চতুর্থ বর্ষ-প্রথম সংখ্যা-সাক্ষাৎকার
যুক্তি-তক্কো-গপ্পো- ঋত্বিক ঘটকের– মন।মনন।দর্শন।
ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাল্পনিক আলাপচারিতায় তরুণ ছাত্র দেবার্ঘ্য দাস।
[তরুণ যুবক। চোখে একরাশ স্বপ্ন- একদিন তার লেখা, সিনেমা সমাজের মোড় ঘুড়িয়ে দেবে। সিগারেট ধরিয়ে মদের দোকান থেকে একটা দিশি বোতল কিনে সেই চাতালেই বসে মদ গিলতে থাকে। কখন যে নেশায় বুঁদ হয়ে গেছে টের পায়নি।…
…একটি পুরনো ঘর, অর্ধেক-বন্ধ জানালা। বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে। ঋত্বিক ঘটক বসে আছেন সিগারেটের ধোঁয়া ভাসিয়ে। মুখোমুখি এক তরুণ ছাত্র, চোখে উজ্জ্বলতা আর মনে হাজার প্রশ্ন… যে প্রশ্নেরা ভিড় করেছে সবসময় ]
ছাত্র: আপনার সিনেমাগুলো দেখতে গিয়ে মনে হলো, আপনি কি আদৌ গল্প বলতে চেয়েছিলেন? নাকি গল্পের আড়ালে অন্য কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন?
ঋত্বিক: (একটু হাসি) আমি গল্প বলতে বসিনি। আমি চাই, মানুষ ব্যথা অনুভব করুক। সিনেমা যদি তাদের আরাম দেয়, তবে সেটা বিজ্ঞাপনের কাজ। আমি আরাম দেওয়ার জন্য সিনেমা বানাই না। আমি কামড় বসাতে চাই, ঘুম ভাঙাতে চাই। গল্প তো শুধু বাহানা — ভেতরের আগুনটাই দেখানোর ব্যাপার।
ছাত্র: আপনি কি বিশ্বাস করেন, দরিদ্র আর প্রান্তিক মানুষেরা আসলে বেঁচে থাকে শুধু মরার জন্য?
ঋত্বিক: না। ওরা বেঁচে থাকে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সমাজ এমনভাবে বানানো হয়েছে, যেখানে ওদের কাছে বাঁচা মানেই ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা। ‘ইশ্বর’ বাঁচতে চেয়েছিল, ‘সীতা’ ভালো থাকতে চেয়েছিল — কিন্তু তাদের জায়গা ছিল না। ওদের স্বপ্ন পাপ বলে ধরা হলো।
ছাত্র: সিনেমা কি তাহলে আপনার কাছে মাধ্যম নাকি অস্ত্র?
ঋত্বিক: মাধ্যম নয়, অস্ত্র। কিন্তু সেই অস্ত্র দিয়ে খুন নয়, মানুষকে বাঁচানো যায়। যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে গান গাওয়া যায় না। সিনেমা আমার জন্য যুদ্ধ, যেখানে লড়াই করতে হয় — সমাজের বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে, রাজনীতির বিরুদ্ধে।
ছাত্র: স্যার, গল্প বলার জন্য কেবল সিনেমা নয় — নাটক, সাহিত্য, গান… অনেক মাধ্যম আছে। কিন্তু আপনি কেন সিনেমাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন?
ঋত্বিক: (হালকা হাসি) , গল্প বলা শুধু কথা বলা নয়। গল্প মানে দেখা, শোনা, অনুভব করা — সবকিছু একসঙ্গে। সাহিত্য হয়তো শব্দে এই কাজটা করে, নাটক করে মঞ্চে। কিন্তু সিনেমা? ওটা করে ছবিতে, শব্দে, ছায়া-আলোয়। সিনেমা একসঙ্গে হাজারটা অনুভূতি জাগাতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সিনেমা পৌঁছে যেতে পারে সবার কাছে — শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব — কোনো বাঁধা নেই।
আমি তো সিনেমাকে বলি “ম্যাজিক লণ্ঠন”। এটা চোখের সামনে বাস্তব আর কল্পনাকে একসঙ্গে বসিয়ে দেয়। তবে শুধুমাত্র যন্ত্র বা টেকনিক দিয়ে সিনেমা বানালে হবে না। সিনেমা বানানোর আগে দরকার একটা তীব্র উপলব্ধি, একটা গভীর রাগ আর ভালোবাসা — সমাজের জন্য, মানুষের জন্য।
ছাত্র: কিন্তু স্যার, এখনকার দর্শক তো বিনোদন খুঁজতে আসে। তারা কি আপনার সেই প্রতিবাদী ভাষা বুঝবে?
