মদাতা পিতা রবার্ট ইওয়ার্ড। তিনি এলাহাবাদ থেকে এসে আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের পিতৃত্বের কথা ঘোষণা করেন। ১৯১১ সালের ১০ অগাস্ট বিচারপতি স্টিফেন ভাগলুর মামলা খারিজ করে দেন। গহরজানের জীবনের এই বেদনাবিধুর নাটক কলকাতা হাইকোর্টের ধূলিধূসরিত নথিপত্রে আজও মর্মরিত।
৪৯ চিৎপুর রোডের বাড়িতে বিরাট উৎসব হল মামলা জয়কে কেন্দ্র করে। এলেন কসাইটোলা, বউবাজার ও জানবাজারের সেরা বাইজিরা। এলেন প্রিয় বন্ধু, বাইজি বদরে মুনির চৌধুরান। সঙ্গে রেহানা সুলতানা, কাঞ্চনমালা, দুলারি বিবি প্রমুখ। কলকাতার বাবুসমাজের একটি বড় অংশ, অনেক গায়ক, বাদক, কয়েকজন দালালও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বিচারপতি স্টিফেনের রায়ের বিরুদ্ধে ভাগলু আপিল করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়। অন্যদিকে আব্বাসের প্রতি আকর্ষণের মোহ গহরজানকে অস্থির করে তোলে। তিনি তখন সমর্পিতপ্রাণ। কোনো চাতুর্য বিচার করার মানসিক অবস্থা তাঁর নেই। আব্বাসকে নিঃশর্তে বিশ্বাস করতে থাকেন। আব্বাস কথা দেন— আমি তোমার জীবন মরণের সাথী হয়ে থাকব। ইসলামি রীতি অনুযায়ী তাঁদের ‘মুতা’ বিবাহ হল। আব্বাসের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে গেলেন কলকাতা ছেড়ে বোম্বাই। এরপর ভাবাবেগে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন সংগীতসম্রাজ্ঞী। ৪৯ নম্বর চিৎপুর রোডের বহুস্মৃতিবিজড়িত বাড়ি আব্বাসের নামে দানপত্র করে দিলেন। আব্বাসের বাবা মেহেদি খান ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত। তিনি পুত্রকে নানা কুটিল ফন্দি শেখাতেন। ১৯১৪ সালের গোড়ার দিকে গহরজান ২২ নম্বর বেন্টিং স্ট্রিটের বাড়ি বিক্রি করে ৪৬ নম্বর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে একটি ছোটখাট বাড়ি কিনলেন। নিভৃত নির্জনতায় বাস করার জন্য। কিন্তু ভবিতব্য তাঁর জন্য অনেক সংকট নিয়ে অপেক্ষা করছিল। যে আব্বাসকে সামান্য কর্মচারী থেকে তিনি স্বামিত্বে বরণ করেছিলেন, তাঁর অর্থলোভী মন গহরজানের ঐশ্বর্য আত্মসাৎ করার কাজে তৎপর। ক্রমশ সব বুঝতে পারলেন গহরজান। তাঁর ব্যাংকের টাকা রহস্যজনকভাবে নিঃশেষ। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। মনোবেদনায় ক্ষতবিক্ষত।
গহরজান আবার নতুন করে বোম্বাই ও হায়দ্রাবাদে বিভিন্ন আসরে গাইতে শুরু করলেন। প্রায় ছ-মাস তিনি কলকাতার বাইরে, কিন্তু তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য প্রশমিত হলো না। প্রবাস থেকে তিনি যে চিঠিগুলি আব্বাসের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন তা প্রমাণ করে তাঁর মনের অস্থিরতা। কলকাতায় ফিরে আব্বাসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। চিৎপুর রোডের যে বাড়িটি দানপত্র করে দিয়েছিলেন, সেই দানপত্র প্রত্যাহার করতে চান। দু-বছর ধরে মামলা চলে। ১৯১৮ সালে আপোস-রফায় মামলার নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তির শর্তগুলি গহরজানের পক্ষে সন্তোষজনক না হলেও, আব্বাসের সঙ্গে সম্পর্কের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন ক’রে গহরজান ফিরে আসেন গানের জগতে। জীবন থেকে পাওয়া আঘাত-বেদনায় তিনি বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত। তিনি এখন নির্বাচিত কনসার্টে অংশগ্রহণ করেন। বেশি মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে না। ভগ্নহৃদয়ে সময় কাটে। গহরজানের সে সময় অর্থের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই হত। এরই মধ্যে গান্ধীজির আবেদনে সাড়া দিয়ে কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের প্রয়োজনে দান করলেন। কলকাতা গহরজানের রঙিন স্বপ্নের শহর, প্রিয় বাসভূমি। তবু একদিন কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন দেশের অন্যপ্রান্তে। ১৯২৮ সালে ডাক এল মহীশূর রাজদরবার থেকে। সভা-গায়িকার পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ। সম্মতি জানালেন গহরজান। কলকাতায় স্থায়ী বসবাসের অবসান ঘটল। জীবন তখন ব্যথাদীর্ণ। ভগ্নস্বাস্থ্য। ১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি মহীশূরে প্রয়াণ ঘটল ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর। একটি যুগের সমাপ্তি। গহরজান যে ঐতিহ্য ও সংগীতের ধারা প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, তা যাতে সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে লীন না হয়— সেই দায়িত্ব ভাবীকালের। সার্ধশতবর্ষে গহরজানের সৃষ্টি সংরক্ষণের প্রয়াসই হবে তাঁর প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা নিবেদন।
“তুমি কল্পনা করতে পারবেনা, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে” – ম্যাজিক রিয়েলিজম ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
দেবার্ঘ্য দাস
তুমি কল্পনা করতে পারবেনা, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে।” – শিশুর মনে এই কথাটি গভীরভাবে দাগ কাটে। গভীর কথাটা এক নাতি তার দাদু পাপালেও-এর থেকে শুনে পরবর্তী সময়ে এই নাতি নাকি ম্যাজিক রিয়েলিজমের ধারার অন্যতম বাহক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে! সেই নাতির নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ডাকনাম গ্যাবো। দাদুর সৈনিক জীবন থেকে পাওয়া এমন আরো অনেক উপলব্ধি পুনরাবৃত্তি হয়েছে মার্কেজের রচনায়।
