চতুর্থ বর্ষ-প্রথম সংখ্যা-প্রবন্ধ
ঋত্বিক ঘটকের কাছে ‘গান’ চলচ্চিত্রের ডেকরেশন ছিল না
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে, নিঃশব্দে বেজে উঠেছিল আলোর অপেরা। বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে- আমরা তাঁর শোকযাত্রা থেকে ফিরে এসেছিলাম, নতমুখে। আজ সবিস্ময়ে দেখি, ঋত্বিকের রোগক্লান্ত ললাটে আলো পড়েছে, ওই ‘কুমার’ শব্দটা জরুরি, আজ প্রমাণিত। শিল্পীর কৌমার্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে। কিন্তু আজ আমরা কেন তাঁকে নিয়ে ভাবব? শুধু দেশবিভাগের সমস্যা নিয়ে ছবি করেছিলেন বলে? কিছু ছিন্নমূল মানুষের আর্তমুখচ্ছবি তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল বলে? আমার মনে হয় না। আজ যখন গাজার সীমান্তে কিংবা অন্যত্র গ্রামপতনের শব্দ হয়, কেবলই ঘর ভাঙে, তখন মনে হয় এই স্রষ্টার অভিযান আমাদের জন্য আরও কিছু রোমাঞ্চকর তথ্য পরিবেশন করতে পারে।
রেমব্যান্ট একসময় একটা ছবি এঁকেছিলেন ‘রাতের পাহারা’। তাতে সম্পদের দারিদ্র উন্মচিত হয়েছিল। শালবনে ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্প’-এ চরমপন্থী যুবকের সঙ্গে ভবঘুরে নীলকণ্ঠ বাগচীর কথোপকথন হতে থাকে। সহসা ভ্রম হয়। এ কি আজকের ভারতবর্ষ ?
কিন্তু তাৎক্ষণিকতার এই তাৎপর্য ছাড়ালে বোঝা যায়, যুক্তি আর তর্কের লাবণ্যে ঋত্বিক পরীক্ষা করছেন নিজেকেও। এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের আর মাত্র দু’জন পূর্বজের কাছ থেকে হয়েছে- জীবনানন্দ দাশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ্যালয়ে সীতা আত্মহত্যা করার পর কে বলে- হে রাম! সে তো নাট্যান্তর্গত কোনও চরিত্র নয়। এ তো আকাশবাণী। স্বয়ং ইতিহাস নিজে আখ্যানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের চেতনাকে সন্ত্রস্ত করে।
বস্তুত দেখা যাবে যে, ঋত্বিক যখন রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেন, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত, তখনও তাঁর প্রয়োগ অসামান্য, অদৃষ্টপূর্ব এবং অনন্য সাধারণ। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁর দেখেছেন যে, এই একটি জায়গায় ঋত্বিককুমার ঘটক ও সত্যজিৎ রায়ের মতামত প্রায় বিপরীতধর্মী। সত্যজিৎ মনে করতেন গান, বিশেষত প্রাচ্যের গান, ভারতীয় সিনেমার অনেক ক্ষতি করে। সেক্ষেত্রে তাঁর পাশ্চাত্য সংগীতের দিকে হাত বাড়ানোই ভালো। কারণ সেখানে এক ধরনের নাটকীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। পুরুষধর্মী ‘ক’ ধ্বনি এবং নারীধর্মী ‘খ’ ধ্বনি তাদের সংঘাতে ক্রমশ নাট্যধর্ম বিস্তার পেতে শুরু করে। এবং এই জন্যই সত্যজিৎ মোৎজার্টের কাছে হাত পেতেছিলেন। অন্যদিকে দেখা যায়, ঋত্বিক ঘটক প্রায় যেন সত্যজিতের এই মতামতের এক ধরনের প্রতিবাদের জন্যই ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটি বিস্তার করেন রাগ হংসধ্বনির পাত্রে। তার আলাপ, বিলম্বিত, বিস্তার, লয়- সবকিছুই আখ্যানের আনুপাতিক। আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগই ধরি, তাহলে কী দেখব? বস্তুত ঋত্বিক ঘটক একদিন এক আড্ডায় অনেক ছাত্রের মধ্যে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘জর্জদা শব্দকে দেখতে পান। রবীন্দ্রসংগীত ওঁকে বাদ দিয়ে… অ্যাবসার্ড!’ এই উত্তর থেকেই আমি বুঝতে পারি, চলচ্চিত্রে দেবব্রত-ঋত্বিক সংলাপের দার্শনিক তাৎপর্য। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে তিনি চেয়েছিলেন আজাদগড়ের উদ্বাস্তু কলোনিতে ‘কুমারসম্ভব’-এর নায়িকাকে আবিষ্কার করতে। একটি প্রত্ন-সাম্প্রতিক রচনা করার দায়িত্ব নিলে একদিকে থাকে পুরাণ প্রতিমা, অন্যদিকে দরমার বেড়ার ঘরের বাস্তবতা। এখানেই জরুরি হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মতো সুরস্রষ্টার উপস্থিতি।
‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে/ জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে’- রবীন্দ্রনাথের এই রচনাকে ঋত্বিক চেয়েছিলেন প্রলয়ের দেবতার মিলনের অনুষঙ্গে ব্যবহার করতে। শঙ্কর ও নীতা, যথাক্রমে অনিল চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয়া চৌধুরী এখানে স্পষ্টতই কালপ্রতিমা। দৃশ্যের দিক থেকে দেখলে প্রায় নিরালোকে প্রথমে শঙ্করকে ক্লোজ আপে ধরেই ক্যামেরা মিড লিং শটে পাত্রপাত্রীকে ধরে- তারপর ধ্রুপদী মেলোড্রামার নিয়ম অনুযায়ী ক্যামেরা ও বিষয়ের দূরত্ব বেড়ে যায়, অর্থাৎ ঋত্বিক আমাদের নিয়ে চলেন ইতিহাসে, লং শটে। তারপর ক্যামেরা আবার এগিয়ে আসে। টর্যাকব্যাক করে। একটু কৌণিক লো অ্যাঙ্গেল ক্লোজ আপে আজকের নীতা তখন বিসর্জনের মুহূর্তে দেবী প্রতিমা। সময়ের এই বিরাট ব্যবধানকে সংগীত তখনই পূর্ণ করতে পারে, যদি তা শ্রুতিগ্রাহ্য বাস্তবতার রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথের গানে আখ্যান অংশে সর্বনাশের দেবতার আগমনধ্বনি আছে। এবং আমাদের খেয়াল করতেই হয় যে, দেবব্রতর কণ্ঠ সুরে আরোহণ ও অবরোহণে মূর্ত, শরীরী ও চিত্রময়। দেবব্রত বিশ্বাস যখন ‘ঘরভরা শূন্যতা’ উচ্চারণ করেন তখন ভাস্কর রাঁদার কথা মনে হয়, তিনিও তো সমতলীয় শূন্যতায় বক্রতা খুঁজে ফিরতেন। সংগীতজ্ঞরা যে অডিবল স্পেস বা শ্রাব্য আয়তনের জন্য ব্যাকুল, ভাগ্যক্রমে, দেবব্রত বিশ্বাস অবলীলায় তা নির্মাণ করতে পারেন।
এই গানটি অনুপুখে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাখ কেন বলেছিলেন অবরোহণের মধ্যেই স্থাপত্যের যা কিছু সৌন্দর্য। সুপ্রিয়া চৌধুরী যেমন দেবী-মানবীর সেতুবন্ধন, ঋত্বিক তেমন এখানে স্বর্গ-মর্ত্যের সীমানা। এই গান বাঙালির সভ্যতায় সেবাস্তিয়ান বাখের সেন্ট ম্যাথিউস প্যাশনের সমান্তরাল। দেবব্রত বিশ্বাসকে তিনি অকারণে নিয়োগ করেননি। ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে যখন দেবব্রত গাইতে থাকেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’, তখন ‘ভরা’ শব্দটির বিস্তার এমন মাত্রা পায়, যেন মনে হয় জীবনানন্দ দাশ হয়তো এমন শ্রবণের অভিজ্ঞতা থেকেই আবিষ্কার করেছিলেন ‘অনন্ত আকাশগ্রন্থি’ শব্দগুচ্ছ। অথবা আইন্সটাইনীয় মহাবিকর্ষে কল্পিত ‘ফাইনিটিয়েট আনবাউন্ডেড ইউনিভার্স’ সংক্রান্ত ধারণা বোধহয় এইরকমই। মহাবিশ্বের বিস্তার দেবব্রতর কণ্ঠস্বরে নিয়তাকার, কঠিন, ঘন ও সংহত মনে হয়। ‘প্রেনম কারমেন’ ছবিতে সুরকার বিজেত কারমেন অপেরা প্রায় একই উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছিলেন জাঁ লুক গোদার। কিন্তু পথিকৃৎ তো আমাদের ঋত্বিক ঘটকই। এই আকাঙ্ক্ষা, এই চেতনা, কারিগরের নয়, স্রষ্টার চেতনা, যা বিশৃঙ্খলা ও অ্যাবসার্ডিটির বিরুদ্ধে। মৃত্যু ও শূন্যতাকে, পাপ ও প্রদ্যানকে নিবেদন করে অসীমের সমীপে।
এই নিবেদন, মীরাবাইয়ের মতো প্রতীক্ষাই অনুজপ্রতিম ঋত্বিককে নিয়ে গিয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের দরজায়। তাঁদের দু’জনের যা মিল, শ্রদ্ধা ও স্নেহ, তার উৎস হয়তো বামপন্থা, কিন্তু দু’জনেই দেখা যাবে নিজবাসভূমে পরবাসী, প্রত্যাখ্যাত। আর দু’জনেই পার হয়ে যাবেন ব্যাকরণের সীমানা। ফলে ঋত্বিক যেমন ক্যামেরায় খুব সচেতনভাবে কিছু চ্যুতিকে প্রশ্রয় দেন, শাস্ত্রসম্মত ব্যকরণ মানেন না, দেবব্রত বিশ্বাসের গানেও কিছু পথচ্যুতি আছে। এবং সেই চ্যুতিটির জন্যই এই দু’জনের মধ্যে এক সহজ সমীকরণ তৈরি হয়।
১৯৩৪ সালের এক প্রবন্ধে পল রবসন অভিযোগ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ সভ্যতা প্রজ্ঞাকে নিয়ে পুতুল বানায়, তারা চিন্তার দেবতার পূজা করেন, কিন্তু নিগ্রোরা অনুভব করতে চায় চিন্তার বদলে, আর সেই অনুভব প্রত্যক্ষ- সে সযত্নে নির্মিত যুক্তিপথের বদলে বিশ্বাস করে মূর্ত ও ইন্দ্রিয়সঞ্জাত উপলব্ধিতে। বস্তুত জর্জ বিশ্বাসের গলায় যে নাটকীয়তা, তাকে ঋত্বিক একেবারেই চলচ্চিত্রিত ভাবতে পারেননি। যদি শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্প’-র কথা ভাবি, সেখানে তিনি ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ প্রয়োগ করেছেন। যদিও অসুস্থতার কারণে দেবব্রত পুরো গানটি শেষ করেননি। বাকি গানটি গেয়েছিলেন সুশীল মল্লিক। কিন্তু মূল গানটি দেখলেই বোঝা যাবে, আবারও ঝড়ের রাতে, যখন মারের সাগর গাড়ি দিচ্ছে সমস্ত বাংলা, যখন আমাদের সংস্কৃতি জানে না মাতৃবন্দনা কীভাবে সম্পন্ন হবে, শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে না আদিবাসী উচ্চারণে- পুরুলিয়ার ছৌ নাচ যখন সম্পূর্ণ রূপক হিসেবে দেখা যায়, তখন ঋত্বিক ঘটক এই গানটিকে ছাড়া অন্য কোনও গান ব্যবহার করতে পারতেন না, কেননা ভারতবর্ষের মানচিত্র তাঁর কাছে প্রথাসিদ্ধ, সংবিধানসম্মত ছিল না। এবং সেইজন্যই দেবব্রতকে তিনি ব্যবহার করেছেন। যখন ‘কোমল গান্ধার’-এ ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ’ গানটি প্রয়োগ করা হয়, সেখানেও দেখবেন, হিমালয়ের ওই বিরাট বিস্তার দেবব্রত যেভাবে শব্দের ওজন এবং মাত্রা খুঁজে পেতেন- সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে। দেবব্রত যখন গান করতেন, শব্দের একটি দৃশ্যমাত্রা খুঁজে পেতে চাইতেন। একইসময় তপন সিনহার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’। দেবব্রত যা গেয়েছিলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়। দু’জনের গানের তফাত কী? দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গান সু-গীত। ব্যাকরণসম্মত। তা শুনে আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রসংগীতের অত্যন্ত ভালো ব্যবহার। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসকে আমরা যখন শুনি, বুঝতে পারি, ঋত্বিক ঘটকের সৌজন্যে আমরা অনেকটা পল ম্যাকার্টনির মতো ক্রসওভার শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা হচ্ছে। ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে, মহাপ্রস্থানের একটু আগে, যখন ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা’ গানটিকে ব্যবহার করেন ঋত্বিক ঘটক, আরতি মুখোপাধ্যায়ের গলায়, তখনও দেখেবেন, যে মর্ত এবং অ-মর্তের যে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন তা রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে কী অসাধারণভাবে প্রযুক্ত হয়। যে অনন্ত প্রতীক্ষা আমাদের, সেই অনন্ত প্রতীক্ষা একইভাবে ‘কোমল গান্ধার’-এ ‘আমারে যে জাগতে হবে কী জানি সে আসবে কবে’ গানটির মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হয়। আসলে ঋত্বিক ঘটকের কাছে ‘গান’ চলচ্চিত্রের ডেকরেশন ছিল না। সুন্দরীর কণ্ঠে একধরনের রূপময় আভরণ ছিল না। আত্মার সংগীত ছিল। এবং এই আত্মার সংগীত ছিল বলেই তিনি, সত্যজিৎ রায় যেভাবে গানকে দেখেছেন, তার বিপক্ষে চলে গিয়েছিলেন। সে যুগে চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহারে সংখ্যালঘু ছিলেন মাত্র দু’জন- ঋত্বিক ঘটক এবং কমলকুমার মজুমদার। দ্বিতীয়জন বিশ্বাস করতেন, বাঙালি হিন্দু এমনকী শ্মশানেও গান গায়। গান আমাদের জীবনে অনিবার্য। তিনি যদি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ না করতেন, তাহলে আমাদের সমস্ত শিশুতীর্থ ভেঙে পড়ত। আমাদের যাবতীয় পূজা এক ব্যর্থ নিবেদনে পরিণত হত।
(পুনঃপ্রকাশিত)
“শতবর্ষে সলিল চৌধুরী” — বাংলার সংগীতাকাশে রামধনু
ড.সুদক্ষিণা গুপ্ত
(অধ্যাপিকা অর্থনীতি বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