ঋত্বিক: (গম্ভীর হয়ে) আরে, বিনোদন বলতে কি বোঝো? কেবল নায়ক নায়িকার প্রেম আর গান? ‘এজরা পাওন্ড’ বলেছিলেন, “Artists are the antennae of the race.” — শিল্পী সমাজের অ্যান্টেনা। আমরা যা দেখাই তা তারা দেখতে চায় না, শুনাই যা তারা শুনতে চায় না। যদি দর্শক বুঝতে না পারে, তবে সেটা তার ব্যর্থতা নয়, আমাদের ব্যর্থতা। সিনেমা করতে গেলে বুদ্ধিজীবী হতে হবে। শুধু গল্প বলে চলে গেলে হবে না, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে।
ছাত্র: স্যার, আপনার সিনেমাগুলো দেখলে মনে হয়, আপনি যেন একটা যুদ্ধের মাঠ থেকে উঠে আসছেন। ক্যানভাসে শুধু সিনেমা নয়, ইতিহাস আর রাজনীতি ছড়িয়ে রাখছেন। আপনি কি সিনেমাকে শুধু শিল্প বলেই ভাবেন, নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু?
ঋত্বিক: (হালকা হেসে) শোনো, সিনেমা যদি শুধু শিল্পই হয়, তবে সেটা দামি গ্যালারিতে বাঁধাই করে রাখা যাবে। আমি তো সিনেমাকে অস্ত্র ভাবি। আমি যখন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বানাই, তখন আমার মাথায় ছিল সেই লাখো ভিটেহারা মানুষদের মুখ, যারা দেশভাগের পর রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি চাই সিনেমা যেন তাদের কষ্টের দলিল হয়ে দাঁড়ায়। শিল্প দিয়ে শুধু সৌন্দর্য নয়, সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়াই আমার কাজ।
ছাত্র: তাহলে কি সিনেমা মানে শুধুই প্রতিবাদ? গল্প বলার জায়গাটা কোথায়?
ঋত্বিক: গল্প বলাও একধরনের প্রতিবাদ, রে! ফ্যাসিবাদ কী চায় জানিস? — মানুষকে গল্পহীন করে দিতে চায়। আমাদের সব গল্প কেড়ে নিয়ে একরকম একঘেয়ে জীবন চাপিয়ে দিতে চায়। তাই আমরা গল্প বলব। কিন্তু সেই গল্পও মানুষের বাস্তবতার মাটি থেকে উঠে আসতে হবে। মনে রাখবি, সিনেমা হল “বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে”। কিন্তু সেই মিথ্যের ভেতরে থাকতে হবে আসল সত্য।
ছাত্র: এখনকার অনেক তরুণ নির্মাতা বলছেন, রাজনৈতিক সিনেমা করলে সেন্সরশিপের মুখে পড়তে হয়। আপনিও তো অনেকবার এই সমস্যার সামনে পড়েছেন। আপনি কীভাবে সামলেছেন?
ঋত্বিক: (মুচকি হাসি) দেখ, শিল্পী যদি ভয় পায়, তবে সে মৃত। সেন্সরশিপ মানে ক্ষমতাবানদের ভয়। তারা জানে, সত্যি কথা বললে তাদের কাঠামো ভেঙে পড়বে। আর যাদের সত্যি বলার দায়বদ্ধতা নেই, তাদের সিনেমা কাঁচা বিনোদন হয়ে থাকবে।
[ঘরের বাতিটা একটু কমে এসেছে। সিগারেট শেষ। ছেলেটির চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি । ঋত্বিকের গলায় যেন ক্লান্তি মিশে, কিন্তু চোখদুটো তবু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়ে যায়।]
ছাত্র: ‘সুবর্ণরেখা’-য় সবাই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কেউ বাঁচতে পারে না। এতটা নির্মম কেন হলেন? আশা কোথায়?