বাস্তব কি? কাল্পনিক কি? যাদুকরী বাস্তববাদের জগতে, সাধারণটি অসাধারণ হয়ে ওঠে এবং যাদুকরটি সাধারণ হয়ে ওঠে যা “আশ্চর্যজনক বাস্তববাদ” বা “অসাধারণ বাস্তববাদ” নামেও পরিচিত, যাদুকরী বাস্তববাদ বাস্তবতার প্রকৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো একটি শৈলী বা ধারা নয়। বই, গল্প, কবিতা, নাটক এবং চলচ্চিত্রে বাস্তবিক বর্ণনা এবং দূরবর্তী কল্পনা একত্রিত হয়ে সমাজ এবং মানব প্রকৃতি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করে। “ম্যাজিক রিয়ালিজম” শব্দটি বাস্তবসম্মত এবং আলংকারিক শিল্পকর্মের সাথেও যুক্ত – চিত্রকর্ম, অঙ্কন এবং ভাস্কর্য – যা লুকানো অর্থ নির্দেশ করে।
মার্কেজ লিখবেন অমোঘ সেই লাইন -” মানুষ নাকি বুড়ো হয়ে যায় তাই স্বপ্ন দেখে না। ডাহা মিথ্যে কথা। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় তাই সে বুড়ো হয়ে যায়।”
মার্কেজের জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ই মার্চ, উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে। ফার্মাসিস্ট বাবার কাজের কারণে শৈশবে দাদু-দিদুনের কাছে মানুষ। গ্যাবোর দিদিমা ছিলেন একজন অসাধারণ গল্পবলিয়ে। অদ্ভূতুড়ে জিনিসকে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেন মনে হত তিনি তা চাক্ষুষ দেখেছেন। নানারকম ভূত-প্রেত, আত্মা, অলৌকিক বিষয়াদির বইয়ে ভর্তি ছিলো তাদের বাড়ি। গ্যাবো তার সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতার যে প্রকাশ করেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন এভাবেই, দিদুনের কাছে। দিদুনের এই গল্প বলার ধরণ তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই One Hundred Years of Solitude-কে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো বলে মনে করেন গ্যাবো।
গ্যাবোর দাদুও কিন্তু কম যান না! ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি লিবারেল পার্টির কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। স্বভাবতই তার শেখানোর পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন। তিনি শেখাতেন বিভিন্ন অভিধান থেকে, সার্কাসে নিয়ে যেতেন প্রতি বছর। গ্যাবো তার দাদুকে ডাকতেন ‘পাপালেও’ বলে। পাপালেও প্রায়ই একটা কথা বলতেন গ্যাবোকে-
‘তুমি কল্পনা করতে পারবে না, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে!’
ফ্লোরেসের মতে, জাদুবাস্তবতা শুরু হয়েছিল আর্জেন্টাইন লেখক জর্জ লুইস বোর্হেসের (১৮৯৯-১৯৮৬)একটি ১৯৩৫ সালের গল্প দিয়ে। অন্যান্য সমালোচকরা আন্দোলন শুরু করার জন্য বিভিন্ন লেখককে কৃতিত্ব দিয়েছেন। যাইহোক, বোর্হেস অবশ্যই ল্যাটিন আমেরিকান জাদুবাস্তবতার ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেছিলেন, যা কাফকার মতো ইউরোপীয় লেখকদের কাজ থেকে অনন্য এবং স্বতন্ত্র হিসাবে দেখা হয়েছিল। এই ঐতিহ্যের অন্যান্য হিস্পানিক লেখকদের মধ্যে রয়েছে ইসাবেল অ্যালেন্ডে, মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল আস্তুরিয়াস, লরা এসকুইভেল, এলেনা গ্যারো, রোমুলো গ্যালেগোস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং জুয়ান রুলফো।সাহিত্যে, যাদু বাস্তবতা দৃশ্য শিল্পীদের শান্তভাবে রহস্যময় যাদু বাস্তবতা ছাড়াও একটি পৃথক আন্দোলন হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। কিউবান লেখক আলেজো কার্পেন্টিয়ার (১৯০৪-১৯৮০) “লো রিয়েল ম্যারাভিলোসো”(“আশ্চর্যজনক বাস্তব”) ধারণাটি চালু করেছিলেন যখন তিনি তার ১৯৪৯ সালের প্রবন্ধ “স্প্যানিশ আমেরিকায় মার্ভেলাস রিয়েল” প্রকাশ করেছিলেন। কার্পেন্টিয়ার বিশ্বাস করতেন যে লাতিন আমেরিকা, তার নাটকীয় ইতিহাস এবং ভূগোল সহ, বিশ্বের চোখে চমত্কার একটি আভা নিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে, সাহিত্য সমালোচক অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেস (১৯০০-১৯৯২) যাদু বাস্তববাদ শব্দটি গ্রহণ করেছিলেন (যাদু বাস্তববাদের বিপরীতে) ) লাতিন আমেরিকান লেখকদের লেখার বর্ণনা দিতে যারা “সাধারণ এবং প্রতিদিনকে ভয়ঙ্কর এবং অবাস্তবকে” রূপান্তরিত করেছে।
‘গ্যাবো’ কিংবা পরিণত বয়েসে গ্যাব্র্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তী ফ্রানৎজ কাফকার বিশেষ অনুরাগী ছিল। ১৯৪৭ সালে গ্যাবো ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া’য় আইনে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছায়। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় কাফকার সাহিত্যের সাথে, ‘লা মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’-এর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু না, কাফকার লেখার ধরণ তাকে আন্দোলিত করে, যেন শৈশবের দাদু-দিদার কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো ফিরে আসে তার কাছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অগণিত পাঠক আর সাহিত্যবোদ্ধাদের মত মার্কেজও আন্দোলিত হয়েছিলেন মেটামরফোসিসের প্রথম বাক্যটি পড়ে:
“ঘুম থেকে উঠে গ্রেগস সামসা দেখলো – সে পোঁকা হয়ে গেছে!”
আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি মার্কেজ। ভর্তি হওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কলম্বিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং তার পেনশনের কার্ডটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে তিনি চলে যান ‘ইউনিভার্সিটি অব কার্টেগানা’য়। সেখানে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ‘এল ইউনিভার্সাল’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতায় এতোটাই ঝুঁকে পড়েন যে, পাশ করবার আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চলে যান বারাঙ্কুইলিয়া শহরে, ‘এল হেরাল্ডো’ পত্রিকার সাংবাদিক হয়ে। তার প্রথম বড় কাজ, The Story of a Shipwrecked Sailor। মূলত ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার জন্য লেখাটি মোট চৌদ্দ কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কলম্বিয়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। সে জাহাজের একজন নাবিক ছিলেন লুইস আলেজান্দ্রো ভ্যালেসকো। সাগরের বুকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম লেখাটির মূল উপজীব্য। মার্কেজ পুরো উপাখ্যানটি লিখেছিলেন উত্তম পুরুষে এবং বেনামে! লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিলো নাবিক ভ্যালেসকোর সাক্ষর নিয়ে। পরে ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে লেখাটি প্রকাশিত হলে তাতে গ্যাবোর নাম দেখা যায়। এটি মূলত তার সাংবাদিক জীবনের কাজ, সাহিত্যিক কিংবা ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি তা লেখেননি। তিনি ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার হয়ে ভ্যালেসকোর সাক্ষাৎকার নেন এবং তার পরবর্তীতে উত্তম পুরুষে পুনর্লিখন করেন। বইটি প্রসঙ্গে গ্যাবো বলেন, One Hundred Years of Solitude লেখার পূর্বে কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সমালোচক লেখাটিকে দামই দেননি!
The Story of a Shipwrecked Sailor লেখাটি ১৯৫৫-তে প্রথম প্রকাশের পর মার্কেজ তৎকালীন জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়া সরকারের চক্ষুশূল হন এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তখন তিনি বেশ কিছু বছর রোম, প্যারিস, বার্সেলোনাসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
One Hundred Years of Solitude গার্সিয়া মার্কেজের শ্রেষ্ঠ রচনা। মূলত এ উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। এ বইটি লেখার পেছনের গল্পটি ভারি চমৎকার। আঠারো বছর বয়সে গ্যাবোর ইচ্ছে হয় তার শৈশবের নানা বাড়ি এবং সেই মানুষজন-আসেপাশের অনুসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু কলমে লেখা আসছিলো না ঠিক যেমনটি তিনি চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেক বছর বাদে, তিনি তার পরিবার নিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন গাড়ি করে। হঠাৎ তাঁর মনে হয় সেই সঠিক সময়টি এসে পড়েছে, তিনি হয়তো পেয়ে গেছেন তার লেখার সকল উপজীব্য আর ঢঙ। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসেন এবং লিখতে বসেন। তিনি এতোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেয়েছিলেন যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং পরিবারের খরচ মেটাবার জন্য গাড়িটি বিক্রি করে দেন।যদিও তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিলো উপন্যাসটি শেষ করতে। টানা আটারো মাস লেখার পর ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বইটি বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়নেরও অধিক কপি এবং অনুবাদিত হয়েছে ৩৭ ভাষায়। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এমন আর কোনো বই দেখা যায়নি যা প্রকাশের পরপরই পাঠকপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলো, সাথে সাথে অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলো ক্রিটিকদের দ্বারা। বাংলায় বইটির অনুবাদ করেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মজার বিষয় এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে ; মার্কেজের নোবেল প্রাইজ পাবার আগেই তার দেশ শহর থেকে দূরে ভারতের কলকাতা শহরে এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের সিলেবাসে মার্কেজের One Hundred Years of Solitude বইটি ততদিনে পড়ানো শুরু হয়ে গেছে।
মার্কেজ তার শৈশবের শহরের আদলে তৈরি করেছিলেন একটি শহর ‘মাকোন্দো’। সেই শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্ম নিয়ে তৈরি হয় গল্পের কাঠামো। শুরুতে আমাদের সামনে আসে জোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া আর তার স্ত্রী উরসুলা ইগোরান। তারা ঠিক করেছিলেন কলম্বিয়া ছেড়ে যাবেন নতুন আবাসের খোঁজে। পথে এক নদীর ধারে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন তারা এবং জোসে এক অদ্ভূত শহর ‘মাকোন্দো’ স্বপ্নে দেখেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্থির করেন, নদীর তীরেই তিনি তৈরি করবেন সেই শহরটি। এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী। ইতিহাস, সংস্কার – কুসংস্কার, বাস্তব – অবাস্তব – কল্পনা, যৌনাতা – অযাচার, ফ্যান্টিসি আর পরাবাস্তব জগতের এমন মিশেল পাঠক এবং সাহিত্যবোদ্ধা দুইকেই নিয়ে যায় উপলব্ধির চূড়ায়।অনেক সাহিত্যসমালোচক মনে করেন, One Hundred Years of Solitude এর পর Love in the Time of Cholera বা ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ মার্কেজের সেরা কাজ। বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে স্প্যানিশে এবং ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় তার তিন বছর পর। বইটি থেকে ২০০৭ সালে মুভি অ্যাডাপশান করা হয় একই নামে। মার্কেজ বলেছেন, এ গল্পেরও সূচনা তার ব্যক্তি জীবনে। মূলত তার বাবা-মায়ের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন বইটি। এ উপন্যাসটি ছাড়াও মার্কেজের অন্যান্য উপন্যাস এবং ছোটগল্প থেকে থিয়েটার এবং ফিল্মে অ্যাডাপশন হয়েছে বহুবার। এমনকি The Blue Lobster এর পরিচালক ছিলেন স্বয়ং মার্কেজ।