সলিল চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত ভারতে, অবিভক্ত বাংলায়, আজকের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরে। যেহেতু ১৯২৫ এ’ জন্ম তাই বড় হবার সময় অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মধ্যে ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সহিংস ও অহিংস, শ্রমিকদের ওপর শোষণ, কৃষকদের ওপর অবিচার, ১৯৪৩ এর বাংলায় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এদেশের তাঁর সংকটময় প্রভাব, আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA), সেখানকার সেনাদের বিচারপ্রক্রিয়া, নৌ বিদ্রোহ, শেষমেষ স্বাধীনতাঁর দেশভাগ ও লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দুর্ভোগ। এক কথায় বলতে গেলে অত্যন্ত ঘটনাবহুল সময়ে তিনি কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পৌঁছেছেন। এইসব ঘটনা, এবং শিশু অবস্থায় বাবার চাকরিসূত্রে আসামের চা বাগানে কাটানোর সময় চা শ্রমিকদের দুর্দশা ইত্যাদি, তাঁকে তখনকার আরো অনেক বাঙালী যুবকের বা যুবতীর মতো আদ্যপান্ত বামপন্থী করে তোলে। হরিনাভি স্কুল থেকে পাশ করে কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় আরও খোলামেলা পরিবেশে আরও জ্ঞানোন্মেষ হয় তাঁর। দেশ বিদেশের পত্রপত্রিকা পড়েন, সোভিয়েত রাশিয়ার কথা জানতে পারেন, স্ট্যালিন এর ভক্ত হয়ে যান, এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে এসবের ফলশ্রুতি হিসাবে যোগদান করেন IPTA বা Indian Peoples’ Theatre Association এ যা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির (ভারতের) শিল্পী শাখা। “বিচারপতি, তোমার শেষ বিচারের আশায়” গানটি INAর বিচার প্রক্রিয়ার সময় লেখা ও সুর দেওয়া বলে জানা যায়।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সলিল লিখে ফেলেন কালজয়ী বাংলা আধুনিক গান “কোন এক গাঁয়ের বধু…….” এবং তাতে সুর দেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, দেবব্রত বিশ্বাস, শ্যামল মিত্র,সুবীর সেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, কে কন্ঠ দেননি এই গানে? এই গানটি আজ প্রায় ৮০ বছর পেরিয়েও বাঙালী তথা ভারতীয় সমাজের অন্দরমহলের দর্পণ। অজস্র নারী ক্ষমতায়নের প্রকল্পের পরেও যে গান আজও “গায়ের বধূ”র মর্মস্পর্শী কাহিনীকে বিবৃত করে। এই চল্লিশের দশকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রাণ পায় অকালপ্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টচার্য এবং “ছন্দের জাদুকর” সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা “রানার” ও “পালকির গান”। এই দুটি গানের সুরকার সলিল চৌধুরী আর কিছু না করলেও হয়তো অমর হয়ে থাকতেন শুধু এই দুটি গানের জন্য। সুকান্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কায়িক শ্রম দিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি গান দুটির সুরে সুরে কী দারুন আর্তি প্রকাশ করে। “অবাক পৃথিবী” গানটিও ওই সময়ই তৈরি করা হয়।
মধ্য চল্লিশের দশকে, সলিল যখন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য এবং গ্রামে গঞ্জে কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ সঞ্চার করার কাজে ব্যস্ত, তখন ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে ও সদস্যদের ধরপাকড় শুরু করে। অনেক সদস্যই তখন পালিয়ে গিয়ে নানা জায়গায় গা ঢাকা দেন, অনেকে ধরা পড়ে ব্রিটিশের অকথ্য অত্যাচারের সম্মুখে পড়েন। সলিল ছিলেন প্রথম দলে, সুন্দরবন অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে তিনি আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করেন। ধানের ক্ষেতে তিনি লুকিয়ে থাকতেন। শোনা যায় খাটা পায়খানার গর্তের মধ্যে ঢুকেও নাকি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছেন তিনি। এত কাণ্ডের মধ্যেও তিনি কিন্তু গান লেখা, সুর করা বা নাটক লেখা ছাড়েননি।
সলিলের সংগীতের প্রতি ন্যাক ছিল অসাধারণ।অগ্রজ এর কাছে মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি পিয়ানো বাজানো আয়ত্ত করেন। এছাড়া বাঁশি, এসরাজ, হারমোনিয়াম…. কি না বাজাতেন ছোট্ট বয়স থেকেই। এত রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন বলেই, তাঁর দেওয়া সুরে এত বৈচিত্র্য। লোকগান, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি আর ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত- সব রকমের সংগীতের থেকে তিনি সুর আহরণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে প্রথম গান “বিচারপতি তোমার বিচার…” গানটিতে তিনি কীর্তনের অনুষঙ্গ আনেন। আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাঁর গানে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব। বিভিন্ন রকম ভারতীয় সুরের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুর মিলেমিশে তৈরি হতো তাঁর গানগুলি। ছোটবেলায় তাঁর আসামের চা বাগানে থাকা এবং যাতায়াত ছিল। বাবা ছিলেন সেখানকার ডাক্তার। চিকিৎসক পিতা চা- শ্রমিকদের সঙ্গে নাটক, গান এসবও মেতে থাকতেন। সেখানে চিফ মেডিকেল অফিসার আইরিশ ড: মানোলিনের সংগ্রহে ছিল অসংখ্য পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল গানের রেকর্ড।ছোট্ট সলিল গ্রামফোনে সেইসব বাজনা শুনতে নিয়মিত সেই সাহেবের বাড়ি যেতেন। পরে ১৯৫১ সালে সেই সাহেব দেশে ফিরে যাবার সময় তাঁর সংগ্রহ যুবক সলিল দিয়ে যান। মোজার্ট, বিটোফেন, চাইভয়েক্সি ইত্যাদিদের শোনার অভ্যাস সলিল ছোটবেলা থেকেই তৈরি করেন, এবং শুনেই সুরগুলি আয়ত্ত করেন। পরে যখন তিনি “গানে ভুবন ভরিয়ে দেবেন”; তখন তাই পাশ্চাত্য সঙ্গীতও অনায়াসে ঢুকে পড়বে সেই ভূবনে। ১৯৬০ এর দশকে তিনি ইংল্যান্ডের বিশ্বভুবন কাঁপানো “রক এন্ড রোল” গানের দল “বীটেলস্” এর ভক্ত হয়ে যান। এবং তাঁর রচিত গানের সুরে তারও প্রভাব পড়ে। তারা অবশ্য ক্লাসিক্যাল গানের ধার ধারতেন না খুব একটা।
সে যা হোক সলিলের প্রথম সুর করা বাংলা গান নিয়ে বাংলা ছবি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে নাম ছিল তাঁর “পরিবর্তন”। ১৯৯৪ তে “মহাভারতী” নামে বাংলা সিনেমাটি ছিল তাঁর সঙ্গীত নির্দেশনার শেষ বাংলা ছবি। মোট ৪১টি বাংলা ছবিতে তিনি সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন।
১৯৫৩ সালে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকটি আসে। সে সময় বাংলার সিনেমার জন্য তিনি একটি গল্প লিখেছিলেন, সেখানে এক জমি হারানো উদ্বাস্তু মানুষের কলকাতায় এসে “রিক্সাওয়ালা” হয়ে যাওয়ার ঘটনা বলা ছিল। ঘটনাচক্র তখন কলকাতায় একদিন ঋষিকেশ মুখার্জিকে তিনি গল্পটি শোনান। ঋষিকেশ অত্যন্ত খুশি হয়ে ফিল্ম পরিচালক বিমল রায় কে গল্পটি শোনান। বিমল রায় সলিলকে পরদিনই দেখা করতে বলেন। কিন্তু অত্যন্ত জরুরী দরকারে তাকে বোম্বাই ফিরে যেতে হয় সেদিন। এর এক সপ্তাহের মধ্যে বিমল বাবু তাকে বোম্বে ডেকে পাঠান ও জানান যে ওই গল্পের ওপর তিনি ছবি করতে চান। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় “দো বিঘা জমিন” ছবিটি যার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী। ছবিটির নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি” কবিতাঁর নামে- গল্পটা কিছুটা এক হলেও সম্পূর্ণ এক নয়। এটি Filmfare এ “Best Movie” ও Cannes Film Festival এ’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। এই ঐতিহাসিক ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর সলিল চৌধুরীকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
হিন্দি সিনেমার একের পর এক মন মাতানো চিরকালীন গান উপহার দেন তিনি, সুরের স্বতন্ত্রতা ও বৈচিত্র্য একই সঙ্গে গানগুলিকে ইউনিক করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সিনেমার গান ও চলতে থাকে। সিনেমার প্রয়োজনের তাকে নানা ধরনের গানের সুর দিতে হয়েছে, বাংলা সিনেমায় লিখতেও হয়েছে হয়তো নানা রোমান্টিক গান, কিন্তু কমিউনিজম তাঁর অন্তরকে ছেড়ে যায়নি কখনো। ১৯৫৮ সালে তিনি “বোম্বে ইউথ কয়ার” প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ভারতের নানা শহরে তা চালু হয়। কলকাতায় রুমা গুরু ঠাকুরতা এ ব্যাপারটির নেতৃত্ব দেন। সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীতগুলি তাঁর নিজের লেখা ও সুর করা, আজও মাতিয়ে রাখে বাঙালীকে। বাংলার সংগীতের অমূল্য সম্পদ সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুরারোপিত গণসঙ্গীতগুলি। এগুলির সৌন্দর্য, মহিমা ও জনপ্রিয়তা ম্লান হবে না কোনদিন।
ধীরে ধীরে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ফিল্মি গানেও তিনি সুর বসাতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে মালায়ালম্ সিনেমায় সুরসৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাঁর এই যাত্রা শুরু হয়। ৭৫টি হিন্দি, ৪১টি বাংলা, ২৭টি মালায়ালম সিনেমার পাশাপাশি কিছু মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, ওড়িয়া এবং অসমিয়া ভাষায় তৈরি সিনেমাতেও তিনি সুর দেন এবং সঙ্গীত নির্দেশনা করেন। শোনা যায় তিনি আগের গানের situation টা জেনে নিতেন, তারপর music তৈরি করতেন। তারপর যিনি গান লিখতেন, তিনি সেই সুরে কথা বসাতেন। এই ভাবেই তৈরি হয়েছে হিন্দি ছবির প্রচুর হিট আর কালোত্তীর্ণ গান। সলিল চৌধুরীর অবদান শুধু ভারতীয় সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় “স্বাধীন বাংলা বেতাঁর কেন্দ্র” তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ হয়। ঐ বছরই “বাংলা আমার বাংলা” নামে গানের album (রেকর্ড) বার করেন তিনি, যা কিনা বাংলাদেশে খুবই সমাদৃত হয়, তা মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করেই তৈরী। 1990 সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর “মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মান” দেয়।
সলিল চৌধুরী এককথায় “গান বাঁধতেন”। তিনি গান লিখতেন, তাতে সুর দিতেন, বাজনা arrange করতেন, নিজেও চমৎকার গাইতেন। এই বাজনা arrange করার ব্যাপারটা অবশ্যই গানের জগতে synthesizer প্রবেশ করার আগে। সলিল যখন গানের জগৎ এবং সেইসঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখনও কম্পিউটার ও মোবাইল তাদের সর্বগ্রাসী প্রভাব নিয়ে গানের জগতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। AI র রমরমা বাজার ছেয়ে ফেলেনি।
সলিল চৌধুরী যে শুধু সঙ্গীতকার ও গীতিকার ছিলেন, তা নয়, তিনি একাধারে সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, লেখক ও কবি ছিলেন। বাংলা ভাষায় তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সমাদৃত। নানারকম বাদ্যযন্ত্রতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। এমনকি একটি হিন্দি সিনেমা “পিঞ্জরে কে পন্ছী” ও তিনি পরিচালনা করেন (১৯৬৬) যাতে অভিনয় করেন মীনা কুমারী। তিনি নিজেই বলতেন, শুধু কিছু সৃষ্টি করে যাওয়ার তাগিদেই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তবে তাঁর কূলছাপানো সৃষ্টি সঙ্গীতকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছে। দেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চাইতেন তিনি, তাই তাঁর গানে পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও অনেক প্রাচ্য ভাষার সুর মিলে যেত। এমনকি প্রকৃতি থেকেও সুর সংগ্রহ করতেন তিনি। তাই তাঁর সুরগুলি হয়ে উঠত unique যা পরের প্রজন্মকেও প্রভাবিত করেছে যেমন, ইলাইয়ারাজা বা এ.আর.রহমান এই প্রভাব স্বীকার করেন।