ঋত্বিক: আশা? কার আশা? আমরা যারা দেশভাগের পরে ভিটেমাটি হারালাম, তারা কী নিয়ে আশা দেখব? ইশ্বর, সীতা — এরা সবাই আমার চোখে সত্যিকারের ট্র্যাজেডি। এরা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সমাজ তাদের পিষে দেয়। জীবন আসলে নির্মম — আমি শুধু সেটা দেখিয়েছি। কেউ কেউ বলেছিল, “ঋত্বিক, এত হতাশা কেন?” আমি বলি, “আমি মিথ্যে স্বপ্ন দেখাব কেন?
ছাত্র: এমন দুঃখ, এমন হতাশা, তবু এত সুন্দর একটা গল্প! এই সিনেমার জন্ম কীভাবে হয়েছিল?
ঋত্বিক: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ‘সুবর্ণরেখা’ আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত ছবি। দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন — এগুলো তো শুধু রাজনৈতিক ঘটনাই নয়, আমাদের চেতনার ভিতরে গেঁথে থাকা ক্ষত। এখানে আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল একটাই — স্বপ্ন আর বাস্তবের সংঘাত দেখানো।
ইশ্বর আর সীতার গল্পটা ভাব দেখলে সহজ মনে হবে — ভাই বোনের সম্পর্ক, একটা নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু আমি আসলে দেখাতে চেয়েছি, কীভাবে এই সমাজ, এই অর্থনীতি আমাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দেয়। ইশ্বর শিক্ষিত, আধুনিক যুবক — কিন্তু তার অবস্থান কোথায়? একটা ঢেউয়ের মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। সীতা তো একেবারে শুদ্ধতার প্রতীক, কিন্তু তাকেও পতিতালয়ে ঠেলে দেওয়া হয়। স্বপ্ন দেখি আমরা, কিন্তু সেই স্বপ্নের দাম দিতে হয় নিজের রক্ত দিয়ে।
সুবর্ণরেখা নদীটাও একটা প্রতীক। একটা সীমারেখা — যেটা আমরা পেরোতে পারি না। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ ভেতরে ভেতরে পচে যায়, কিন্তু বাইরে একটা ‘ভালো থাকার’ মুখোশ পরে থাকে।
ছাত্র: নীলকণ্ঠ চরিত্রটা কি আসলে আপনার নিজের স্বীকারোক্তি?
ঋত্বিক: (গম্ভীর হয়ে) স্বীকারোক্তি নয়, চিৎকার। নীলকণ্ঠ আমি, আর আমিই নীলকণ্ঠ। সে সমাজের চোখে পাগল, মাতাল, হারিয়ে যাওয়া এক ব্যর্থ লোক। আমি নিজেকেও তো তাই মনে করি। স্ত্রী চলে গেছে, সন্তান দূরে, সিনেমা সেন্সরে কাটা খাচ্ছে, পয়সা নেই — বলো তো, আমি জিতেছি কোথায়?
কিন্তু নীলকণ্ঠ একটা জিনিস জানে — ও মরলেও ওর চিন্তাটা মরবে না। তাই শেষ দৃশ্যে ও মরে গিয়ে আলোটা অন্যদের হাতে দিয়ে যায়। এটাই আমার লড়াই।
ছাত্র: তাহলে কি আপনি নিজের জীবনকে ইচ্ছা করেই শেষ করে দিলেন?
ঋত্বিক: (কড়া গলায়) শেষ? আমি শেষ হলে আমার সিনেমাগুলো বেঁচে থাকত না। আমি চাই, আমার ব্যর্থতা দেখে কেউ যেন ভাবে — “ও হেরে গেল, কিন্তু আমায় জিততে হবে।”
ছাত্র: সিনেমায় রাজনীতি ঢোকালে কি সিনেমা নষ্ট হয়ে যায়? নাকি রাজনীতিকে সিনেমার খাঁচায় ঢোকানো উচিত?