তবে গ্যাবো মনে করেন, The Autumn of the Patriarch তাঁর সেরা কাজ। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ পায় বইটি।
ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড প্রকাশের পরপরই , গার্সিয়া মার্কেজ এল ডিস্তানসিয়া দেল প্যাট্রিয়ার্ক (১৯৭৫; দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক , ১৯৭৬) লেখার জন্য বার্সেলোনায় চলে আসেন। একটি প্রোটোটাইপিক্যাল ল্যাটিন আমেরিকান স্বৈরশাসকের এই প্রতিকৃতিটি কাব্যিক ভাষা এবং সাহিত্যিক কৌশল ব্যবহারে একটি সাহসী পরীক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে, যা আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে কেন এটি প্রায়শই লেখকের আজ পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসাবে বিবেচিত হয়। উপন্যাসটি কেবল কলম্বিয়ায় নয়, সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অবিচারের নিন্দা করার জন্য লেখকের গভীর আগ্রহের উদাহরণও । নায়ক স্বৈরাচারের সমস্ত মন্দকে মূর্ত করে, কিন্তু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল তার উপর যে নিরঙ্কুশ শক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয় তার নিঃসঙ্গতা। এর পূর্বসূরির মতো, দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক হাস্যরস এবং ফ্যান্টাসি দিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে এর বিচরণ শৈলী এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এটি পাঠকের কাছে আরও বেশি দাবি করে তোলে।
এ উপন্যাসে তিনি বর্ণনা করেছেন এক ক্যারিবিয় একনায়কের কথা। সসমালোচকদের মত, এ স্বৈরশাসককে কলম্বিয়ার কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়ার আদলে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন মার্কেজ, যার কারণে বাধ্য হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয় মার্কেজকে।
লাতিন আমেরিকায় সামাজিক অবিচারের শিকড় বিশ্লেষণ করার গার্সিয়া মার্কেজের ইচ্ছাকে অব্যাহত রেখে , তার পরবর্তী উপন্যাস অযৌক্তিক সহিংসতা এবং অন্যায় হত্যার একটি অধ্যয়ন উপস্থাপন করে। ক্রনিকল অফ এ ডেথ ফোরটোল্ড (১৯৮১; ক্রনিকল অফ এ ডেথ ফোরটোল্ড , ১৯৮২) সান্তিয়াগো নাসারকে হত্যার সাক্ষীদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে, তার বিয়ের আগে অ্যাঞ্জেলা ভিকারিওকে প্রলুব্ধ করার জন্য অভিযুক্ত যুবক। যখন, তার বিয়ের রাতে, অ্যাঞ্জেলার স্বামী আবিষ্কার করেন যে তিনি কুমারী নন, তখন তিনি তাকে তার পিতামাতার কাছে ফিরিয়ে দেন। পরের দিন সকালে, তার যমজ ভাই নাসারকে তাদের বাড়ির দরজায় হত্যা করে। সাংবাদিকতা এবং গোয়েন্দা গল্পের একটি উত্তেজনাপূর্ণ মিলন, উপন্যাসটি কেবল ক্যাথলিক চার্চকেই নয়, শহরের নাগরিকদের দ্বারা অনুমোদিত আদিম কোডেরও নিন্দা করে।
কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন গ্যাবো। ছিলেন কলম্বিয়ার বামঘেষা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এই অভিযোগে বহুবছর যাবৎ তাকে ভিসা দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেষে বিল ক্লিনটন প্রশাসন নব্বইয়ের দশকে মার্কেজের উপর থেকে এই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ক্লিনটন মার্কেজের লেখার একজন একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন। কৈশোরের উচ্ছাসপূর্ণ দিনগুলোতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও সঙ্গী হতো মার্কেজের বই।
মার্কেজের মার্কেজ হয়ে ওঠার পেছনে একটা বড় নিয়ামক তার ছোটগল্পগুলো। জাদু বাস্তবতার যে বিস্তর প্রয়োগ তিনি উপন্যাসে করেছেন, ছোটগল্পে অতোটা করেননি কিংবা বলা যায়, ছোটগল্পে সেভাবে করার সুযোগ হয়নি। তিনি বলতেন এভাবে,
“ছোটগল্প হলো আর্চার বোর্ডে নিশানা করা আর ঠিক সময় ঠিক জায়গায় আঘাত করা এবং উপন্যাস হলো বিশাল দূর্গম কোনো বনে একটা খরগোশের খোঁজ করতে থাকা।”
1975 সালে, স্বৈরশাসক অগাস্টিন পিনোচেট চিলিতে ক্ষমতায় আসেন, এবং গার্সিয়া মার্কেজ শপথ করেছিলেন যে পিনোচেট চলে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি আর কোনও উপন্যাস লিখবেন না। পিনোশেকে 17 বছর ধরে ক্ষমতায় থাকতে হয়েছিল, এবং 1981 সালের মধ্যে, গার্সিয়া মার্কেজ বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি পিনোচেটকে তাকে সেন্সর করার অনুমতি দিচ্ছেন।
“ক্রনিকল অফ এ ডেথ ফরটোল্ড” 1981 সালে প্রকাশিত হয়েছিল, তার শৈশবের এক বন্ধুর একটি ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পুনরুক্তি। নায়ক, একজন ধনী বণিকের “আনন্দময় এবং শান্তিপ্রিয়, এবং খোলা মনের” ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়; পুরো শহর আগে থেকেই জানে এবং এটি প্রতিরোধ করতে পারে না (বা করবে না), যদিও শহরটি সত্যিই মনে করে না যে সে যে অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে তার জন্য সে দোষী: কাজ করতে অক্ষমতার প্লেগ।
1986 সালে, “লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা” প্রকাশিত হয়েছিল, দুই তারকা-ক্রসড প্রেমিকের একটি রোমান্টিক আখ্যান যারা 50 বছরেরও বেশি সময় ধরে মিলিত হয় কিন্তু আবার সংযোগ করে না। শিরোনামে কলেরা রোগ এবং যুদ্ধের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া রাগ উভয়কেই বোঝায়। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বইটির পর্যালোচনা করে টমাস পিনচন “লেখার সুইং এবং ট্রান্সলুসেন্সি, এর স্ল্যাং এবং এর ক্লাসিকিজম, লিরিক্যাল স্ট্রেচ এবং সেই শেষ-অফ-সেন্টেন্স জিঙ্গার” এর প্রশংসা করেছেন।
“Reality is also the myths of the common people. I realized that reality isn’t just the police that kill people, but also everything that forms part of the life of the common people.”