১৯৯৬ সালে হঠাৎ করেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। খুব অকালমৃত্যু না হলেও আরও অনেক কিছু হয়তো তাঁর দেবার ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রী, যিনি তাঁর জন্য অনেকটাই আত্মত্যাগ করেন, তাঁকে ও তাঁর তিনটি কন্যাকে ছেড়ে এক ছাত্রীকে বিবাহ করেন। প্রথমা স্ত্রী ছিলেন জ্যোতি, অঙ্কনশিল্পী এবং দ্বিতীয়া স্ত্রী সবিতা, যিনি নিজেও বাংলা সংগীতের একজন প্রথিতযশা শিল্পী ছিলেন। জ্যোতির সন্তানদের অবশ্য খোঁজখবর রাখতেন তিনি। বম্বে (মুম্বাই) ও কলকাতাঁর দুই সংসারে তাঁকে দৌড়ঝাঁপ করতে হত। সবিতাঁর পুত্রকন্যাদের তিনি সংগীতের জগতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। পুত্র সঞ্জয় ও কন্যা অন্তরা প্রতিষ্ঠিত হন। রবিশঙ্কর, কিশোর কুমার ইত্যাদি অন্যান্য আরও শিল্পীদের মতই হয়তো এক সংসারে তিনি স্থিতি হতে পারেন নি। সংসারে সুখ পেলেও শান্তি পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই। তবে মানুষ তাঁকে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবেই মনে রাখবে। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের পরে বহুমুখী ও বিচিত্রগামী প্রতিভার দিক দিয়ে তিনিই হয়তো অগ্রগণ্য। জনপ্রিয়তাঁর নিরিখে তাঁর সৃষ্ট সুর ও তাঁর রচিত গণসঙ্গীতগুলির কোনো পরিমাপ করা যায় না। তাঁর মত আরেকজন আসবেন কিনা ভারতীয় সঙ্গীতজগতে, তাঁর জন্মশতবর্ষে এটিই কোটি টাকার প্রশ্ন।
অন্তঃসলিলা
অর্ক সান্যাল
ব্রাত্যজন নাট্যদলের “রুদ্ধসঙ্গীত ” আমার দেখা একটি অন্যতম প্রিয় বাংলা নাটক। জর্জ দা ওরফে দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনের প্রেক্ষাপটে তৈরী নাটক আমার সাথে প্রথম পরিচয় করে সেই সময়কালের একাধিক শিল্পী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে । পরিচয় করায় সলিল চৌধুরীর সাথেও। আসলে মহাকাল যখন শ্রেষ্ঠত্বকে প্রসব করে তখন কোনো এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয় ,বরং এক ঝাঁক হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা কে পাঠায়। আর আমরা এই সাধারণ মানুষ রুপী মূষিক রা ধাওয়া করি সেই শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধানে।
এই গৌড় চন্দ্রিকা নিষ্প্রয়োজন। নিষ্প্রয়োজন সলিল চৌধুরীকে এই লেখার মঞ্চে এত জাঁক জমক পূর্ণ ভাবে আহ্বান জানানোর । তবুও এই লেখার নাম দিয়েছি অন্তঃসলিলা।
এই শব্দের অর্থ হল ভূগর্ভের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। না , না , তা বলে হালের হাওড়া ধর্মতলা গঙ্গা তলদেশের মেট্রোর কথা বলছি না। বলছি ভূ গর্ভস্থ জলধারার কথা।
আজকের এই ট্রেন্ডের যুগে ,যেখানে এক ধাক্কায় বিখ্যাত ভাইরাল এবং অনতিবিলম্বে হারিয়ে যাওয়া যায় , সেই যুগেও যার সৃষ্টি গুলি নতুন করে ট্রেন্ডিং এ থেকে যাচ্ছে অনেক সময় পার করে এসেও , তার নাম সলিল চৌধুরী।
আর অন্তঃসলিলা তার ভাব বা বোধের রূপক যা ভূগর্ভস্থ নদীর মত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিবাদী মানুষের ধমনীতে আজও বিপ্লবের , সত্যের চোরা স্রোত আনতে পারে।
তাই এই শতকেও NRC এর প্রতিবাদী মঞ্চে শোনা যায় , ” ও আলোর পথযাত্রী “, কিংবা বর্তমানে হোম ডেলিভারি এপ্লিকেশনের ডেলিভারি পার্সনদের দেখে মনে হয় , ” রানার ” এর প্রতিনিধিদের কথা।
IPTA এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিপ্লব আসলে কিছু শ্রেষ্ঠত্বকে জন্ম দেয়। উপরিউক্ত ওই নদীর সৃষ্টির পিছনে অন্যতম প্রয়োজনীয় হিমবাহটির নাম IPTA (the Indian People’s Theatre Association) বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ।
১ ৯ ৩ ৫ সালে লন্ডনে কিছু ভারতীয় যুবা বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে তৈরী হয়
“The Progressive Writers Association”( PWA) ।কিছু ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশের পর ওই সংগঠনের একটি প্রভাব এসে পৌঁছায় ভারতবর্ষে।
IPTA আসলে PWA এর উত্তরসূরির নাম।
শিল্প ও সংস্কৃতি কি কেবলই বিনোদন ও ব্যবসার অঙ্গ যা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক , নাকি রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়া শিল্প অসম্ভব।এই দীর্ঘকালীন মতবিরোধ আজও বর্তমান।
Ipta মূলত তৈরি হয় যাতে শিল্প ও সংস্কৃতি মানুষের সামাজিক তথা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য সংগ্রাম করতে পারে।
১৯৪৩ এ যখন IPTA প্রতিষ্ঠা হয় তখনও অধিকাংশ মানুষ কল্পনা করতে পারেনি ভারতের ভাবি রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর এর প্রভাব কতটা পড়তে চলেছে।
১৯৪২ , ভারত ছাড়ো আন্দোলন IPTA এর প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।যে সমস্ত শিল্পীরা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংস্কৃতিক ভাবে অংশগ্রহণ করতে চান, IPTA দেয় তাদের মঞ্চ। বিশ্ব সংস্কৃতির নাট্য,সিনেমা,সাহিত্য, সঙ্গীতের ঢেউয়ের সাথে মিশে যায় ভারতীয় সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে IPTA পৌঁছে যায় মানুষের মনের অন্দরে।
বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ” নবান্ন” , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র্যের ” নব জীবনের গান” , কে. এ. আব্বাসের ” ধরতি কি লাল” চলচ্চিত্র এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
যদিও দেশভাগের অনতিবিলম্বে Ipta নেতৃত্ব,রাজনীতি, আদর্শ ও দর্শনগত ভাবে বৈষম্যের জন্য ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব হারাতে থাকে, যদিও তার ভূমিকা আজও অপরিসীম।
সলিলের IPTA প্রবেশ –
কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক সলিলের জীবনে রাজনীতি ও সঙ্গীত বিশেষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ, সর্বোপরি চল্লিশের দশকের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে সলিল নিমজ্জিত হতে থাকেন ।কৃষক আন্দোলনেও সক্রিয় ভাবে অংশ নেন তিনি।
১৯৪৩ এ সলিল ipta এর সদস্য পদ গ্রহণ করেন এবং অনতিবিলম্বে সদস্য হন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির।
সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি সৃষ্টি করেন অনেক গুলি গান ।আনুমানিক ৭০ টি গানের নথি পাওয়া যায়।গান গুলি ছড়িয়ে পড়তে থাকে নানা দিকে এবং গান গুলি হয়ে ওঠে মানুষের গান হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমকালীন সময়ের সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর।
প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সুরের এক অভাবনীয় মিশেলে সলিলের সৃষ্টি ভারতীয় সঙ্গীতে নিয়ে আসে নব জোয়ার। তাঁর সঙ্গীত জীবনকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।Ipta পর্যায় এবং বোম্বাই পর্যায়।প্রথম পর্যায়ে তিনি একাধারে গীতিকার, গায়ক ,সুরকার নাট্যকার সর্বোপরি এক পূর্ণাঙ্গ শিল্পী তথা সমাজকর্মী।অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় ও সফল সঙ্গীত পরিচালক ।
প্রতিবাদের সুর, সুরের প্রতিবাদ –
প্রতিবাদের সুর, প্রতিবাদী সঙ্গীত সর্বোপরি গণ সঙ্গীত আসলে সংস্কৃতি ও রাজনীতির সাথে দ্বন্দ্বমূলক ভাবে সম্পর্কযুক্ত।অভিধান মতে প্রতিবাদী সঙ্গীত আসলে ব্যক্ত করে রাজনৈতিক অন্যায় (জাতীয় , আন্তর্জাতিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত) এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা প্রতিবাদের সুর এবং এক ভবিষ্যত উত্তরণ। যেমন ধরা যায় ” we shall over come” গানটির কথা।
১৯৩৯ সালে বিলি হলিডের সৃষ্টি ” স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট” কে প্রথম প্রতিবাদী সঙ্গীত ওরফে গণসঙ্গীত হিসাবে গণ্য করা হয় ।
ষাটের দশকে আমেরিকার গনতান্ত্রিক অধিকার দাবীতে সৃষ্ট আন্দোলন সমগ্র ইয়োরোপের music industry কে অনেকাংশে প্রভাবিত ও পরিবর্তন করে। সেই সময় Sam Cooke এর ” A Change is gonna come” বিশ্ব বন্দিত হয়।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতে , ” গণ সঙ্গীত প্রতিবাদী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে ।”
৭০ এর দশকে র্যাপ সঙ্গীত মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার প্রতিবাদী মানুষদের বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে ।
মার্কিন রক সঙ্গীত শিল্পী ” জিমি হেন্ড্রিকস” এর মতে ” যদি পৃথিবীতে কোনো কিছু পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তা কেবল মাত্র সুরের মাধ্যমেই সম্ভব।”
যদিও ভারতবর্ষ এই প্রতিবাদী সুরের ক্ষমতা অনুধাবন করতে পেরেছিল ৪০ এর দশকেই ipta এর হাত ধরে ।যার অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন সলিল।
প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক দের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও সলিল অনতিবিলম্বে তৈরী করেন নিজের ঘরানায় ।
দলিলের সৃষ্ট ipta এর একাধিক কাজের মধ্যে অন্যতম হল ,” ১৯৪৫-৪৬ নাগাদ তৈরি , ” আলোর দেশ থেকে, আঁধার পার হয়ে ” এই গান এক ইউটোপিয়ান পৃথিবীর সন্ধান দেয় ।যা পাওয়া সম্ভব ত্যাগের মাধ্যমে ।
” গৌরিশৃঙ্গ তুলেছে শীর ” গানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালে যুব সমাজের বিশ্ব শান্তির দিকে গন্তব্যের কথা বলে ।১৯৪৬ এর ২৯ শে জুলাই নৌ বিদ্রোহের সমর্থনে তৈরি হল , ” ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে।”
” কারার দুয়ার ভাঙ্গো “, ” হাতে মোদের কে দেবে, কে দেবে সেই ভেরী “, এবং ” ভাঙ্গো, ভাঙ্গো,ভাঙ্গো,ভাঙ্গো,ভাঙ্গো কারা”।
এই গানগুলি মূলত সুপ্রাচীন রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং শোষণের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের কথা বলে ।
১৯৪৯ এ সৃষ্ট সেই বিশ্বনন্দিত সঙ্গীত ” ও আলোর পথযাত্রী, এখানে থেমো না ” গানটির মাধ্যমে যেন স্রষ্টা দেশবাসীদের স্বাধীনতা পরবর্তী জাগরণের কথা শোনান ।কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর ” গাঁয়ের বধূ” এবং ” পালকির গান” গান দুটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।পিট সিগার গান ও এক সময় সরকারি কোপের মুখে পড়েছিল ,যদিও ফল হয়েছিল উল্টো।জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে যায় অনেকাংশে ।ঠিক একই ফল হয়েছিল সলিলের ক্ষেত্রেও।
কৃষক, শ্রমিক , মেহনতী মানুষের জীবনের গল্প বার বার
প্রতিফলিত হয় তাঁর সুরে।
” হেই সামালো ধান হো” কিংবা ” ধান কাটার গান” প্রভৃতি প্রসঙ্গত উল্লেখ্য।
সিস্টেমকে সরাসরি প্রশ্ন করে সৃষ্টি করেন ” বিচারপতি তোমার বিচার” ।
আসামি, বিহু, কীর্ত্তন থেকে অ্যামেরিকান জ্যাজ বা পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত সব মিলে মিশে যায় তাঁর সৃষ্টিতে ।Ipta পরবর্তী পর্যায় তাঁর জীবনের এক অন্য অধ্যায়ের কথা বলে।
উপসংহার –
আন্দোলন মহান ব্যক্তিদের প্রসব করে , তাদের লালন করে ।যেভাবে বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব যেমন Bob Dylan,Joan Baez , Pete Seeger প্রমুখরা বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়েছেন তেমনই Ipta ভারত তথ্য বিশ্বকে উপহার দিয়েছে সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস , শম্ভু মিত্র দের ।
সিপিআই এবং Ipta কে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সলিলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।যদিও প্রতিদান যে সবসময় আশানুরূপ হয়েছে , তা নয় ।তবু সৃষ্টি থামেনি ।দীর্ঘকাল পার করে সেই গণ সঙ্গীত আজকের লাইক, শেয়ার , সাবস্ক্রাইবের যুগেও বেজে চলেছে এই প্রজন্মের কানে ।মনের তারেও সেই ঝংকার পৌঁছায় কিনা , সেটা মহাকাল ই বলবে।তবুও চলতে থাকুক এই অন্তসলিলার সুর আর বইতে থাকুক আদর্শের স্রোত আমাদের ধমনীতে।
Ritwik Ghatak
Mekhala Munshi
Ritwik Ghatak is a name that echoes through the halls of Indian cinema, though not always as loudly as it should. Unlike his contemporary Satyajit Ray, whose fame transcended borders, Ghatak remained an enigmatic figure—deeply influential yet often overlooked. His films were not just stories; they were cries of anguish, of longing, of unfulfilled dreams and fractured identities. A rebel, an artist, and an uncompromising visionary, Ghatak crafted a body of work that continues to inspire and haunt audiences’ decades after his death.