ঋত্বিক: (একটু চওড়া হাসি) রাজনীতি? রাজনীতি ছাড়া মানুষই নেই — সিনেমা থাকবে কীভাবে? আমার সিনেমায় রাজনীতি থাকবেই, কারণ আমি সমাজ নিয়ে কথা বলছি। কেউ যদি মনে করে সিনেমা কেবল বিনোদন, সে ভুল করছে। সিনেমা রাজনীতি করবে না, সমাজ বদলাবে না — এমন কথা বলাটা নিজেকে বোকা বানানো।
ছাত্র: ‘যুক্তি, তক্কো, গপ্পো’তে আপনি নিজেই অভিনয় করলেন — নীলকণ্ঠ বাগচী। এক ভাঙা, ছিটকে পড়া মানুষ। আপনি কি নীলকণ্ঠকে নিজের ছায়া হিসেবে দেখেছিলেন?
ঋত্বিক: (চোখে একটু দুঃখের ছায়া) নীলকণ্ঠ আমিই। একজন ব্যর্থ পিতা, ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ শিল্পী — সমাজের চোখে আমি হারিয়ে যাওয়া মানুষ। আমি তো সারা জীবন লড়েছি, কিন্তু নিজের সংসারটাই ধরে রাখতে পারিনি। অভাব-অনটন, মদ, মানসিক যন্ত্রণা — এইগুলো আমায় গ্রাস করেছে। নীলকণ্ঠ সেই প্রতীক, যে জেনেছে তার বিশ্বাসগুলো ভেঙে গেছে, কিন্তু তবু শেষ পর্যন্ত সে মরতে চায় না। সে খুঁজে চলে — কোথাও কি মুক্তি আছে? আশার আলো আছে? এই সমাজ তো আমাদের মতো মানুষদের চায় না। যারা প্রশ্ন করে, যারা প্রতিবাদ করে, তাদের জায়গা হয় হেরে যাওয়া মানুষের দলে। ‘যুক্তি, তক্কো, গপ্পো’তে আমি বলতে চেয়েছি — আমাদের সমাজ পচে গেছে, কিন্তু তবু কিছু একটা আছে, যা বেঁচে থাকবে। সেই শক্তিটা নতুন প্রজন্মের কাছে। শেষ দৃশ্যে নীলকণ্ঠের মৃত্যু হয়, কিন্তু তরুণ ছাত্র আর মেয়েটা চলে যায় নতুন পথে। সেটাই আশার চিহ্ন।
[ঘর অন্ধকারে আধো-আলো আধো-ছায়া। জানালার বাইরে ট্রেনের আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। ঋত্বিক ঘটক সিগারেট হাতে বসে আছেন, চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু গলায় আগুন।]
ছাত্র: আপনি তো শুধু সিনেমা বানাননি — ছোটগল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। কিন্তু আপনার লেখা তো কম মানুষই চেনে। আপনি কেন এগুলোকে সিনেমায় আনলেন না? সিনেমার বাইরে সেগুলো কি ফেলনা হয়ে গেল?
ঋত্বিক: ফেলনা! আমার গল্পগুলো আমার আত্মার টুকরো। সিনেমায় যা দেখাতে পারিনি, সেগুলো শব্দে বলে গেছি। কিন্তু গল্প, চিত্রনাট্য — এগুলো মাধ্যম, হাতিয়ার মাত্র। আসল হলো কথাটা পৌঁছনো। আমি চিত্রনাট্য লিখেছি অন্য পরিচালকদের জন্যও — “মধুমতী”, “মুসাফির”। কিন্তু সেই গল্পগুলো আমার ছিল না। ওগুলো আমি বিক্রি করেছিলাম বেঁচে থাকার জন্য। ওগুলো আমার আত্মার লেখা নয় — ওগুলো আমার খিদের লেখা। আমার ছোটগল্পগুলোতে সিনেমার ছায়া থাকবে, থাকবে না কেন? আমি সিনেমা আর গল্পকে আলাদা ভাবি না। গল্প হলো ভিত, সিনেমা হলো সেই ভিতের গায়ে তোলা বাড়িটা।
ছাত্র: বলিউডে তো আপনার লেখা “মধুমতী” সুপারহিট। আপনি কি মনে করেন বলিউড শিল্প হতে পারে, নাকি সেটা কেবল ফাঁকা বিনোদন?