মার্কেজের Memorias de mis putas tristes (2004; Memories of My Melancholy Whores , 2005) ছিল দশ বছরে প্রদর্শিত তার প্রথম কাল্পনিক কাজ। উপন্যাসটি এক অদ্ভুত, নির্জন বৃদ্ধের গল্প বলে যে তার নব্বই বছর উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয় নিজেকে একটি পতিতালয়ে একটি যুবতী কুমারীর সাথে একটি রাতের উপহার দিয়ে। একবার তার সাথে দেখা হলে সে নিজেকে বৃদ্ধ বয়সে নয়, বরং ভালোবাসার কাছে মৃত্যুর কাছাকাছি দেখতে পায়। উপন্যাসটি তার যৌন দুঃসাহসিক কাজগুলি বর্ণনা করে, যার জন্য তিনি সর্বদা অর্থ প্রদান করতেন, কখনও কল্পনাও করেননি যে এইভাবে তিনি সত্যিকারের ভালবাসা আবিষ্কার করবেন।
তার বিস্তৃত সাহিত্যের ক্যানভাসে পৌরাণিক কাহিনী এবং ফ্যান্টাসি দ্বারা সজ্জিত, গার্সিয়া মার্কেজ সমসাময়িক উপন্যাসটিকে তার যুক্তির কঠোর আইন থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তার সমগ্রতায়, তার রচনা একটি অনুন্নত, দ্বন্দ্ব-বিধ্বস্ত মহাদেশের কঠোর বাস্তবতাকে চিত্রিত করে যা নিরবচ্ছিন্ন কল্পনা এবং নান্দনিক উপলব্ধির মানবতাবাদী উপাদান দ্বারা সর্বজনীন। গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত কথাসাহিত্যিকদের একজন। তার অসামান্য উদ্যোগের শেষ ফলাফল মানব অভিজ্ঞতার একটি আসল, ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি।
১৯৯৯ সালে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিম্ফোমা রোগে আক্রান্ত হন, কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত লিখতে থাকেন, যখন “মেমোরিজ অফ মাই মেল্যাঙ্কলি হুরেস”-এর পর্যালোচনাগুলি মিশ্রিত হয়—এটি ইরানে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর পরে, তিনি ধীরে ধীরে ডিমেনশিয়ায় ডুবে যান, মেক্সিকো সিটিতে ১৭ এপ্রিল, ২০১৪-এ তিনি এই পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চলে গেলেও আমাদের চারপাশের এই এই বাস্তবতার জঙ্গলে ম্যাজিক রিয়েলিজম জাদুর দুনিয়ায় তিনি আজীবন থাকবেন প্রবহমান হয়ে।
তথ্যসুত্র :
www.theparisreview.org/interviews/3196/the-art-of-fiction-no-69-gabriel-garcia-marquez
Del Barco, Mandalit. “Writer Gabriel Garcia Marquez, Who Gave Voice to Latin America, Dies.” National Public Radio April 17, 2014. Print.
Fetters, Ashley. “The Origins of Gabriel Garcia Marquez’s Magic Realism.” The Atlantic April 17 2014. Print.
Kandell, Jonathan. “Gabriel García Márquez, Conjurer of Literary Magic, Dies at 87.” The New York Times April 17, 2014. Print.
Kennedy, William. “The Yellow Trolley Car in Barcelona, and Other Visions.” The Atlantic January 1973. Print.
Kiely, Robert. “Memory and Prophecy, Illusion and Reality Are Mixed and Made to Look the Same.” The New York March 8, 1970. Print. Times
১৫০ বছরেও “নিউ”- মার্কেট
গৌরব রায়
কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ব্রিটিশদের জন্য কোনও বাজার ছিল না।
তথাকথিত white town অর্থাৎ ব্রিটিশরা থাকবে ডালহৌসি এলাকায় একটি বাজার এবং নিকটবর্তী এলাকায় টেরিটিবাজার থাকলেও টার আশেপাশের এলাকায় ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের বহু মানুষ বসবাস করতেন।সেই কারণে ব্রিটিশদের সেখানে যেতে অনীহা ছিল।
তবে ধর্মতলায় তেমনি একটা বড় আকারের বাজার ছিল ধর্মতলা মার্কেট। এর মালিক ছিলেন হীরালাল শীল। সরকার জনসধারনের দাবি অনুসারে সেই বাজার অধিগ্রহণ করবার প্রস্তাব দিল বাজারের মালিক কে।বাজার সমস্যার সমাধান করতে ১৮৭১ সালে তৈরি হল ‘ক্যালকাটা মার্কেট অ্যাক্ট’। বর্তমানে লিন্ডসে স্ট্রিট এলাকায় ফ্রেনউইকস বাজার নামে একটি ছোট বাজার থাকলেও সেই বাজারে অনেক কিছুই পাওয়া যেত না।১৮৭১ সালে নতুন বাজার তৈরির প্রস্তাব পাশ হয়।
স্যার স্টূয়ার্ট সন্ডার্স হগ সেই সময় কলকাতার পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। স্টূয়ার্ট হগ ভারতে আসেন বর্ধমানের কালেকটর হয়ে।সেখানে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি সুষ্ঠু ত্রানের ব্যবস্থা করে প্রসংশা লাভ করেন।তাকেই কলকাতা শহরের প্রথম রুপকার বলা যেতে পারে।কলকাতার বুকে পানীয় জলের সুব্যবস্থা,ভূগর্ভস্থ পয়প্রনালি ও রাস্তায় আলোর রুপায়ন তার পরিকল্পনায় হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ১৮৭৪ সালে এই বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।এটিই কলকাতার প্রথম মিউনিপ্যাল মার্কেট।