But who was Ritwik Ghatak, really? To understand the man is to understand the trauma of partition, the dreams of a lost homeland, and the pain of a soul too raw for the world. Born on November 4, 1925, in Dhaka, Bengal Presidency (now Bangladesh), Ritwik Ghatak was not just a witness to history—he was shaped by it. The Partition of Bengal in 1947 left an indelible scar on his psyche. Millions were displaced, families were torn apart, and the dream of a united Bengal shattered. Ghatak, too, became a refugee, forced to leave his beloved homeland and settle in Calcutta.
This sense of displacement and loss would later become the cornerstone of his cinema. He never made films for entertainment; he made them as a form of protest, as a means to exorcise his own demons. His characters—often refugees, struggling artists, and marginalized women—were all fragments of his own shattered identity.
Before cinema, there was theatre. In the late 1940s, Ghatak joined the Indian People’s Theatre Association (IPTA), a radical movement that sought to use drama and art as tools for social change. The IPTA was not just about performance; it was about revolution. It aimed to expose the struggles of the common man, the horrors of colonialism, and the plight of the working class.
Ghatak found his voice in this politically charged environment. He was not interested in escapism—his art had to reflect reality, no matter how painful. His early plays, often filled with socialist ideas, established him as a fearless storyteller. But he soon realized that theatre had its limitations. To reach the masses, he needed cinema.
Ghatak’s journey into filmmaking was anything but smooth. While his contemporary Satyajit Ray made films that were celebrated globally, Ghatak struggled with rejection, censorship, and financial ruin. His films were ahead of their time—raw, experimental, and politically charged.
His first completed film, “Nagarik” (1952), was a stark portrayal of a young man’s struggle in post-partition Calcutta. But the film never saw a commercial release during his lifetime. It was only decades later that “Nagarik” was recognized as the first realist film in Indian cinema, preceding Ray’s “Pather Panchali” by three years. However, Ghatak did not stop. He went on to make some of the most powerful films ever seen in Indian cinema.
If there is one set of films that defines Ritwik Ghatak’s legacy, it is his Partition Trilogy—a haunting exploration of loss, identity, and exile. These films were not just about the events of Partition; they were about its long-lasting effects on the human soul.
1. Meghe Dhaka Tara (1960) – The most famous of the trilogy, this film tells the heart-wrenching story of Neeta, a young woman who sacrifices everything for her family. But her sacrifices go unnoticed, and she is ultimately abandoned. The film’s most iconic moment—Neeta crying out, “Dada, aami banchte chai!” (Brother, I want to live!)—remains one of the most haunting scenes in Indian cinema.
2. Komal Gandhar (1961) – A film deeply personal to Ghatak, it explores the world of theatre groups in Calcutta and their ideological conflicts. But beneath this, it is a metaphor for a divided Bengal, desperately trying to reunite.
3. Subarnarekha (1962) – Perhaps the most tragic of the trilogy, this film follows the fate of a brother and sister as they try to rebuild their lives after Partition, only to be swallowed by fate and despair. The film ends on a note so dark that audiences at the time rejected it outright.
These films did not find success when they were released. Audiences were not ready for their intensity, their brutality, their stark refusal to sugarcoat reality. Today, they are hailed as masterpieces.
What made Ritwik Ghatak’s films unique was not just their themes but their style. He was deeply influenced by Soviet cinema, particularly Sergei Eisenstein, and his use of montage and symbolism set him apart from his peers. His films were filled with bold visual metaphors, such as shattered mirrors, railway tracks, and vast landscapes that echoed the emptiness within his characters. His use of sound was radical. Instead of using background music to evoke emotions, Ghatak used sounds of trains, thunderstorms, and even silence to create an unsettling atmosphere. His films were like cinematic poetry, raw and unfiltered.
Despite his genius, success eluded him. While Ray became an international icon, Ghatak remained in the shadows, struggling with alcoholism, depression, and financial ruin. He was misunderstood in his time, a fate many great artists suffer.
By the 1970s, Ghatak’s health had deteriorated. His battles with alcoholism took a toll on his body and mind. He took up a teaching position at FTII Pune, where he mentored future legends like Kumar Shahani and Mani Kaul. But even as a teacher, he remained an outcast—his ideas too radical, his methods too unorthodox. Ritwik Ghatak passed away in 1976, at the age of 50, largely forgotten by the mainstream. As with many great artists, the recognition for his exemplary contribution to cinema, came after death.
Today, Ghatak’s films are studied, dissected, and revered by cinephiles around the world. His influence can be seen in the works of filmmakers like Anurag Kashyap, Mira Nair, and Ashim Ahluwalia. In 2012, his film “Meghe Dhaka Tara” was ranked among the greatest Indian films of all time.
Ritwik Ghatak did not make films to entertain; he made them to provoke, to challenge, to shake audiences out of their apathy. He was a poet of pain, a chronicler of loss, a man who bled for his art. His films remain as relevant today as they were in his time, a reminder of the cost of division and the resilience of the human spirit.
If cinema is meant to reflect reality, then Ritwik Ghatak was its truest mirror. A mirror cracked, perhaps, but still capable of showing the truth.
সলিল চৌধুরী – কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি বিমুখ হওয়া সত্তেও নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে আজীবন কমিউনিস্ট হয়ে থেকে যাওয়া
দেবমিত্রা
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা
১৯৪১-৪২ সাল। বাংলা তথা গোটা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল কমিউনিস্ট পার্টি কার্যতন নিষিদ্ধ দিকে দিকে লাল ঝাণ্ডার কর্মী সমর্থকদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন সলিল চৌধুরী গণনাট্য সংঘের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে। ৩০ টাকা ভাতা ছিল তখন পার্টি সর্বক্ষণের কর্মীদের।
তাঁর বিভিন্ন গান তৎকালীন পরিস্থিতি ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ মেনে সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য লেখা। কমরেড বীরেশ মিশ্র এর অনুরোধে উত্তরবঙ্গ রেল শ্রমিকদের জন্য রেলগাড়ির চাকার শব্দের ছন্দে গান তৈরীর করেছিলেন “ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে, জাগছে জাগছে”।
১৯৪৮ সালে কাকদ্বীপ তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি গান বাঁধলেন “হেই সামহালো ধান হো, কাস্তে টা দাও সান হো, জান কবুল আর মানকবুল আর দেব না আর দেব না, রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো’।
তাঁর একটি গান “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা” লিখেছিলেন কলেজে পড়ার সময় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিচার নিয়েই।
ওনার আত্মজীবনী বা বিভিন্ন সাক্ষাৎকার পড়লে জানা যায়, যে পুরচাঁদ যোশি যখন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেই সময় সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটেছিল। গণনাট্য সংঘের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছিল এক ঝাঁক গুণী শিল্পীদের একত্রিত হওয়ার জন্যা এর মধ্যে ছিলেন বলরাজ সাহানি, পৃথ্বীরাজ কাপুর, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মুণাল সেন প্রমুখ শিল্পীরা। এই একই সংগঠনে যোগদান করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতন মানুষজন।
কিন্তু পার্টি সর্বক্ষণের কর্মী হওয়া সত্বেও একটা সময় পর পার্টির সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি সলিল চৌধুরী। তখন পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বি টি রণ দিতে। পার্টি তখন গ্রহণ করে জনযুদ্ধের নীতি। প্রতিবন্ধকতা আসতে শুরু করে গণনাট্যের কাজে পার্টি থেকে তাঁকে বলা হয় তাঁর গান জনসমক্ষে গাইভার ছাড়পত্র তখনই মিলবে যখন সেই গান পার্টি সেলকে দিয়ে অনুমোদন করানো হবে। একজন শিল্পীর কাছে এটি ছিল তাঁর শিল্পকে অবমাননার সমান। এই বিষয়ে সলিল চৌধুরীর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট যে পার্টির নেতৃত্বের সংগীত সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারনা নেই ফলে তাদের বিচার করার কোন যোগ্যতা থাকতে পারে না। রন্দ্ব শুরু হয় এখান থেকেই। এরপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন সময় দিশাহীন হয়ে পরে। অনিশ্চয়তা অরজগতায় ছেয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানান ক্ষেত্র। তিনি মনে করতেন এভাবে বেশি দূর পার্টি এগোতে পারবেনা। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বারবারই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল একটা বিষয়। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতন উপযুক্ত লোক পার্টিতে কম। যে গণনাট্য আন্দোলনকে সামনে রেখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি জয়যাত্রা শুরু করেছিল সেই সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট চলতে শুরু করলো বড্ড এলোমেলো ভাবে। রাজনীতির চর্চায় প্রাধান্য পেতে শুরু করল এবং পিছিয়ে পড়তে শুরু করল সাংস্কৃতিক চর্চা বহু প্রতিভাবান মানুষ যে মঞ্চে একত্রিত হয়েছিল সেই সমস্ত গুণী মানুষকে একত্র করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেনি কমিউনিস্ট পার্টি।