ঋত্বিক: বলিউড একটা কারখানা। সেখানে ফিল্ম বানায়, সিনেমা নয়। আমি “মধুমতী” লিখেছিলাম — তাতে আমার কিছু কথা ছিল, কিন্তু সেটা তো বাণিজ্যের মাপে কেটে ছেঁটে ফেলল।বলিউডের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ওরা “সিনেমা”কে “প্রোডাক্ট” বানিয়ে ফেলেছে। সিনেমা হলো মানুষের স্বপ্নের আয়না, আর ওরা সেটা বানিয়ে ফেলেছে মালপত্র।তবে আমি বলব, বলিউডেও ভালো কাজ হয়। সত্যজিৎ রায় “জলসাঘর” বানিয়েছেন, গুরু দত্ত “পয়সা” বানিয়েছেন — ওইগুলো সিনেমা। কিন্তু আজকের বাজারি বলিউড? ওরা মানুষকে ভাবতে দেয় না, ওরা শুধু সময় নষ্ট করায়।
ছাত্র: আপনি তো ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার (FTII) ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। এত বড় পদ, এত সম্মান — কিন্তু শেষে তো আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। আপনি কি সত্যিই শিক্ষার্থীদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছিলেন? নাকি সিস্টেমের সঙ্গেই লড়াই করছিলেন?
ঋত্বিক: (হাসতে হাসতে) আমাকে বলা হয়েছিল — “আপনি ছেলেপুলেদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন।” আমি বলেছিলাম — “হ্যাঁ, সত্যিই নিয়ে যাচ্ছি। ওদের চোখ খুলে দিতে চাই, যাতে ওরা দেখুক সমাজের মুখোশগুলো।” আমি ওদের বলতাম — “তোমরা যেন শুধু ক্যামেরা চালানোর দিকে মন না দিয়ে , সিনেমার আত্মাটাও বোঝো। সিনেমা মানে শুধু শট নেওয়া আর অভিনয় নয়, সিনেমা মানে হলো লড়াই — সমাজের বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে।” সিস্টেম সেটা নিতে পারল না। ওরা চায় গুড বয়, আমি বানাচ্ছিলাম বিদ্রোহী। আমাকে বের করে দিল, কারণ আমি রোবট বানাতে চাইনি — মানুষ বানাতে চেয়েছিলাম।
ছাত্র: আপনি বারবার বলছেন ‘হারিয়ে যাওয়া’, ‘ব্যর্থ হওয়া’। কিন্তু স্যার, আপনি তো আমাদের মতো তরুণদের কাছে আদর্শ। আপনি নিজেকে সত্যিই ব্যর্থ মনে করেন?
ঋত্বিক: (চোখ নামিয়ে) ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ তো বটেই। আমি ভালো স্বামী হতে পারিনি, ভালো বাবা হতে পারিনি। আমার স্ত্রী আর সন্তান আমার থেকে দূরে চলে গেছে। একটা শিল্পীর জীবন যে এতটা কষ্টের হবে, সেটা জানলে হয়তো অনেক কিছু অন্যভাবে করতাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলেও আমার সিনেমাগুলো ব্যর্থ নয়। কারণ, সেগুলো এখনো বেঁচে আছে। সমাজে একজন বাবা যদি ছেলেমেয়েকে খাওয়াতে না পারে, তাকে ব্যর্থ বলা হয়। কিন্তু সেই বাবা যদি তার সন্তানকে স্বপ্ন দেখায়, প্রতিবাদের ভাষা দেয় — তখন কি সে ব্যর্থ? আমার সিনেমাগুলো হয়তো আজকের দিনে সরাসরি কাউকে খাইয়ে দেবে না, কিন্তু যদি একটা ছেলে, একটা মেয়ে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যিটা বলতে পারে, তাহলে আমি মনে করব আমি ব্যর্থ নই।
[ঘরময় নিস্তব্ধতা। ছেলেটা চুপ করে আছে — চোখে অশ্রু, মুখে দৃঢ় ভাব। ঋত্বিকের মুখে ক্লান্তি, কিন্তু সেই ক্লান্তির নিচে লুকিয়ে থাকা বিজয়ের ছাপ স্পষ্ট। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন — দূরে ট্রেনের আওয়াজ মিলিয়ে যায়…ঘরটা এখন আরও নীরব। বাতাস ভারী। ঋত্বিক ঘটক জানালার পাশে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন, চোখে পুরনো দিনের ছায়া। ছেলেটা আর প্রশ্ন করতে ভয় পাচ্ছে না]
ছাত্র: আপনি সত্যজিৎ রায়কে কীভাবে দেখেন? বন্ধু, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী?