প্রায় ১৫০ বছর ধরে কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের প্রতীক এই নিউমারকেত।এশিয়ার তৃতীয় সবচেয়ে বড় ওপেন এয়ার মার্কেট হল এই নিউমার্কেট ।
এই বাজারের নকশার জন্যে আহ্বান করা প্রতিযোগিতায় জিতে নগদ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়েয় স্থপতি রিচার্ড রেস্কেল বেন।অনেকে টাই নিউমার্কেট এর মধ্যে ভিক্টোরীয় স্টেশনের আদল পান।মার্কেট কমপ্লেক্স নির্মাণের দায়িত্ত্ব দেওয়া হয় ম্যাকিন্টোশ কোম্পানিকে।জমি সহ খরচ হয়েছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকার মত।বেন সাহেবের নকশায় বাজার সেজে উঠল লাল ও হলুদের ইটের দেওয়ালে গড়া গথিক শৈলীর সাথে মানানসই উপাদানে অলংকৃত সম্মুখভাগ,খড়খড়ি দেওয়া খিলানযুক্ত জানলা,টালি বসানো ঢালু ছাদ স্তম্ভযুক্ত ওয়াকওয়ে,ছাদের সম্প্রসারিত অংশ ধরে রাখার জন্যে সুদৃশ্য ব্র্যাকেট,দীর্ঘ স্পায়ার এর মাথায় বহুকৌণিক তারা। সামনে ছিল ফোয়ারা সমেত সাহেবি বাগান,কেনাকাটার মাঝে জিরনোর বেঞ্চ।
১৮৯৬ এ পুরসভার জন্য মঞ্জর হওয়া প্রতীক ও নীতিবাক্য বসল স্থাপত্যের গায়ে-শহরের আবর্জনা পরিস্কারে ভুমিকা মনে রেখে দুটি হাড়গিলা পাখি,তাদের ঠোঁটে ধরা সাপ।আর ব্রিটিশ রাজমুকুট কতৃত্বের চিহ্ন।সঙ্গে ল্যাটিনে লেখা ‘পের আরডুয়া স্টাবিলিস এস্টো”- সঙ্কটে অবিচল থাকো।
পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে বাজার স্থাপনের মূল উদ্যোগী স্যার স্টূয়ার্ট হগ এর নামে ১৯০৩ সালে হগ মার্কেট নাম রাখা হয়।নাম পরিবর্তন হলেও এই বাজার নিউ মার্কেট নামেই জনপ্রিয়।নিউমার্কেট বাজার তৈরির সময় ইংল্যান্ডের হাডার্সফিল্ড থেকে একটা বিশালাকার ঘড়ি আনা হয়েছিল,যা আজও নিউমার্কেট এর উঁচু ঘড়ি মিনারে দেখতে পাওয়া যায়।তবে দশ বছর আগে থমকে যায় এই ক্লক টাওয়ারের কাঁটা।তবে এবার ১৫০ বছরে সংস্কার শুরু হয়েছে নিউমার্কেট এ।এই বছর থেকে আবার ধর্মতলা চত্বরে বেজে উঠবে সেই পুরনো ঘণ্টার শব্দ।এই ঐতিহ্যকে স্মরণীয় করে রাখতে ভারত সরকারের ডাক বিভাগের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ডাকটিকিট প্রকাশের আবেদন করেছে কলকাতা পৌরনিগম।
নিউমার্কেট এ বর্তমানে দু হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে।রসিকতা করে অনেকে বলেন বাঘের দুধ,জলহস্তির মাংসও নাকি চাইলে নিউমার্কেট এ মেলে(সত্যজিত রায়ের মহাপুরুষ ছবির সংলাপ)। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এর মত সব জিনিসই এই বাজারে পাবেন ন্যায্য দামে।জুতো জামা শাড়ি খেলনা খাবার ঘর সাজাবার জিনিস মশলা পাতি,এমনকি নকল পরচুলা এখানে পাওয়া যায়।বাজারের ভেতরে পসরার পাশাপাশি ফুটপাথেও জিনিস বিক্রি হয়।এছাড়াও আরও অসংখ্য দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিউ মার্কেট এ।কিন্তু বর্তমান ঝাঁ চকচকে শপিং মলের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে একটু পিছিয়ে পরছে নিউমার্কেট।
নিউমার্কেট এ রয়েছে কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ খাওয়ার জায়গা।১৯০২ সালে এখানে শুরু হয় নাহউম অ্যান্ড সন্স।সেই বিখ্যাত কেকের দোকান এখনও একই জনপ্রিয় সবার কাছে।এছাড়া কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত রোল খেতে চাইলে ঢুঁ মারতে পারেন ‘নিজাম’ এ।এছাড়া রয়েছে আমিনিয়া ও আরও অনেক ফুড জয়েন্ট যেমন দ্য স্কুপ,জিমিস কিচেন, আহেলি,বান থাই। এছাড়া এই চত্বরে রয়েছে অবেরয় গ্র্যান্ড হোটেল।১৯১১ সালে মিসেস মঙ্ক এর এই বোর্ডিং হাউসটি কিনে আরাথুন স্তিফেন সেটিকে মেরামত করে একটি আধুনিক হোটেল এর রূপ দেন।এরপর ১৯৩৯ এ স্টীফেন মারা যাওয়ার পর মোহন সিং অবেরয় এটিকে পুনরায় চালু করেন.১৯৪৩ সালে তাঁর হাতেই স্বত্ব হস্তান্তর হয়।নিও ক্লাসিকাল স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি এই হোটেল আজও এই শহরের প্রাণ।
নিউমার্কেট চত্বরে লাইট হাউস,গ্লোব,এলিট,চ্যাপলিন,টিগার,রক্সি,ক্রাউন,প্যারাডাইস,লোটাস,অপেরা শো হাউস,সোসাইটি
ম্যাজেস্টীক,মেট্রো অনেক সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল ছিল।এরমধ্যে বেসিরভাগ হল এখন বন্ধ। মেট্রো এখন শপিং মল হয়েছে সাথে মালটিপ্লেক্স।নিউ এম্পায়ার কোনরকমে চলছে। প্যারাডাইস এ দোকান ভাড়া দিয়েছে।রক্সি এর মত ঐতিহ্যবাহী হল ও দীর্ঘদিনের লড়াই পেরিয়ে শহরের ইতিহাস প্রেমী মানুষের দাবিতে ও পৌরসভার হস্তক্ষেপে রূপটানের পরিকল্পনা হয়েছে।আগামীদিনে এখানে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে থিয়েটার হল ও শপিংকমপ্লেক্স গড়ে উঠবে।বাকি সিনেমা হল এর অপর পর্দা নেমে গেছে অনেকদিন আগেই।
