চতুর্থ বর্ষ-প্রথম সংখ্যা-সম্পাদকীয়
১৪৩২ সন। আরও একটি নতুন বাংলা বছর। নববর্ষের দোরগোড়ায়, পৃথিবীর উষ্ণতা চূড়ান্ত মাত্রা ছুঁয়েছে, বরফ গলছে, বন পুড়ছে, আর ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বিস্ফারিত হচ্ছে এক নীরব মহাসূচনার মতো। শুধু কি শূন্যতার দায়ভার? নাকি এক যৌথ আত্মজিজ্ঞাসার অনিবার্য মুহূর্ত? যখন আমাদের দেশ তথা রাজ্যেরও অবস্থা শোচনীয়। দুর্নীতির চাদরে ঢেকে গেছে পায়ের তলার সবুজ ঘাস থেকে হাইরাইজের ছাদ থেকে দেখা আকাশ। সরকারের ইচ্ছাকৃত অবহেলা, এবং সরকারি প্রবঞ্চনার জন্য চাকরি গেল ছাব্বিশ হাজারের। স্বাস্থ্য, খাদ্য, বালি, খাদান তো ছিলোই। শিক্ষা ব্যবস্থাকেও দুর্নীতির আঙিনায় নিয়ে আসায় একটা জাতিকে বৌদ্ধিক, মননগত ভাবে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। দুর্নীতির পক্ষ নিয়ে সামগ্রিক সিস্টেম তৈরি করেছে এক মায়ানগর- যেখানে বাস করা জনগণকে সবাইকে ‘ভলান্টিয়ার’ বলা হয়। গণতন্ত্র, বিরোধী পক্ষ, বিদ্ধজন, নাগরিক সমাজ সবাই চুপ! এই ২০২৫ সাল এক অদ্ভুত সংযোগের সময়। জন্মশতবর্ষে পৌঁছেছেন বাংলার দুই মহীরুহ—সলিল চৌধুরী ও ঋত্বিক ঘটক। “আকাশ ঝুঁকে আসে যখন একটি বাঁশি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর মানুষের শরীর থেকে রাষ্ট্র উঠে যায় মাংসের মতো…”এ বছরটা কেবল ক্যালেন্ডারে লেখা এক সংখ্যার পালাবদল নয়—এ বছর দুই মহাযোদ্ধার জন্মশতবর্ষ। সলিল চৌধুরী। ঋত্বিক ঘটক। একজন সুর দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছেন, অন্যজন ক্যামেরায় ধরেছেন ধ্বংসের অলিখিত সংবিধান। তাঁদের সৃষ্টি আজকের প্রেক্ষিতে এক রহস্যজনক ভবিষ্যদ্বাণীর মতো— যেন তাঁরা দেখেছিলেন এই পৃথিবী কীভাবে নিজের গলায় নিজেরই হাতে ছুরি চালাবে।এই শতবর্ষ কেবল উদযাপন নয়। এ এক নিঃশব্দ সায়াহ্ন—যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি অস্তিত্বের প্রশ্ন নিয়ে। ঋত্বিক বলেছিলেন—”আমি ভবিষ্যতের ইতিহাসের জন্য ছবি করি।” সলিল বলেছিলেন—”সঙ্গীত যেন সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়।”
“চলচ্চিত্র পরিচালক” হয়েও—ঘটক ছিলেন ক্ষুধার, বেদনার, রাষ্ট্রহীনতার, স্বপ্নভঙ্গের পুরোহিত। তিনি জানতেন, দেশভাগ একদিন কাগজে-কলমে থেমে যাবে, কিন্তু মানুষের মন থেকে কখনো যাবে না। তিনি বুঝেছিলেন, রাষ্ট্র কখনোই মা হতে পারে না—হয়তো দাদাগিরি করতে পারে, বন্দুক চালাতে পারে, কিন্তু কোনও উষ্ণতা দিতে পারে না।আজ, যখন জল নেই, ঘর নেই, গাছ নেই, তখন ঋত্বিক ঘটক যেন আরেকবার ফিরে আসেন— একটি হাহাকারের অনুবাদ হয়ে, একটি ভবিষ্যতের লাশ হয়ে।সলিলের সুর কখনো বৃষ্টির মতো মৃদু ছিল না— তা ছিল বজ্রের মতো নির্দয়, প্রলয়ের মতো আবেগময়। “জয় বীর নকশাল”—এই সুর আজও বাতাসে উড়ে বেড়ায়, যদিও সেই বিদ্রোহের শরীরগুলো এখন মাটির নীচে শুয়ে । সলিল চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ, যেখানে গান মানে শুধু প্রেম নয়— গান মানে প্রতিবাদ। গান মানে বঞ্চনা, শোষণ, কন্ঠরোধ, তঞ্চকতার বিরুদ্ধে কুঠারের প্রতিরোধ। আজকের কৃত্রিম সভ্যতার ভেতরে যখন গান কেবল কনসার্ট আর কমার্শিয়ালাইজেশনের হিংস্রতা, তখন সলিলের সুর ফিরে আসে একটুকরো বিবেক হয়ে— এক চিৎকার, যা আমরা শুনি না তা নয়- শুনতে চাই না।!!! অপরদিকে, পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে না, পৃথিবী মরছে। আর একে হত্যা করছে তারা—যারা বিলিয়ন ডলারের স্বপ্নে পৃথিবীর ফুসফুস বিক্রি করে দিচ্ছে।