ঋত্বিক: (একটু চুপ করে) সত্যজিৎ প্রতিদ্বন্দ্বী নয় — ও আমার সহযোদ্ধা। আমরা দু’জনেই সিনেমা দিয়ে সমাজ বদলাতে চেয়েছি, কিন্তু পথটা আলাদা ছিল। ও ভদ্র, মার্জিত ভাষায় কথা বলেছে। আমি গলায় রক্ত উঠে গেলেও চেঁচিয়ে গেছি। সত্যজিতের সিনেমা খুব সুন্দর — ওর সিনেমা দেখলে মনে হয় জীবনটা এক ধরনের নান্দনিক মায়ায় মোড়া। আর আমার সিনেমা দেখলে মনে হয়, জীবনটা কাঁচা মাংসের মতো — রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা দু’জনেই একই কথা বলতাম — সমাজ বদলাতে হবে। আমি মনে করি, সত্যজিৎ থাকলে ভারতীয় সিনেমা জগতটা সভ্য হতো, আর আমি থাকলে সেটা বুনো হতো।
ছাত্র: মৃণাল সেন তো আপনাদের সমসাময়িক। ওঁর সিনেমাও তো সমাজের কথা বলে। কিন্তু আপনাদের পথ আলাদা হয়ে গেল কেন?
ঋত্বিক: মৃণাল আমার বন্ধু। ও আমার মতোই আগুনের মানুষ — আমরা দু’জনেই বিশ্বাস করতাম সিনেমা মানে লড়াই। তবে ওর লড়াইটা একটু অন্যভাবে লড়েছিল। মৃণালের সিনেমায় রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি। ও সরাসরি আঘাত করে, আমি আবেগ দিয়ে পোড়াই। মৃণাল ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে, আর আমি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কথা বলি।আমাদের মধ্যে তর্ক হতো প্রচুর — ও বলত, “ঋত্বিক, তুমি কেন এত আবেগপ্রবণ?” আমি বলতাম, “মৃণাল, তুমি কেন এত বেশি মাথা খাটাচ্ছ?” কিন্তু জানবি- শেষ পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য একই ছিল — সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো।
ছাত্র: সলিল চৌধুরীও তো আপনার সমসাময়িক। তিনি তো শুধু সুরকার নন, তিনি রাজনীতি করতেন, গানেও সেই রাজনীতি নিয়ে আসতেন। আপনি কি মনে করেন সুর দিয়ে বিপ্লব সম্ভব?
ঋত্বিক: সলিল সুরকারের চেয়েও বেশি কিছু। ও একজন কমরেড। ওর সুর মানে প্রতিবাদ। সলিলের গান মানে গর্জন — “ও আলোর পথযাত্রী” শুনেছিস? ওই গানে রক্ত ঝরে। ওর সুরে আমি সারা ভারতবর্ষের ক্ষোভ দেখতে পাই। সলিল আর আমি অনেক লড়াই করেছি — কখনও রাজনীতি নিয়ে, কখনও সিনেমা নিয়ে। কিন্তু এক জায়গায় আমরা এক ছিলাম — সমাজ বদলাতে হবে। সলিলের সুর আর আমার ক্যামেরা একসঙ্গেই যুদ্ধ করেছিল।
ছাত্র: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আপনার সিনেমার গানে সুর দিয়েছেন, গেয়েছেনও। ওঁর গানগুলো এত বিষাদময় কেন?