এরপর ১৯৫৩-৫৪ সাল নাগাদ সলিল চৌধুরী বম্বে চলে যান এবং যোগ দেন বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। তাঁর এই সিদ্ধান্তে পার্টি নেতারা বলেছিলেন “নৈতিক স্বালন”। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সলিল চৌধুরীর দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাঁর লেখা তিনটি নাটক “জনান্তিকে”, “এই মাটিতে” ও লেডি প্রতীর The Rising of The Moon অবলম্বনে “অরুণোদয়ের পথে” পার্টি নিষিদ্ধ করেছিল।
তাঁর মতে গাট্য সংঘ ভেঙ্গে যাওয়ার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে কমিউনিস্ট পার্টির। শিল্পীদের শিল্পের পরিধিকে ছোট করে অনা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক আলোচনাকে এড়িয়ে চলা, বিভিন্ন গান নাটককে নিষিদ্ধ করে দেওয়া, অযোগ্যদের দিয়ে গান বা নাটক সিনেমার গুণ নির্ধারণ করা এই সব কিছু নিয়েই সলিল চৌধুরীর যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল।
এরপর কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু তারা ভেবে দেখেননি সেইসব মানুষের কথা বা সেই সব গণনাট্য সংঘের কর্মীদের কথা যারা অনাহারে অর্থাভাবে এক গ্রাম থেকে অন্যত্র পায়ে হেটে গেছে। শুধুমাত্র সংঘের শক্তি বাড়ানোর জন্য, মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য, কমিউনিস্ট পার্টিকে আরও শক্তিশালী করবার জন্য
কমিউনিস্ট পার্টির দিক থেকে মুখ ফেরালেও আজীবন নিজের ভেতরে বামপন্থা কে লালন করেছেন সলিল চৌধুরী। তাই আজও যতবার খেটে খাওয়া মানুষের কথা আমরা বলবো ততবার তাঁর লেখা গান নাটক আমাদের সামনে সেই চাষী শ্রমিক মজুরদের কথা হয়েই থেকে যাবে।
মনের অলিতে আকাশবাতাস রিমঝিম ও একটি বাতাসিয়া গান
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
গান আর মন। মনোবিদরা মানুন বা মানুন, দুজনের ভিতর সংযোগ বড় গভীর। এই গভীরতা পেরিস্কোপ বা সোনোমিটার দিয়ে মাপতে যাওয়া আর মোনালিসার হাসি সেন্টিমিটারে লিখে নথি করা একই রকম মূর্খতা। বিখ্যাত দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট বলতেন, যা কিছু আজ পরিমাপ করা যাচ্ছে না, তা আসলে মানুষের গণিত বিশ্লেষণশক্তির অপরিণত ভাবের কারণে। একদিন গণিত এতৌটাই উন্নত হবে যে জীবনের প্রতিটি ছোট ছোট সুখ দুঃখ আবেগ যন্ত্রণা মেপে ফেলা যাবে কোনও মানদণ্ডে। মনের স্থিতির উপর সঙ্গীতের ফ্রভাবকে সরাসরি পরিমাপ করা যায় না বলেই হয়ত তথাকথিত মনোবিজ্ঞানীরা আজও সঙ্গীতকে পথ্য হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ছুতমার্গ মেনে চলেন। কোনও মনোবৈজ্ঞানিক সেমিনারে নতুন ওষুধ, ট্রাবলেট, আরটিএমএস এর মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি আলোচনা হলেও মিউজিক থেরাপি ব্রাত্য থেকে যায়। যদিও সেই আলোচনা সভায় একঘেয়েমিতে ভুগতে থাকা ব্যক্তিটি তার একঘেয়েমি কাটাতে কানে গুঁজে দেন ইয়ারফোন। সেখানে তার পছন্দর গান বেজে ওঠে। নিজের অজান্তেই মনোবিজ্ঞানী নিজেকে সঙ্গীতের কাছে সঁপে দেন। কিন্তু তিনি যে বিজ্ঞানী! তাই যা কিছু অপ্রমেয়, তাতে তার মান্যতার তাগিদ কম। ফলত মিউজিক থেরাপি তার কাছে গবেষণাধর্মিতার মান্যতা পায় না। সুরসম্রাট বিটোফেনের মতে সঙ্গীত হল জাগতিক অনুভূতি আর আধ্যাত্মিকতার ভিতর সেতু। বিটোফেন তার সৃজনীজীবনের চরম শিখরে শ্রবণক্ষমতা হারিয়েছিলেন। শৈশব থেকে কৈশোর যৌবনে অবদমিত আক্রোশ তিনি উজার করে দিতেন তার সিমফনির ‘স্ট্যাক্কাটো’তে। ঝমঝম করে অস্বাভাবিক জোরে বেজে ওঠা পিয়ানোর রিডের অন্তরালে আসল কারণ কি তা শ্রবণক্ষমতাহীনতা নাকি মানসিক অবদমন, এ নিয়ে নানান তাত্ত্বিক বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যা বিতর্কর ঊর্ধ্বে, তা হল বিটোফেনের সিমফনি শ্রোতার মনের ভিতর একধরনের অস্থিরতার জন্ম দেয়। এই অস্থিরতার কারণ সেই সঙ্গীতের আখার নির্মাণ ও বিন্যাস। ঠিক সংক্রামক ব্যাধির মতোই সেই অস্থিরতা স্রষ্টার উৎস থেকে শ্রোতার মোহনায় পৌছে যায়। অধিকাংশ আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা আজকাল অবশ্য ‘মন’ শব্দটির অস্তিত্ব মানেন না। ‘মন’ অব্যয়। দার্শনিক একটি অভিধা মাত্র। আসল হল মস্তিষ্ক স্নায়ু ও তাদের পারস্পরিক জৈবিক আদানপ্রদান। অথচ তার শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশের ভিতর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দর্শন সম্পর্কে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। একটা কাঁটাতার রচিত হয়েছে শিল্পী আর বিজ্ঞানীর ভিতরে। লিওনার্দো দা ভিন্সির বিজ্ঞানীজীবনের থেকে শিল্পজগতে প্রবেশ বা রেনে ডেকার্তের গণিত থেকে দর্শনে প্রবেশ এদেশের মনোবিজ্ঞানীর কাছে তৎকালীন বৈজ্ঞানিক অনগ্রসরতা। অথচ সঙ্গীত যে প্রত্যক্ষভাবে মস্তিষ্ক তরঙ্গে প্রভাব ফেলে তার প্রমাণ কিন্তু গবেষণায় মিলেছে।ঠিক যেমন ২০১৩ সালে ‘মিউজিক অ্যাণ্ড মেডিসিন’ জার্নালে মনোবিজ্ঞানী থমাস ফ্যাশনার ও তার সহগবেষকরা দেখাচ্ছেন কীভাবে মানুষের মস্তিষ্কর নির্দিষ্ট একটি অঞ্চল সঙ্গীতের জন্য চিহ্নিত। পাশ্চাত্য গবেষকদের কেউকেউ এই অঞ্চলকে ‘মিউজিক্যাল করটেক্স’ বলে থাকেন। ফ্যাশনার তার গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন সঙ্গীত সরাসরি ইইজিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে যার জন্যই হয়তো সঙ্গীত মনোজগতের উপর এতোটা প্রভাবশীল হতে পারে। এখন প্রশ্ন, পাশ্চাত্যে এমনকি দক্ষিণভারতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে এতো মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা হলেও পূর্বভারতে, বিশেষত অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গে মিউজিক থেরাপি এখনও সেই বাখ-মোজার্ট-শ্যুবার্টেই সীমাবদ্ধ আছে কেন? এর সম্ভিব্য দুটি কারণ। প্রথম। বঙ্গীয় সঙ্গীত ও মনোচিকিৎসাসম্ভাবনার শেষ সুযোগ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তারপর কিছুটা গবেষকদের ঔদাসিন্য, আর কিছুটা পরিকাঠামোগত ত্রুটি গবেষণাকে অগ্রবর্তী হতে দেয়নি। আন্তঃবিষয়ক গবেষণা এই অঞ্চলে তেমন জনপ্রিয় নয়। এখানে গবেষকরা মূলত একটা ‘স্ট্রাকচার’ মেনে চলেন যেখানে এক বিষয়ের ছাত্রছিত্রীর অন্য বিষয়ে গবেষণার তেমন স্বীকৃতি বা সুযোগ কোনওটাই নেই। বাংলা গান নিয়ে গবেষণাসম্পর্কে মনোবৈজ্ঞানিক ঔদাসিন্যর দ্বিতীয় কারণ বিপণন। ঔষধনির্মাতা, ঔষধবিক্রেতা ও তাদের তাৎক্ষণিক কার্যকারিতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিগূঢ় সত্য। সুশৃঙ্খল গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থটুকু সঙ্গীতগবেষণার ক্ষেত্রে হওয়া অসম্ভব কারণ কোনও ব্যবসায়িক সংগঠনের এই গবেষণা থেকে লব্ধ ফলাফলে সরাসরি উপকৃত হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই।এই সুদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা প্রয়োজন ছিল কারণ এই বাংলায় বসে অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাবার পরেও এমন একজন মানুষের গান নিয়ে মনোবিজ্ঞানে কোনও কাজ হল না, যাঁর সঙ্গীতভাবনা পাশ্চাত্যের মোৎসার্ট থেরাপির সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতপ্রয়োগের মেলবন্ধন হতে পারত। আর সেই অসামান্য সুরস্রষ্টার একটি অনন্যসাধারণ গান ও তার মনোবৈজ্ঞানিক প্রয়োগ নিয়ে এই আলোচনার মূলস্রোত হয়ে উঠবে। সেই মানুষটির নাম সলীল চৌধুরী। আর আমার পছন্দর সেই গানটি হল শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বিখ্যাত “শোনো কোনো একদিন আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়।”
কোনও মহৎ সঙ্গীত কীভাবে আসে একজন সুরস্রষ্টার কাছে। এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল এই সময়ের আরেকজন বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক ও চিন্তক দেবজ্যোতি মিশ্রর সঙ্গে। একজন সঙ্গীতপরিচালকের কাছে কীকরে একটি মহৎ গান আসে, এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, সঙ্গীত তার স্রষ্টার কাছে আসে ছায়ার মতো। তাকে অবয়ব দিতে হয়, ছবি আঁকতে হয় তার চোখের। তবু ছায়াটি থেকেই যায়। ইংরাজি ভাষায় যাকে বলা যায় একটি ‘অরা’। সেই ছায়া যখন তার শ্রোতাকে স্পর্শ করে তখন সেই মানুষটির ভিতরেও সেই সৃষ্টি এক আলোআঁধারি মায়া তৈরি করে। গাণিতিক সূচক দিয়ে তাঁকে পরিমাপ করতে যাওয়া মূর্খতা। ঠিক এই ছায়ার আশ্রয়টুকু নিয়ে এইবার কেন আমার পছন্দর এইগানটি, সেই অণুবিশ্লেষণে আসা যাক।
আধুনিক বাচিকধর্মী সঙ্গীতের কাঠামো নির্মিত হয় তার শব্দর ভিতর। সেই শব্দচয়ন সাবলীল অথচ তীক্ষ্ম ভাবে শ্রোতার অন্তরে হানা দেয়। আলোচ্য গানে সেই শব্দচয়ন পাঠ করলে নিশ্চিতভাবে মনে হবে এ এক বিষাদের গান। একঝলক পড়ে নেওয়া যাক গানের কথাগুলি। প্রথম স্তবক এইরকম।
“শোনো কোনও একদিন
আকাশ বাতাশ জুড়ে রিমঝিম বরষায়
দেখি
তোমার চুলের মতো মেঘ সব ছড়ানো
চাঁদের মুখের পাশে জড়ানো”
একটি ছোট শব্দ। ‘শোনো’। তারপরেই আকস্মিকভাবে পরপর অনেকগুলি শব্দ। আবার একটি ছোট শব্দ। ‘দেখি’। আবার শব্দপ্রপাত। প্রথম শব্দে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হল শ্রোতার সঙ্গে। দ্বিতীয়ে গায়ক নিজেও সেই কথোপকথনে জরিয়ে গেলেন। এই ধরনের অনেকগুলি কথোপকথন কবিতার আকারে পাওয়া যায় কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ সিরিজে। একটি ছোট শব্দর পরেই এই দীর্ঘ উচ্চারণ যেন এক আকস্মিকতা। সেই আকস্মিকতা কি এক হঠাৎ বিষাদের জন্ম দেওয়া দুর্ঘটনার ভিতরেও থাকে না? আর সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে ফিরে আসে ‘অবশেসন’ হয়ে। সেই কারণেই এই ‘মন হারালো’র ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হল। তারপরেই আকস্মিকভাবেই তার সমাপ্তি। ‘সেইদিন’। মনে হল গানের কথাগুলি যেন শেষ হয়ে এল এইখানে। ঠিক সেই মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে পরবর্তী পঙক্তি
“আরো একদিন
তামসী তমস্বিনী রাত্রি
ঘুম মুম নিঃঝুম
জীবন পথির সব যাত্রী”
এই পর্যায় গানের কথা বুঝিয়ে দিল এই গান রাতের গান। অন্ধকারের গান। যদি কবিতাথেরাপির শর্ত মেনে চলি, তাহলে অবসাদগ্রস্থ মনের সঙ্গে একধরনের সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে এই লাইনগুলিতে। এরপর কবি সরাসরি স্বীকার করবেন তিনি একলা। অস্তিত্বহীন। ঠিক যেমন বিষাদগ্রস্থতা মানুষের আত্মসচেতনতা কেড়ে নেয়।
“আমি একেলা
চলেছি নিরুদ্দেশ যাত্রী
রাতজাগা একপাখি
শুনি জীবনজয়ের গীতগাত্রী”
এই গানের পথ্যগত সুবিধা এখানেই যে সুরগত উত্তরণের পাশাপাশিই এই গানের কথাগুলির উত্তরণ ঘটছে। শেষ দুটি লাইনে সেই ইতিবাচক উতরাই লক্ষ্য করা যাবে। সেখানে ‘রাতজাগা’, ‘জীবনজয়ের’ শব্দগুলো এক অবসাদমুক্তির সংঘাতসম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। তারপরেই আসছে মীমাংসক লাইনটি।
“মনে হল মোর দুখরাতে যেমন করে ভোলাতে”
কে ভোলাতো? মা? বাবা? নাকি প্রেম? অতীত কেন? অর্থাৎ দুঃখের রোমন্থন। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল এই কথাগুলি স্বপ্নময় নোয়ার নৌকো হয়ে বিষাদ থেকে ইউফোরিয়ার দিকে উতরিয়ে দেবে পাঠককে ঠিক সেই সময় এই চরম দুঃখে মোচড় দিয়ে ওঠা এই লাইন। আবার যেন সেই দুঃখের আকস্মিকতায় শ্রোতাকে পৌছে দিল। একই সঙ্গে সে শ্রোতাকে পরবর্তী পর্যায় নিয়ে চলল। পরবর্তী পঙক্তি
“আরো একদিন
আমার খাঁচার পাখি চন্দনা
গীতহীনা, আনমনা
কী যে ভাবে বসে তা জানি না”
এখানেও একটা জিনিস চমকপ্রদভাবে লক্ষ্যনীয়। গীতহীনা আনমনা চন্দনা পাখিটি আসলে কবির প্রক্ষীপ্ত সত্তা। সেখানে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট। ‘আরো একদিন’ শব্দব্যবহারে বোঝা যায় এই অবসাদ কোনও একদিনের ঘটনা নয়। এটি একটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা প্রক্রিয়া। পরের লাইনগুলি এইমতো।
“সন্ধ্যাবেলায়
হঠাৎ ঘরেতে ফিরে দেখি
উড়ে গেছে, চলে গেছে
আমার খাঁচার পাখি চন্দনা”