দু দুটো বিশ্ব যুদ্ধ,দেশভাগের মত সঙ্কট পেরিয়েও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিউমার্কেট।একুশ শতকের নাগরিক চাহিদা মিলেনিয়ালসদের শপিং মল,হ্যাংআউট ক্যাফে কালচার এর চাপে একটু জৌলুস কমলেও এখনও নিউমার্কেট টেক্কা দেবে অনেক শপিং মলকে। কলকাতার এই প্রিয় বাজারের সংস্কারের দাবি উঠেছিল অনেক দিন থেকেই।সেই কাজে হাত দিয়েছে পৌরসভা।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় শুরু হয়েছে নিউমার্কেট এর মেকওভারের কাজ।আগামীদিনে আমরা নতুন রুপে দেখতে পাবো নিউমার্কেট কে।
এই মহানগরের চৌরঙ্গিতে তখন কি আবার খুলে যাবে সাজাহান হোটেল।
স্যাটা বোস কি আবার ফিরে আসবে এই শহরের উপকথায়।
রাম কাহিনী
নিরুপম চ্যাটার্জি
রামের নাম বর্তমান ভারতের পুণ্য ভূমিতে বহু চর্চিত । সুতরাং সকলেরই রাম নাম স্মরণ করা সময় উপস্থিত — ভয়ে অথবা ভক্তিতে । কিছুদিন পূর্বে দূরদর্শনের এক আলোচনা চক্রে এক বিশিষ্ট বক্তার ক্ষোভ প্রকাশ শুনলাম । তিনি বঙ্গবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন শ্রী রামের নাম বাংলার আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের কতখানি কাছাকাছি ছিল সে কথা পাপ বিদ্ধ বঙ্গসমাজ অধুনা বিস্মৃত । বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যখন একথা উচ্চারণ করেন তখন সে উক্তি যে উপেক্ষাযোগ্য হতে পারে এ ভাবাই যায় না । স্বয়ং শেক্সপিয়ার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে “Honourab। e Man” – দের কথা সর্বদাই প্রণিধান যোগ্য । অতএব একদা বাংলার হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা রাম মাহাত্ম্য নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক ।
যে সালটিতে বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতা ভাগ্য পরবর্তী প্রায় ২০০ বছরের জন্য ইউরোপের একটি ছোট্ট দ্বীপের অধিবাসী গনের পায় সমর্পিত হল সেই সন্ধিক্ষণেই যে কৃতি রামের আবির্ভাব ঘটেছিল অবিভক্ত বাংলাদেশের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়– তিনি রাম রাম বসু । কৃতবিদ্য মানুষটি সম্ভবত বাংলা গদ্যের প্রথম মৌলিক রচনা কার । তার জন্ম সাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে । রামরাম বসু অষ্টাদশ শতকের এক বর্ণময় চরিত্র । তার মনীষা বাংলার নবজাগরণের সহায়ক হয়েছিল । সুলেখক শ্রী প্রমথনাথ বিশীর বিশ্লেষণে রাম বসু ছিলেন জ্ঞান পূজারী, জ্ঞানের লহরী তার হৃদয়ে যে দোলা দিয়েছিল, তার অভিঘাতে ব্যক্তি জীবনের ঝড় ঝাপটা সামলে জ্ঞান সমুদ্রে তাঁর জাহাজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছিল ।
সেকালের যেসব পাদ্রীরা রামরাম বসুর মধ্যে সোনার খনির সন্ধান পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম কেরি সর্বাগ্রগণ্য । পূর্বেই বলেছি রামরাম বসুর অন্তর স্থিত স্বর্ণ খনির সন্ধান পেয়েছিলেন পাদ্রি ও বাংলা ভাষার অন্যতম রূপকার উইলিয়াম কেরি, কিন্তু সোনা খনিতে আবদ্ধ থাকলে সাধারণের কাছে তার দাম নির্ধারিত হয় না । খনি হতে উত্তলিত ঘষা মাজা খাঁটি সোনার স্বর্ণ শিল্পীর হাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ।
অলংকারের দ্যুতি কালচক্রের ধ্বংস লীলাকে উপহাস করে সগর্বে সিন্দুকে অথবা মনুষ্যদেহে বিরাজ করে । কেরি ছিলেন সেই স্বর্ণ শিল্পি যার সান্নিধ্যে রাম বসুর স্বর্ণ মনন দ্যুতিময় অলংকারে রূপান্তরিত হয়েছিল । ২শ বছরের ও বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এই অলংকারের প্রভা বহন করে চলেছে ।
১৭৯৩ সনে রাম রাম বসু পাদ্রী উইলিয়াম কেরি র মুন্সি নিযুক্ত হন । উইলিয়াম কেরির বাংলা ভাষায় বাইবেল প্রচার এর উৎসাহ রাম বসুকেও অনুপ্রাণিত করে । কেরির উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশীয় মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহনে উৎসাহিত করা । সহজাত বোধে উইলিয়াম কেরি অনুধাবন করেছিলেন যে দেশীয় ভাষায় বাইবেল তর্জমা না হলে দেশীয় সমাজের সাধারণ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মের মহিমার প্রতি কোনভাবেই আকৃষ্ট হবে না । তাঁর জন্মগত প্রতিভা তাকে প্রথমেই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কোন কাজে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা কতখানি। যে সমাজের অন্তস্থলে দাঁড়িয়ে কেরি তার লক্ষ্য পূরণ করতে সচেষ্ট ছিলেন সেই লক্ষ্য পূরণে বাংলা ভাষার বিকাশ ও বিস্তার অত্যন্ত জরুরি একথা বুঝতে তার মোটেই দেরি হয়নি। কেরি সাহেবের মুন্সি হওয়া সত্বেও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের থেকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিস্তার ও বিকাশ রাম বসুর উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে । উইলিয়াম কেরির জ্ঞান পিপাসা ও কর্মনিষ্ঠা রামরাম বসুর মনেও সঞ্চারিত হয়।