ঋত্বিক: হেমন্তর গলায় এমন একটা গভীরতা আছে, যা আমার সিনেমার কষ্টগুলোকে আরও বেশি সত্যি করে তোলে। আমি যখন “মেঘে ঢাকা তারা” বানাই, তখন হেমন্ত ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারিনি। “আমি রিনিক ঝিনিক বাজাই” — এই গানটার মধ্যে যে কষ্ট, যে যন্ত্রণা — ওটা কেউ আর গাইতে পারত না। হেমন্তর গলা মানে হলো শুদ্ধ দুঃখ। আমার সিনেমায় সুর দিয়ে ও আসলে আমার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করেছে — শব্দ দিয়ে, সুর দিয়ে।
ছাত্র: স্যার, উত্তম কুমার তো বাংলা সিনেমার “মহানায়ক”। আপনি কি ওঁকে অভিনেতা হিসেবে সিরিয়াসলি নিতেন, নাকি ও শুধুই জনপ্রিয়তার প্রতীক?
ঋত্বিক: (একটু হেসে) উত্তম কুমার জনপ্রিয়তার প্রতীক, সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই জানিস, ও একজন অসম্ভব ক্ষমতাশালী অভিনেতা ছিল! ওকে বাণিজ্যিক সিনেমা গ্রাস করেছিল, সেটা সত্যি। কিন্তু আমি “নায়ক” দেখে বুঝলাম, ওর ভেতরে একটা অসম্ভব বিষণ্নতা আছে — যে বিষণ্নতা শুধু প্রকৃত শিল্পীদের থাকে। উত্তম কুমার যদি আর্ট ফিল্মে বেশি কাজ করত, তাহলে ও সত্যজিতের “নায়ক”-এর মতো আরও বহুবার নিজেকে ভাঙত, নিজেকে খুঁজত। ও শুধু “মহানায়ক” নয় — ও একজন হারিয়ে যাওয়া মহান শিল্পী।
ছাত্র: সত্যজিৎ, মৃণাল, হেমন্ত, সলিল, উত্তম — এঁরা সবাই আপনার জীবনের একেকটা অধ্যায়। শেষমেশ এঁদের কীভাবে মনে রাখবেন?
ঋত্বিক: (চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ)
আমি ওদের বন্ধু ভাবি, প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি না। আমরা সবাই একসঙ্গে একটা নতুন ভাষা খুঁজছিলাম — সিনেমার ভাষা। কেউ ভদ্রভাবে বলেছে, কেউ সুর দিয়ে বলেছে, কেউ অভিনয়ে বলেছে, কেউ চেঁচিয়ে বলেছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য একটাই — এই সমাজের মিথ্যে মুখোশটাকে ছিঁড়ে ফেলা। সত্যজিৎ ছিল আকাশের মতো শান্ত, মৃণাল ছিল কৌশলী সৈনিক, হেমন্ত ছিল বিষণ্ন গান, সলিল ছিল বিপ্লবের সুর, আর উত্তম ছিল এক হারিয়ে যাওয়া মহানায়ক।
-আর আপনি?
-আমি ছিলাম কাঁদতে থাকা এক মাতাল ভিখারি — যে চিৎকার করে বলেছিল, “দ্যাখো, আমাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!”
ছাত্র: আপনি তো অনেকবার বলেছিলেন আপনার সিনেমা মূলত মানুষের বিচ্ছিন্নতা আর ট্র্যাজেডি নিয়ে। এই দর্শনটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে?
ঋত্বিক: (চোখ মেলে তাকিয়ে) দেশভাগ দেখেছিস তো? ভিটেমাটি হারিয়ে হাজারো মানুষ উদ্বাস্তু হল। কিন্তু শুধু দেশভাগ নয়, আমাদের সমাজের ভেতরেও ভাগ হয়ে গেছে মানুষ। একদিকে গুটিকয়েক ধনী, আরেকদিকে লাখো দরিদ্র। এই বিচ্ছিন্নতাই আমাকে পোড়ায়। ‘কোমল গান্ধার’-এ দেখিয়েছি দল ছিঁড়ে যাওয়া মানুষের যন্ত্রণা। আমাদের দায়িত্ব হল সেই ক্ষতগুলোকে তুলে ধরা।
ছাত্র: স্যার, আপনার মতে দস্তয়েভস্কি, ব্রেখট, আইজেনস্টাইন — এদের মধ্যে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে আপনার কাজে?