এর চেয়ে সহজ শব্দচয়ন কী সম্ভব? খানিকটা অপরিণত শিশুসূলভ। এই সহজ শব্দচয়ন এই গানটির কথার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। প্রথমত এই সহজবোধ্যতা কথাগুলিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলছে। দ্বিতীয়ত একজন বিষাদগ্রস্থ মানুষের মনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে অতিরিক্ত রূপকের পরিবর্তে এই সহজগ্রাহ্যতাই হয়তো বেশি কাঙ্ক্ষিত। পথ্য হিসেবেও এটা একটি প্রয়োজনীয় দিক। যে মানুষ সত্যিই দুঃখী, তার কাছে কী শব্দালঙ্কার বা রূপক অনুধাবনের মতো মানসিক স্থিতি আশা করা যায়!গানের শেষ দুটি লাইন।
“মনে হল মোরে পিছে ফেলে
যেদিন তুমি চলে গেলে
মন হারালো হারালো মন হারালো”
এরপরে গানের সুরে একটি উত্তরণ ঘটেছে যা পরে অনুচ্ছেদে বলব। তবে গানের কথাগুলি ভাবতে ভাবতে মনে হল কবি একথা বারবার বোঝাতে চাইছেন, বিষাদ কোনও চিরন্তন ঘটনা নয়। তা সাময়িক। তাই তার থেকে উত্তরণও অবশ্যম্ভাবী। এটা পথ্যগত ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এরপর আসি গানের সুরবিন্যাসে। এই আলোচনায় ঢোকার আগে সলীল চৌধুরীর সুরচয়ন বিষয়ে কিছু বিষয় আমাদের মনে করে নিতে হবে।বাংলা গানের ধারায় একমাত্র সলীল চৌধুরীই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথম ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে আদি ভারতীয় সঙ্গীতের ধারাকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন। অবশ্য এই পরীক্ষা অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ তার গানের ভিতর শুরু করে দিয়েছিলেন। ধ্রুপদী ‘সোম-তাল-ফাঁক’ ভেঙে ‘ষষ্ঠী’ তাল তৈরির প্রচেষ্টা যেমন। সলীলের ক্ষেত্রে অবশ্য যুগপরিবর্তনের কারণেই হোক বা তাঁর অসামান্য ভিউজিক্যাল জিনিয়াসের জন্য হোক, সেই যোগবন্ধন নিজস্বতা পেয়েছিল। সিমফনি আর প্রোগ্রেশন এর ব্যবহার যেন বাংলা সঙ্গীত ইতিহাসে এক নতুন বাঁকপরিবর্তন। তাঁর অনেক গানের সুরেই প্রভাব বিস্তার করেছে মোৎসার্ট। আর ঠিক এইখানেই এক অদ্ভুত সমাপতন। ঠিক যেই পরিসরে এই গান মনের অলিতে গলিতে অবসাদ কাটিয়ে তোলার পথ্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে, ঠিক সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মনে রাখতে হবে ১৯৪৫ সাল পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ ফিরত পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসে আক্রান্ত সৈনিকদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়েছিল মোৎসার্ট সিমফনি। মনোবিদরা সেই গানের প্রয়োগ ও তার প্রভাবের নাম দিয়েছিলেন ‘মোৎসার্ট এফেক্ট’। তবে কি সুরের কাঠামোগত সমান্তরাল চলন এই ইউফোরিক আবেদনের পিছনে একটি কারণ? সলীল চৌধুরীর সুরের আরেকটি অসামান্য বৈশিষ্ট হল সরাসরি স্ট্রেট নোটে আরোহন ও অবরহণ। মনে করুন ‘আনন্দ’ সিনেমার ‘জিন্দাগি ক্যাইসি হ্যায় পহেলি’ গানটি আবহটি। এই মহান সুরস্রষ্টা বারবার গানকে মসৃণভাবে পর্ভতের শিখরে এনে আবার সমতলে এনে দিয়েছেন ‘সাইন ওয়েভ’ এর মতো। আর এই অবতরণ ঝটিকা না হয়ে খুব মসৃণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সুরের সঙ্গে অনুরণিত মনের তরঙ্গও হঠাৎ অবতরণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। তাঁর গানের আরো একটি বৈশিষ্ট্য তার সমাপ্তির নোটগুলি সবসময় উত্তমাঙ্গের হয়। ফলত একধরনের মানসিক উত্তরণ মিশে থাকে তার সুরে। আলোচ্য গানটিতে একদম শেষের ‘সেইদিন’ যেমন। এই গানে ধৈবত ও গান্ধারের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। আগেই বলেছি, সলীল সুরে বিশেষ আন্দোলিত স্বর না রাখায় গানটির স্বরগুলি সরাসরি তার কথাসমেত পৌছে যেতে পারছে তার শ্রোতার কাছে। ধৈবত আর গান্ধার মানসিক অবসাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই কারণেই দক্ষিণে ‘ভৈরবী’ ও ‘ভৈরব’ ধ্যান ও মনকে স্থির করার গবেষণায় ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে। গানটির শুরুর দিকের স্বরলিপিতে সব শুদ্ধ স্বর। এই শুদ্ধস্বর শ্রোতার সঙ্গে গানের প্রাথমিক আলাপ তৈরি করে নিচ্ছে।”সা ধা পা ধা”।”পাধাপামাপা”।মাপাগামাগারেগা সা। এরপর একঝলক গানের ম্যুডে ঢুকে পড়ছেন সুরকার কোমল নৈঋত ব্যবহারে। ঠিক এইখান থেকে বিষণ্ণ শ্রোতার মনের সঙ্গে গানটির একটি অনুরণন সৃষ্টি হতে শুরু করল। যাকে তাত্ত্বিক ভাবে ‘আইসোপ্রিন্সিপাল’ বলা হয়ে থাকে। তারপর চমকপ্রদ একটি অনুভূতি তৈরি হবে যখন গান ‘ মন হারালো হারালো’ পর্যায়ে পৌছোবে। ঠিক জলপ্রপাতের মতো নেমে আসা স্বরগুলি বিষাদঘন মনের মতো। তারপর হঠাৎ তা বিপরীতমুখী হয়ে ‘সেইদিন’। অবশ্য এই গানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আকৃতিটি একদম শেষ পর্যায়ের ‘মনে হল মোরে পিছে ফেলে’ আকুলতায় লুকনো। এখানে গানটি ঠিক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ঢঙে অক্টেভ পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তন হয়তো শ্রোতার মনেও তার অজান্তেই ঘটছে বলে একটা দুঃখের গান হওয়া সত্ত্বেও গানের শেষে একটা আনন্দর রেশ থেকে যাচ্ছে। এইখানেই লুকিয়ে সুরস্রষ্টার ম্যাজিক।
সবশেষে আসি গানটির ছন্দে। এই গানের ছন্দে খানিকটা প্যাগান মিউজিক বা ভবঘুরে ভাব আছে। অত্যন্ত সহজ সরল চার চার ছন্দকে প্রথম ভাগে কোয়ার্টেটে ভাঙা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এক যাত্রার প্রস্তুতি। গান তো আসলে একটি চলমান অভিজ্ঞতা। এক ভ্রমণ। গানটির সারাটি অঙ্গে এই চলমান ছন্দ যেন অনেকটা রেলগাড়ির শব্দর মতো। ঠিক এই রকম ছন্দগবেষণা দেখা যায় ‘টাইগার হিল’ গানটিতে। ব্যবহৃত হয়েছে ক্যাজুয়াল গিটার। যেমন কলেজের ফেস্টে ব্যবহৃত হয়। যেন কিছুই হয়নি। একটা যাত্রীবাহী অভিযানের পথে সামান্য কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। হোঁচট খেতে খেতেও সেই অভিযান থামছে না। চলছেই। প্রবহমানতা অবসাদকে চিরস্থায়ী হতে দেয় না। সে মনে করিয়ে দেয় ক্ষণভঙ্গবাদের কথা। মনোবিদ যেমন অবসাদে তার আর্ত রোগীকে বোঝান এই সময় সাময়িক। গানটি কথোপকথনের সুরে এমন এক স্বপ্ন মেঘ তৈরি করে দেয় যা মুহূর্তে যে কোনও অন্ধকারকে আলোয় বদলে দিতে পারে। ফলত এই গান আর অবসাদের গান নি হয়ে হয়ে ওঠে জীবনের গান। হতাশার বিষয় এটুকুই যে এই মণিরত্নভাণ্ডার আমাদের হাতের কাছে থাকলেও আমরা কেমন আজও শুধুই পাশ্চাত্যে সঙ্গীতপথ্যর রসদ খুঁজে চলি। খাঁচার পাখি চন্দনা কবে উড়ে যাবে মুক্ত আকাশে, আপাতত সেই অপেক্ষায়।
বিচারের সুর, গণতন্ত্রের গান – সলিলের প্রতিবাদী পথযাত্রা
সৌমী দত্ত
(অর্থনীতির শিক্ষকতা এবং গবেষণা। খণ্ড ত (ৎ) নাট্যদলের সদস্যা। নাটকের গান এবং তার নির্মাণ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ)
স্থায়ী: সলিল স্মৃতির সুর ও প্রথম পরিচয়
শুনেছিলাম, সংগীতের ক্ষমতা অসীম, সে একাধারে যেমন মানুষকে হাসায়, তেমনি অন্যদিকে সেই মানুষকেই কাঁদাতেও পারে—তবে আমার জীবনে গান শুধু এক আবেগের স্রোত নয়; গান হয়ে উঠেছে প্রশ্ন, প্রতিবাদ ও বিকল্প ভাবনার এক অবিচ্ছেদ্য হাতিয়ার। আমার আজ ও মনে পরে, আমার শৈশবে, আমার গানের মাস্টারমশায় আমাকে “বুলবুল পাখি, ময়না টিয়ে” গানটি শিখিয়েছিলেন। তখন জানতামনা গানটির সাথে সলিল চৌধুরীর কি যোগ, শুধু ডায়রির পাতায় গান আর স্বরলিপির ওপরে ডানদিক করে মাস্টারমশায় লিখে দিয়েছিলেন গীতিকার ও সুরকার – সলিল চৌধুরী। সেবছর পুজোয় আমার মা কিনেছিলেন ওই গানের ক্যাসেটটি, বলে রাখা ভালো সেসময় মানে বছর ২৭ আগে পুজোয় নতুন গানের এলবামের ক্যাসেটটা কেনাটা কিন্তু পুজোয় জামা কাপড় কেনার মতোই একটি রীতি ছিলো। পাড়ার প্যান্ডেল এ মাস্টারমশায় এর শেখানো সেসব গান – বুলবুল পাখি, ও আয়রে ছুটে আয় এই দুটি গান বেশ আনন্দ করে গাইলাম। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরের সাথে আমার পরিচয় খানিকটা এভাবেই। আমার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি সেই সলিলের গানে যেন আরও গভীরভাবে প্রবাহিত হয়। যখন আমি প্রাথমিক বয়সে প্রথমবার তাঁর গান শোনা শুরু করি, তখন সুর আর ছন্দ যেন শুধুই একটা সুখের অভিজ্ঞতা ছিল; পরবর্তীতে সলিলের গান আমাকে শিখিয়ে দিল যে, গান শুধুই বিনোদন নয়, গান হলো প্রতিবাদের, সাহস জাগানোর ও সত্যের সন্ধানের এক অবিচ্ছেদ্য হাতিয়ার।
অন্তরা: সুর থেকে চেতনায় উত্তরণ
এরপর বড় হয়ে যখন সলিল চৌধুরীর গান শুনতে শুরু করি, তখনও সেসব গান ছিল স্রেফ ভালো লাগা—অন্যরকম ভালো লাগা। তখনও জানতাম না, এই ভালো লাগা একদিন রূপ নেবে গভীর এক রাজনৈতিক বোধে, একপ্রকার শ্রুতিমান প্রতিরোধে। সেইসময় ‘রানার’ গানটি শুনেছিলাম একদিন রেডিওতে, গানটা শুনে কেন যে শিহরিত হয়েছিলাম বুঝিনি। কিন্তু গানটা যতবার তারপর শুনেছি, বারবার মনে হতো সুরের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত বিষাদ কিন্তু প্রতিবাদ লুকিয়ে আছে, তারপর ধীরে ধীরে পরিণত হওয়ার সময়টায় যখন চেতনার পরিধি ছড়াতে লাগল—তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবিচার যখন দৈনন্দিনভাবে মানসিক অস্থিরতা তৈরী করছিলো, উত্তর খুজছিলাম আমার এই অস্থিরতার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রশ্নগুলোর — তখনই একদিন শুনলাম, সত্যিকারের সলিলকে। “ও আলোর পথযাত্রী”, “ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে”, এইসব গণসংগীত একে একে খুলে ধরল সলিলের আর এক মুখ—প্রতিবাদের, প্রত্যয়ের, জনতার কণ্ঠস্বর। বুঝতে শুরু করলাম, সলিল চৌধুরী, যিনি একই সাথে সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, তিনি শুধু বিনোদনের জন্য গান লেখেননি; তাঁর গান ছিল সাহসী সংগ্রামের, জনতার অদৃশ্য কণ্ঠস্বর। তিনি গণসঙ্গীতের মাধ্যমে সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ও সুরকেই না নিজের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর গান শুনলে আজ ও মনে হয়—এ যেন কেবল গান নয়, এটা ইতিহাসের চলমান দলিল, যা আজকের দিনেও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, “যতদিন শ্রেণি থাকবে, ততদিন সুর থাকবে।” কিন্তু সম্প্রতি, আমার রাজ্য তথা দেশের এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আমি আবার সলিল চৌধুরীকে নতুন করে শুনেছি, সলিলের গান আজ আবার ফিরে এসেছে আমার জীবনে, নতুন অর্থে, নতুন এক যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে। আমার কর্মসূত্রে কলকাতার এক প্রান্তে যাওয়া হয় প্রতিদিন। সেদিন একদল চাকরিচ্যুত শিক্ষকের মিছিল দেখলাম। মুখে ক্ষোভ, কণ্ঠে দাবির জ্বালা। আমার মনে হল, আমরা কি সত্যিই কোনো অপরাধের বিচার করতে পারছি? বিচার কি শুধুই সাজানো নাটক হয়ে দাঁড়িয়েছে? নিরীহরা সাজার ভার বহন করছে, আর যারা অন্যায় করেছে—তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? এইসব ভাবনা আর ক্ষোভের মাঝখানে, হঠাৎই একদিন ইউটিউবের পরামর্শে ভেসে এল এক গান—”বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা”। এ গান আমি আগে শুনিনি, গানটি শুনে আমার ভেতরটা আলোড়িত হল। মনে হল—এই তো সেই গান, যা আমার আজকের রাজ্য তথা সমগ্র ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে ভীষণ প্রাসঙ্গিক –
“তোমার সভায় আমীর যারা,
ফাঁসির কাঠে ঝুলবে তারা।।
তোমার রাজা মহারাজা,
করজোরে মাগবে বিচার। “
এই গান শুধু অতীতের কোনো আন্দোলনের গান নয়, আজকের এই সময়ের প্রতিচ্ছবি। যেখানে অন্যায়কারীরা রয়ে গেল ক্ষমতার রক্ষাকবচে সুরক্ষিত, যেখানে প্রকৃত অর্থে বিচার নয়, চলছে বিচারনাট্যের প্রহসন – তাই আজ এই গানটি সম্মন্ধে কিছু লেখার আগে সলিল চৌধুরীর গণসংগীত এর উৎস সন্ধান করা যাক?