১৮০১ সালে রাম বসুর লেখা “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্” জুলাই মাসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় । এই গদ্য রচনাটি -ই বাংলার প্রথম মৌলিক গদ্য রচনা রূপে অনুমিত হয় । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় পন্ডিতের পদে কর্মরত রাম বসু অনুবাদ ও মৌলিক সাহিত্য রচনায় নিমগ্ন হন । এই মহাবিদ্যালয় টি তার মত জ্ঞান তাপসের সাধনা ক্ষেত্র হয়ে ওঠে । মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের মতো পন্ডিত ব্যক্তির প্রশংসা তাঁর সাধনাকে গাঢ়তর করে তোলে ।
লোকমুখে প্রকাশ রামবসু বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর । বোধ হয় সেই কারণেই যশোররাজ রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত ইতিহাস ও লোকশ্রুতি একই সাথে প্রতাপাদিত্যচরিত বইটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন । লিপিমালা নামক আরো একটি গ্রন্থ তাঁর বাংলা সাহিত্যকীর অন্তর্গত । গসপেল মেসেঞ্জার এর অনুবাদের ফসল হরকরা নামে একটি দীর্ঘ কাব্যগ্রন্থ ও কিছু খ্রিস্টীয় সংগীত রচনায় তার কাব্য প্রতিভার নমুনা পাওয়া যায় ।
ঘোর তমসাবৃত অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যে কয়টি রূপোলি বিদ্যুৎ রেখা বাংলার নব্যযুগের চেতনাকে সাকার করে তুলেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম রামরাম বসু । তাঁর প্রখর যুক্তিবোধ ও শ্লেষ মিশ্রিত ব্যঙ্গ; সন্তান বিসর্জন সহমরণ ও কৌলিন্য প্রথা শৃঙ্খলিত , ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গৌরবে গৌরবান্বিত বঙ্গ সমাজের দেহে সজোরে কসাঘাত করেছিল । রামমোহনের আগেই অল্প সংখ্যক ব্যক্তি সহমরণের বিরুদ্ধে নিজেদের আপত্তির কথা জানাতে শুরু করেছিলেন। সহমরণ প্রথা যে মোটেই শাস্ত্রের বাধ্যতামূলক বিধান নয়, সর্বোপরি অমানবিক, সে ভাবনা “বসুযা” তাঁর সহজাত যুক্তি ও মানবিক বোধেই ভাবতে শুরু করেছিলেন। সতীদাহের বিরুদ্ধে তিনি মতবাদ সংগঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন । যদিও সামান্য কজন পন্ডিত বাদ দিলে প্রায় কেউই তাঁর মতবাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি । তৎকালীন সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের অমানবিক উদাসীন আচরণ তাঁর হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছিল যা মৃত্যু অবধি তাকে পীড়া দিয়েছে। সম্ভবত তাঁর কোন নিকটজনকে সহমরনের মতো পাশবিক প্রথার গ্রাস হতে তিনি রক্ষা করতে পারেননি । এই মর্মান্তিক খেদ তাঁর আমৃত্যু ছিল , বস্তুত এই খেদ- ই তাঁর মৃত্যু তরান্বিত করেছিল ।
তৎকালীন পাদ্রীদের সাহচর্য বিশেষত কেরির কর্ম নিষ্ঠা বসু যাকে জ্ঞানসমুদ্রের বুকে যে ভেলাই সওয়ার করে ভাসিয়ে দিয়েছিল সেই বেলায় তাকে পৌঁছে দিয়েছিল মানব ধর্মের উপকূলে যেখানে তিনি একক পদচারনা করেছেন খ্রিষ্ট ও হিন্দু ধর্মের গোড়ামির স্পর্শ দোষ বাঁচিয়ে ।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে এই মহাপ্রাণ ব্যক্তি নির্মম ও উদাসীন পৃথিবীর মোহ পরিত্যাগ করেন । যতদূর জানা যায় তার মৃত্যুর পরেও মহাত্মা উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার বিকাশের কাজ অব্যাহত রাখেন । যদিও রামরাম বসুর মৃত্যু কেরির কাজের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। আশ্চর্যের বিষয় , রামরাম বসু যে বছর দেহ রক্ষা করেন সেই একই বছরে বাংলার মাটি আরেক “রামের ” পদধ্বনি শুনতে পায় —- তিনি ডিরোজিও শিষ্য, রামতনু লাহিড়ী ।
কুসংস্কার গ্রস্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন তৎকালীন সমাজে রাম বসু যদি সজোরে জ্বলে ওঠা ফুলঝুরি হন তবে রামতনু লাহিড়ী ছিলেন নিস্কম্প অনির্বাণ দীপ শিখা । রাম বসুর মধ্যে ছিল সদ্যলব্ধ জ্ঞানের অসহিষ্ণুতা যা থেকে জন্ম নেয় সমাজের জড়ত্ব কে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা । সেই ইচ্ছাই পথ খুঁজে ফিরতো তাঁর ব্যঙ্গ বঙ্কিম বাক্য বানে । অপরদিকে রামতনু লাহিড়ীর জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে শিখিয়েছিল শুধু ভেঙে চুরমার করাই সমাজ সংস্কারের পথ নয় বরং প্রয়োজন প্রজ্ঞা ও ধীরতা যা দিয়ে সমাজকে নতুন বন্ধনে বাঁধতে হবে । তবে সে এক ভিন্ন ইতিহাস , ভিন্ন পরিসরে কহতব্য ।