জলবায়ু সংকট কোনও দুর্ঘটনা নয়—এ এক পরিকল্পিত গণহত্যা। এ যেন এক উচ্চবিত্ত সভ্যতার মঞ্চস্থ আত্মহনন, যেখানে দরিদ্রদের চিতার আগুনে উষ্ণ কফি তৈরি করে বাকি দুনিয়া। পৃথিবীকে যারা পুড়িয়ে মুনাফা কামায়, তারা আজ পরিবেশরক্ষার মুখপাত্র। এ এক বিকট তামাশা—এক পরিপূর্ণ, সুনিপুণ পরিহাস।পুঁজিবাদ সবমসময় চায় ভাবনাহীন আনুগত্য এবং উল্লাসের সমাহার। তাই হাজার হাজার স্টুডিও ঘিবলির শিল্প যেন স্বপ্নের মধ্যে এক ছুরি। Spirited Away কি শুধুই পরী-কথা? না, ওটা এক আত্মাকে পুঁজিবাদের চর্বিতে ডুবিয়ে দেওয়ার আখ্যান। Princess Mononoke কি শুধুই যুদ্ধ? না, সেটা প্রকৃতির সঙ্গে শেষ কথোপকথন। মানব সভ্যতার বিকাশ আজ উন্নয়ন নামক এক সত্ত্বার অধীন। অথচ এই ‘উন্নয়ন’ যেন এক ধূর্ত দৈত্য, যেটি অরণ্য ছিঁড়ে শহর গড়ে, নদী শুকিয়ে কংক্রিট পাঁজর বসায়। হিমবাহের কান্না শোনা যায় না নীতিনির্ধারকের বৈঠকে। ঘরছাড়া মানুষ আবারও উদ্বাস্তুর মিছিল গঠন করে—এইবার পেছনে নেই দেশভাগ, আছে পরিবেশচ্যুতি।
ঘিবলির চিত্ররূপ বলে—”বাঁচতে হলে কল্পনা করো। কিন্তু মনে রেখো, কল্পনা যদি প্রতিবাদ না হয়, তা হয় কেবল পালিয়ে যাওয়া।” ঘিবলির পিছনের রাজনীতি, আকুলিবিকুলি না বুঝেই দেদার বিকোচ্ছে আর্ট! শিল্পীর কল্পনা ঢেকে গেছে অপরিণামদর্শী প্রম্পট-এর মধ্যে। আর এই ভয়াবহ বাস্তবতার পাশে জেগে আছে এক কল্পনার রাজ্য—স্টুডিও ঘিবলির শিল্প। হায়াও মিয়াজাকির চিত্ররূপ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্প শুধু বাস্তবের প্রতিবাদ নয়—এক সম্ভাব্য বাস্তবের পূর্বাভাসও। Nausicaä, Princess Mononoke, বা Spirited Away—সবখানে প্রকৃতি এক দেবতা, প্রযুক্তি এক অভিশাপ। ঘিবলির আর্ট যেমন আভ্যন্তরীণ কল্পনার জগৎ, তেমনই সেই জগত সামাজিক প্রতিফলন। বাংলার ঋত্বিক-সলিল এবং জাপানের মিয়াজাকি—তাঁদের শিল্প একাকার হয়ে যায়—যেখানে শিল্প এক ‘প্রত্যাবর্তন’, সভ্যতার ভুল পথ থেকে ফিরে আসার আকুতি। ঋত্বিক আর সলিল এই কল্পনারও রাজনীতি বুঝতেন। তাঁদের শিল্প ছিল এমন এক অস্ত্র, যা একসাথে স্বপ্ন দেখায় আর ঘুম ভাঙায়। তথ্য বলছে—আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১% লোকের হাতে সম্পদের ৪৪% আছে। তথ্য চিৎকার করে উঠছে—একজন মানুষের আয় অন্য ১০ হাজার মানুষের বার্ষিক আয়ের সমান। এ তথ্য নয়, এটা গুলি। এ গণতন্ত্র নয়, এটা নিওলিবারেল ফাঁসির দড়ি।ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়—”এই যে দেহহীনতা, এটাই আসল চিত্র।” এই যে আমরা দিনরাত কাজ করি আর তবু খেতে পারি না— এই যে আমরা প্রতিদিন মরছি অথচ আমাদের মৃত্যুর রেজিস্টার নেই— এই যে রাষ্ট্র আমাদের শুধুই ‘ডেটা’ ভাবে— এটাই হল শিল্পের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।
আমরা কি পারছি সেই ইতিহাসে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে? নাকি শুধু শ্রদ্ধা জানিয়ে মুখ ঢেকে ফেলছি এক মহাঅপরাধে? এই শতবর্ষ আমাদের এক অনিবার্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে— “তোমরা এখনও শিল্পকে উৎসব ভাবো, না প্রতিবাদ?” সেই প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সংকল্প নিয়েই রোয়াকের চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যা!