সঞ্চারী: গণসংগীতের সন্ধান ও উৎস
সলিলের জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরিবেশ ছিল সংগ্রামের মিছিলের মাঝখানে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে কাটানো তাঁর শৈশব, যেখানে শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট ও কৃষকদের পরিশ্রমের দৃশ্য প্রায় চিরন্তন স্মৃতি হয়ে উঠেছিল, সেই বাস্তবতা তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছিল গণসঙ্গীত রচনার জন্য। সলিল চৌধুরীর গণসংগীত রচনার শুরু কিন্তু গণনাট্য সংঘ গড়ে ওঠার বেশ কিছু আগে থেকেই। সলিল তাঁর মামারবাড়ি কোদালিয়া গ্রামে (বর্তমান নাম- সুভাষগ্রাম) থাকাকালীন ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র সলিল তখন তৎকালীন বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্রবে এসেছেন , সময় ১৯৪১-৪২, তিনি তখন বাঁশি বাজাচ্ছেন তাঁর গ্রামে , আন্ত:কলেজীয় প্রতিযোগিতা। এর সাথে তিনি একটি নাচেরপার্টিতে তিনি ঢুকেছেন মিউসিক ডিরেক্টর সুশান্ত ব্যানার্জী তিমিরবরণের সহকারী হিসেব। সেসময় বিদ্যাধরী নদী মজে যাওয়ার ফলে ভূমিহীন কৃষকদের ব্রিটিশসরকারের কাছে থাকা বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কৃষক আন্দোলন, সেসময় পিপলস রিলিফ কমিটির একটি শাখা গড়ে ওঠে কোদালিয়া গ্রামে,আর এই সময় সলিল তাঁর অজান্তেই যুক্ত হওয়ার যান এই কাজে। সেখানেই সন্দেশখালির কৃষক সম্মেলনে কৃষক নেতাদের অনুরোধ তথা আবদারে তিনি ১৮-১৯ বছর বয়সে প্রথমবার ভাটিয়ালি সুরের ওপর ভিত্তি করে এক প্রতিবাদী গান বাঁধলেন – ” দেশ ভেসেছে বানের জলে, ধান গিয়েছে মরে, কেমনে বলিব বন্ধু, প্রাণের কথা তোরে”। শ্যামবাজার থেকে লঞ্চে করে সলিলকে নিয়ে যাওয়া হয় সন্দেশখালি, সঙ্গী তাঁর বাবার দেওয়া সিঙ্গেল রিডের ছোট্ট হারমোনিয়াম। শোনা যায়, সে গান এতটাই সাড়া ফেলে যে সভায় সে গান তাকে একাধিকবার গেয়ে শোনাতে হয় সবার অনুরোধে। আর এই তার গণসংগীতের পথে যাত্রা শুরু। এইসময় ছেলেদের নিয়ে গানের দল খুললেন সলিলবাবু। সে দল গোটা চব্বিশ পরগনা জুড়ে গান গেয়ে বেড়াতো। কৃষকের দাবি, জমিদারপ্রথার শোষণ ও শাসন ব্যবস্থার প্রতিবাদ, ‘লাঙল যার জমি তার’ আন্দোলন – ইত্যাদি নিয়ে গান বাঁধা শুরু করলেন সলিল চৌধুরী।
আভোগ: “বিচারপতি তোমার বিচার” – ইতিহাসের সুর ও আজকের প্রতিধ্বনি
ফিরে দেখা যাক ১৯৪৫ সাল- সেই সময় অবিভক্ত বাংলা তথা দেশজুড়ে চলছে দেশি বিদেশী পুলিশি অত্যাচারসর্বস্ব মর্মান্তিক ঘটনা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের বিচারের নামে বিদেশী আদালতে বিচারের নামে প্রহসন। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৫ জুড়ে ছিল অস্থিরতা, আর্তনাদ, একদিকে তৎকালীন বাংলায় রংপুরের ছাত্রসম্মেলন, অন্যদিকে বন্দিমুক্তি আন্দোলন জোরদার- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের বন্দিদের আন্দামান থেকে ফেরত এনে তাদের পুনর্বিচারের কথা ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার, আই এন এ -র যুদ্ধবন্দীদের লালকেল্লায় পুনর্বিচারের ঘোষণা হয়। সবমিলিয়ে তৎকালীন বাংলায় তখন রাজনৈতিক তথা সামাজিক অস্থিরতা দৃশ্যমান। সেই রংপুরের ছাত্র সম্মেলনের জন্যই গান রচনা করলেন সলিল চেধুরী, সে গান গাইলেন রংপুরের ছাত্রসম্মেলনে –
“বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা।।
তোমার গুলির, তোমার ফাঁসির,
তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা
ও জনতা এই জনতা এই জনতা।।”
সম্মেলন চলাকালীন তাঁকে অন্তত ১০বার গাইতে হয় এই গানটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তখন ও সলিল চৌধুরী ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (IPTA) অর্থাৎ ভারতীয় গণনাট্যসংঘের সদস্য হননি। যেহেতু বাংলার কীর্তনাঙ্গের গান মূলত প্রেমরসের, ভক্তিরসের গান, তাই বেশ কিছু পেশাদার সুরকার মনে করেন, ওই অঙ্গে বলিষ্ঠ গান রচনা সম্ভব নয়। সলিল চৌধুরী কিন্তু উক্ত গানটি রচনা করলেন “যমুনে তুমি কি সেই যমুনে প্রবাহিনী” গানটির সুরকে ভেঙে। এই গানের সুর রচনা প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিআন্দোলনের সময় হাজার হাজার মানুষ তাঁর এই গানটি গেয়েছেন এবং মিছিলে সামিল হয়েছেন। কীর্তনাঙ্গের গানের সুরে গাঁথা “বিচারপতি” গানটি এভাবেই প্রতিবাদের বলিষ্ঠতার এক উল্যেখযোগ্য নজির গড়ে তুলেছিল তৎকালীন সমাজে। তাই সুরকার সলিল চৌধুরীর মতে, কোন সুর কিভাবে শ্রোতাদের মনে কোন রস উৎপাদন করবে তা সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করে সুরকারের প্রয়োগপদ্ধতির উপর। এই যেমন, আসামের বিহু গানের সুর – এই সুর তো মূলত আনন্দোচ্ছল প্রেমরসাত্মক নৃত্যের সহযোগী একধরণের সংগীত। সে সুরের ভরসাতেও সলিল রচনা করেছেন এক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গান – ” ও মোদের দেশবাসীরে, আয়রে পরান ভাই, আয়রে রহিম ভাই, কালো যদি কে হবি পার। এ গানের সুর যেন একজ উদ্দীপ্ত আহ্বান কে প্রস্ফুটিত করে।
যাইহোক, ” বিচারপতি তোমার বিচার” গান সারা ফেলে দেয় সারা বাংলায়। তাঁর জীবন বইতে শুরু করে কোনো এক অজানা খাতে। নাচের পার্টিতে বাঁশি বাজানোর চাকরি ছাড়লেন তিনি, ১৯৪৫ সালে, একটা নাচের অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়ে তিনি পেতেন প্রায় ৫০টাক। কিন্তু এত মানুষের ভালোবাসা, বাংলা তথা দেশের রাজনৈতিক তথা সামাজিক নৈরাশ্যের কাছে ৫০ টাকা নেহাতই কম পড়েছিল বোধহয়।
‘বিচারপতি’ গানটি আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও কেবলমাত্র গান নয়, এ যেন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূত্রপাত—যেখানে প্রেমরসের আঙ্গিক ভেঙে জন্ম নেয় প্রতিবাদের ভাষা, যেখানে আনন্দের সুরে গড়ে ওঠে গণআন্দোলনের বীজ। সেই সুর শুনে শিহরিত হয়ে উঠি বারবার। এই গানটির মাধ্যমে আজ ও যেন ধ্বনিত হচ্ছে সেসময়ের ইতিহাসের আর্তনাদ, নিপীড়িত জনতার ভাষাহীন আকুতি, যা আজকের কঠিন সময়ের ও প্রতিচ্ছবি। আজ ও যেখানে অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন আর বিচারহীনতার কোলাহলে হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর, আমি আশাবাদী, ঠিক সেখানেই সেইখানে সলিলের এই গানগুলি হয়ে উঠবে প্রতিবাদে ভাষা, জনতার কণ্ঠ।
শেষের কথা
সলিল চৌধুরীর গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণসঙ্গীত কেবল রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা এক ধরণের আত্মচেতনার জাগরণ। আজকের অস্থির সময়ে যখন সমাজ আবারও প্রশ্নে, সংকটে, ক্ষোভে বিদীর্ণ, তখন এই গান যেন নতুন প্রাণ পায়—বিচার, ন্যায় ও মানবিকতার এক নীরব অথচ বজ্রধ্বনিত দাবি হয়ে। সলিল চৌধুরী হয়তো আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর গান, তাঁর সুর, তাঁর প্রশ্ন আজও প্রতিধ্বনিত হয় বাতাসে—“তোমার গুলির, তোমার ফাঁসির… শুধবে তারা, ও জনতা।” আজও আমাদের অনুরণনে, অস্থিরতার বিপরীতে সাহসের আলো হয়ে বাজে এ গান –
“নিঃস্ব যারা সর্বহারা তোমার বিচারে।
সেই নিপীড়িত জনগণের পায়ের ধারে।।
ক্ষমা তোমায় চাইতে হবে
নামিয়ে মাথা হে বিধাতা।।
রক্ত দিয়ে শুধতে হবে।
নামিয়ে মাথা হে বিধাতা।।
ঠিক যেন তা এই জনতা, এই জনতা।
বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা।।“
শতবর্ষে ঋত্বিক: কার্তুজ আর ফ্যানের গন্ধে মোড়া এক স্পিরিচুয়াল লে-ম্যান
ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার মত ঋত্বিকের ছোটগল্পগুলো সমভাবে চর্চিত নয়। ঋত্বিক সারা জীবনে বেশ কিছু ছোট গল্প লিখেছেন, তার কিছু পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এযাবৎ, বাকি এখনও কালের গর্ভে। সিরিয়াস ছোটগল্পকার হিসেবে ঋত্বিক নিজেকে দেখতেন কি না বা কতদিন দেখেছেন–সেটাও একটা প্রশ্ন। ছোট গল্প বা অণুগল্পের আশ্চর্য আবেদন এবং পাঠকমনে প্রভাব সম্পর্কে ঋত্বিক অবহিত ছিলেন অবশ্যই–সম্ভবত তিনি বাকি মিডিয়াম নিয়ে কাজ করার ব্যস্ততার ফাঁকে ‘গল্পকার ঋত্বিক’ সত্ত্বার থেকে খানিক দূরে চলে গিয়েছিলেন। এই দূরে চলে যাওয়া অবশ্যই বাহ্যিক দূরত্ব, মন থেকে নয়।
ঋত্বিকের ছোটগল্প পড়লে একটা কথা বড় স্পষ্ট করে মনে হয়–এই গল্পসমূহে পাঠকের তৃষ্ণা মেটানোর কোনও সচেতন প্রচেষ্টা নেই। কোন গল্প পাঠক শুনতে চায়–এ প্রশ্নের মুখে নিজেকে ফেলেননি ঋত্বিক। ‘আমি যা অনুভব করছি’ এবং ‘যে কথা বলা দরকার বলে আমি মনে করি’– এই দুটি সহজ শর্তে ঋত্বিকের কলম চলেছে। অনুভবে যা সত্য এবং যে সত্য বলা প্রয়োজন– তা বলতে বলতে গিয়ে ঋত্বিকের ছোটগল্প ইতিহাস এবং ভূগোলের সীমানা মানে নি। সুভদ্রা-অর্জুনের গান্ধর্ব বিবাহ, মানভূম অঞ্চলের কোলিয়ারি-তে শ্রমিকজীবন, ‘আজাদ কাশ্মীর’ ইস্যু নিয়ে গণ খুনোখুনির রাজনীতি, অন্ধকার পদ্মাপাড়ের অবাঙমানসগোচর অনুভূতি– ছিন্ন ছিন্ন নানা চিত্রকল্প দিয়ে ঋত্বিকের ছোটগল্পের বুনন, যা একান্ত ঋত্বিকেরই মত। তাঁর গল্পের বিষয় যেন তাঁরই মনের মাঝে জমে থাকা মেঘ, গল্পগুলো যেন দু-এক পশলা বৃষ্টি, যা খানিক আভাস দেয় সেই অন্তর্লীন মেঘের, কিন্তু সবটা দেয় না।
ঋত্বিক কি স্পিরিচুয়ালিস্ট? অন্তত ছোটগল্পকার হিসেবে ঋত্বিককে যদি দেখা হয়, তবে সেসব গল্পের কয়েকটিতে অন্তত ঋত্বিকের আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব পাঠকের নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। এমন একটি আশ্চর্য গল্প হল ‘অয়নান্ত’। সে গল্পে প্রোটাগনিস্ট হয়ত ঋত্বিক নিজেই। উত্তমপুরুষের বিবৃতিতে পুরো গল্প জুড়েই মানুষের জীবন এবং মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে এক কলেজ পড়ুয়া কিশোরের অবিরাম এবং কখনও পরস্পরবিরোধী চিন্তার স্রোত। সে খুঁজছে, অথচ কী খুঁজছে তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। সে এই পৃথিবী দেখে– সব রয়েছে, ঘরদোর, সংসার, কলেজের পড়া– অথচ তার কাছে মনে হয় সত্য যেন আবরণে ঢাকা। কখনও দার্শনিকতা দিয়ে কখনো বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা দিয়ে সে আপন কল্পলোকে এই অসীম রহস্যকে ভেঙে বোঝবার চেষ্টা করে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে, অথচ কোনও দিশা পায় না। বোদলেয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ, সে গোটা পৃথিবীর সাহিত্য খুঁড়ে খুঁড়ে দেখে, পথের সন্ধান কোথায়? শেষে সে ঠিক করে, এভাবে হবে না। তাকে সব ছেড়ে যেতে হবে, এই পিছুটান, এই মায়া যতদিন থাকবে ততদিন সত্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। কৈশোরের ব্যর্থ প্রেম সংক্রান্ত হতাশা নয়, লেখাপড়ার প্রতি অনীহা নয়– শুধু এক মনে বসে সে ভাববে বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। গল্প এখানেই শেষ, কিন্তু ঋত্বিকের ভাবনা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে।
পুরুষ ও প্রকৃতি কীভাবে চুম্বকীয় টানে একে অপরের কাছে ধরা দেয়, সাংখ্য দর্শনের এই মূল ভাবনাটি ঋত্বিক নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেশ কিছু গল্পে ধরেছেন। কিছু গল্পে বাস্তব ও পরাবাস্তব মিলেমিশে লীন হয়ে গেছে, দেবী সরস্বতী স্বয়ং এসে দাঁড়িয়েছেন এক মাতালের সামনে, যে বীণা বাজিয়ে ঝংকার তুলতে চায় বিশ্ব সংসারে। সরস্বতী এসেছেন বটে, কিন্তু বরদাত্রী মাতৃরূপে নয়, তিনি এসেছেন প্রেমিকা হয়ে, প্রেমের প্রস্তাব বয়ে। মাতাল প্রেমিকের পাগলামিতে সাড়া দিয়ে দেবী নিজেই হাতে বীণ তুলে নিয়ে বাজাচ্ছেন, মধ্যরাত্রের অরণ্য ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। এ গল্পের শেষ লাইনটি তাৎপর্যপূর্ণ, ঋত্বিক লিখছেন ‘জগৎ এইখানেই শেষ।’ পুরুষ মিলে গেল প্রকৃতিতে আর প্রকৃতি পুরুষে– পূর্ণম। ছোটগল্পকার ঋত্বিককে যেন প্রায় বৈদান্তিক ভাষ্যকারদের মত শোনায়।
আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে দেহ ও মনের মৃত্যু ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। মৃত্যুর দূরের নয়, মৃত্যু যেন ঘরের লোক। এখনই যেন পাশের টেবিলে এসে বসে কুপির আবছা অন্ধকার আলোয় নিমগ্ন হয়ে গূঢ় কোনও কবিতা লিখছে। জীবনের পাশাপাশি মৃত্যুতেও জেগে থাকা, এ বৈশিষ্ট্য ঋত্বিকের চিরকালীন। ঋত্বিকের প্রায় প্রতিটি ছোটগল্পে কোনও না কোনও ভাবে মৃত্যু এসেছে, কখনো তা অকস্মাৎ। সরকারি সেচ প্রকল্পের কোপে নদীর ধারে শতাব্দী পার করা গাছের মৃত্যু হোক অথবা অন্ধকার পদ্মা পাড়ে প্রেম করতে এসে চাঁদের আলোয় উন্মাদবৎ হয়ে গিয়ে মুহূর্ত ধরে রাখার অছিলায় প্রেমিকারই খোলা চুলের ফাঁস ঘাতক ময়ালের মত শ্বাসরুদ্ধ করছে, জীবন মৃত্যুর ওপারে থেকে যাচ্ছে শুধু একটি মুহূর্ত– এ ধরনের আশ্চর্য, প্রায় শিউরে তোলার মত দৃশ্যকল্প ঋত্বিক বারবার নিজের ছোটগল্পে ব্যবহার করেছেন।
এই পৃথিবী, এই জগত, মানুষের বাসনাবিলাস ও নৈরাশ্য– সব যে স্বপ্নের ইথার, উড়ে যাচ্ছে পল অনুপল অথচ ধরা যাবে না মুঠোয়– এই দার্শনিকতা ঋত্বিকের লেখার পরতে পরতে। অথচ তাঁর লেখা এমন কিছু ছোট গল্প রয়েছে এবং বেশ কিছু সিনেমাও– যা থেকে তাঁকে বস্তুবাদী মনে হয়। মাটির জন্য, ভাতের জন্য, ভাষার জন্য মানুষের যে চিরন্তন আবেগ এবং সে আবেগজনিত অব্যক্ত অভিব্যক্তি– এই মূল সুরটি ঋত্বিক নিজের সব রকম আর্ট ফর্মেই ধরেছেন। তবু তাঁকে রিডাকশনিস্ট মেটেরিয়ালিজমের পূজারী বলে ধরে নেওয়াটা এক প্রকার লঘুতা– বাহ্যিক পৃথিবীতে যা সত্য তা শাশ্বত নয় চিরন্তন নয়, বরং তা অপসৃয়মান, এ কথা জেনেও ঋত্বিক নিজের সারাজীবনের কাজের প্রায় সবটাই মানুষের ক্লেশ এবং যুদ্ধকেই উৎসর্গ করেছেন– ‘এ তোমাদের হিউম্যান কনস্ট্রাক্ট, যা ব্যবহারিক সত্য তা পারমার্থিক সত্য নয়’– এই কথা বলে মানুষের মনের গভীরতম খাদে নিজ অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় টেলিস্কোপিক অনুসন্ধান বন্ধ করেননি কখনও। শতবর্ষে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটকের সার্থকতা সবচেয়ে বেশি হয়ত এখানেই– তিনি অসামান্য পরিচালক, অনবদ্য চিত্রনাট্যকার বা সার্থক ছোটগল্পকার– এসব পরিচয়ের থেকে আরও বড় পরিচয়, তিনি মনের ভেতরবাড়ির লোক, তাঁর যুক্তি-তক্কো সব মন নিয়েই।
আর অবশ্যই, জীবনভর চলে আসা গল্পটাও।
The Fractured World of Ritwik Ghatak: Cinema as Memory and Resistance
Shreyan Chatterjee
Introduction
Ritwik Ghatak, I’ve come to realize through my research, wasn’t just a filmmaker—he was a witness to one of the greatest tragedies of modern South Asia. The Partition of India in 1947 didn’t just divide land; it ripped through the hearts and histories of millions, especially in Bengal. While several films have attempted to capture this moment, Ghatak’s cinema hit differently. It wasn’t just honest—it was gut-wrenching. His films didn’t just tell stories; they made you feel the aftershocks of loss, silence, and survival. As I studied his work, what struck me was how he used film not as escapism, but as confrontation. His stories, though fictional, seemed to echo a deeply personal truth—one that he lived, and one that many still carry. The more I watched and read, the more I understood that his themes—Partition, caste, disillusionment, corruption, and fractured family bonds—weren’t just ideas. They were lived realities, and Ghatak turned them into powerful visual metaphors that continue to resonate.
Partition and the Wound That Never Heals
The Partition, for Ghatak, wasn’t just history—it was his life. Born in Dhaka, he saw what it meant to be displaced, to lose a home not because of war, but because of politics. That experience left a mark on him, and it runs through every frame of his films. Watching Meghe Dhaka Tara (1960), I couldn’t shake off Nita’s cry—“Dada, ami bachte chai” (Brother, I want to live). That moment doesn’t just belong to her. It belongs to everyone who was abandoned by history. I felt that line lodge itself somewhere deep, and from that point, I couldn’t unsee the pain layered into her sacrifices.
In Komal Gandhar (1961), I noticed how the conflict within a theatre group became a metaphor for a divided society. At first, I thought it was just a subplot. But as I read more and reflected on it, I realized Ghatak was drawing parallels between fractured ideologies and fractured nations. The broken relationships on stage were his way of showing how people failed to hold on—both emotionally and ideologically—after Partition.
Then there’s Subarnarekha (1962). That film hit hard. Watching a family try to rebuild in a world that has moved on without them—it made me think of all the untold stories that never made it to history books. The barren riverbanks and wide, lonely shots aren’t just cinematic choices. They reflect the emptiness left behind after being uprooted.
In Titash Ekti Nadir Naam (1973), Ghatak shifts focus to a fishing community. Their collapse mirrored the societal breakdown I kept seeing in his work. As I read about the background of these films, it became clear—Ghatak wasn’t interested in pointing fingers. He just wanted to show the silence that follows violence. His characters aren’t heroes—they’re ordinary people trying to make sense of a world that no longer belongs to them.
Caste, Corruption, and Ideological Collapse
One thing I found while watching and reading about Subarnarekha was Ghatak’s rage against the caste system. The love story between a Brahmin girl and a Dalit boy isn’t just forbidden—it’s doomed. The system doesn’t allow love, and Ghatak shows how it destroys without mercy. That injustice felt loud, even when the scenes were quiet. It made me think about how many lives must’ve broken under that same weight, unnoticed.
In Titash Ekti Nadir Naam, he did something similar. He brought out the struggles of fishermen, a community already pushed to the margins. The river—their source of life—starts to vanish. The symbolism was powerful. Ghatak used that drying river to represent how caste and class systems don’t just divide—they erode.
Then came Reason, Debate and a Story (1974), and I saw a different kind of despair. Ghatak plays Nilkantha, a man who’s clearly burned out by the very ideologies he once believed in. From what I learned, Ghatak had been part of IPTA and deeply influenced by Marxism. But something broke along the way. Watching Nilkantha drink, stumble, and reflect—I couldn’t help but feel I was watching Ghatak himself, torn between hope and cynicism.
I started noticing this theme in Komal Gandhar, too. The theatre group, which should’ve stood for solidarity, is falling apart under ego and ideology. It reminded me that idealism, when unchecked, can rot from the inside. Ghatak never sermonized, though. He simply showed how people lose faith—slowly, painfully.
When it comes to corruption, Ghatak never made it about money or politics. His idea of corruption was more subtle—more devastating. In Meghe Dhaka Tara, Nita’s family isn’t villainous. They’re just… human. And that’s what makes it worse. They drain her dry without even realizing it. That’s the kind of emotional corruption Ghatak cared about. It stayed with me, long after the credits rolled.
Family, Fragmented and Fading
This part of Ghatak’s work really shook me. In Bengali culture, family is everything. But Ghatak shows us what happens when even that crumbles. Meghe Dhaka Tara again stood out. Nita gives everything—her time, her dreams, her body—to keep her family afloat. And what does she get? Isolation. Her pain isn’t loud, but it’s all-consuming. Watching her sit alone, often in shadows, surrounded by silence—it hurt.
In Subarnarekha, Ishwar thinks he’s protecting his sister. But in trying to shield her, he isolates her. His ideals turn into a cage. By the end, he’s lost everything, and the look on his face says it all: he thought he was saving his family, but he only helped break it.
Titash brought the idea of a “community as family” into focus. As the fishing village disintegrates, so does every bond they once held sacred. That one scene—where a mother searches for her lost son by the dried-up riverbank—just tore at me. I saw in it the loss of tradition, home, and hope.
Even Jukti Takko Aar Gappo felt like a personal diary. Nilkantha’s family is already broken. His ideals failed, his marriage is cold, and he’s emotionally distant from his child. There’s a scene where he walks alone, lost in thought, and I remember thinking—this man isn’t just physically isolated, he’s emotionally exiled.
Ghatak never sugarcoated family. He showed how poverty, history, and pride chip away at even the strongest bonds. He wasn’t saying families are bad—he was saying they’re fragile. And when the world is already falling apart, even love can struggle to survive.
Conclusion
Watching Ritwik Ghatak’s films was not just an academic journey for me—it was an emotional one. These films aren’t comfortable. They don’t give you a hero to root for or a happy ending to hold on to. But they stay with you. They haunt you—in a good way. Ghatak used cinema to say what history books often skip. He remembered the people who got left behind.
Through the trauma of Partition, the brutality of caste, the failure of ideologies, and the fragility of family, Ghatak told us truths that are still relevant today. As someone trying to make sense of the world through research and storytelling, I found in Ghatak’s work a kind of honesty that’s rare. His films made me feel more than just sadness—they made me think. And maybe that’s his greatest legacy: he didn’t just make films. He made people feel history. He made us remember.