ঋত্বিক: (চোখে ঝিলিক) দস্তয়েভস্কির ‘গভীর মানুষের’ ধারণাটা আমায় খুব নাড়া দেয়। মানুষ বাইরে যা, তার চেয়েও বেশি কিছু সে নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখে। আমার নীলকণ্ঠ বাগচী (যুক্তি তক্কো গপ্পো) সেই রকমই এক গভীর মানুষ। আর ব্রেখট আমাকে শিখিয়েছেন, দর্শককে কখনওই আরাম দেওয়া যাবে না। তাদের নাড়িয়ে দিতে হবে, ভাবাতে হবে।
ছাত্র: আপনি কি মনে করেন, ভবিষ্যতে সিনেমা সমাজ বদলাতে পারবে?
ঋত্বিক: (গভীরভাবে তাকিয়ে) ভবিষ্যতকে সিনেমা বদলাবে না। বদলাবে সেই মানুষ, যারা সিনেমা বানাবে আর যারা সিনেমা দেখবে। সিনেমা শুধু চেতনাটা ছড়াবে, বাকি কাজ মানুষকে করতে হবে। কিন্তু মনে রাখবি, যদি একটাও সিনেমা একজন মানুষের চিন্তাটা নাড়িয়ে দিতে পারে, তবেই সেটাই হবে আসল বিজয়।
ছাত্র: আপনি নিজেকে বারবার “পরাজিত মানুষ” বলছেন। কিন্তু পরাজিত মানুষ কি এত কিছু তৈরি করতে পারে? আপনি নিজেকে শিল্পী ভাবেন, না বিপ্লবী?
ঋত্বিক: আমি শিল্পী নই। শিল্পী হলে হয়তো সুন্দর কিছু বানাতাম, মানুষ আমাকে পুরস্কার দিত। আমি পুরস্কার চাইনি। আমি চেয়েছি, আমার সিনেমাগুলো মানুষকে নাড়িয়ে দিক। আমি পরাজিত — কারণ সমাজের চোখে আমি জিততে পারিনি। আমার সংসার ভেঙেছে, বন্ধু দূরে সরে গেছে, আমার সিনেমাগুলো লোকে বোঝেনি। কিন্তু আমি একটা আগুন রেখে যাচ্ছি — যে আগুন আমার মধ্যে জ্বলেছে, সেটা আরেকজনের মধ্যে গিয়ে জ্বলবেই। তুই যখন এখানে বসে আমার সঙ্গে লড়াই করছিস, প্রশ্ন করছিস — সেটাই আমার জয়।
ছাত্র: আপনার জীবনে এত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা কি আপনাকে বড় শিল্পী করেছে, নাকি ভেতরে ভেতরে খেয়ে ফেলেছে?
ঋত্বিক: (একটু থেমে) দুটোই। আমি জানি, আমার সংসার ভেঙেছে, আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, আমি নিজেকে নষ্ট করেছি। কিন্তু ওই ব্যর্থতার আগুনই তো আমার সিনেমা। সুখী মানুষ সিনেমা বানালে তাতে সত্যি থাকে না। আমি সংসার রাখতে পারিনি, বাবা হিসেবেও ব্যর্থ — কিন্তু আমি নিজের সত্যিটা বানিয়েছি। আমাকে যদি সফল হতে হত, তাহলে সরকারি পুরস্কার পেতাম, লোকজন বলত “বাহ বাহ!” — আমি সেসব চাইনি।
ছাত্র: আপনি যদি আর একটা সিনেমা বানাতে পারতেন, কী নিয়ে বানাতেন?
ঋত্বিক: (একটু থেমে) আমি একটা গল্প বানাতে চাইতাম এমন এক দেশ নিয়ে, যেখানে কেউ উদ্বাস্তু হবে না, কাউকে পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হবে না, কেউ আর কাঁদবে না। কিন্তু আমি জানি, সেই সিনেমা বানানো যাবে না। তবে তুমি বানাবে। তোমার মতো ছেলেমেয়েরা বানাবে। সিনেমা হবে মানুষের জন্য, মানুষের কথা বলা হবে । মনে রেখো, সিনেমা শুধু আলো আর ছায়া নয়। সিনেমা হলো মাটি আর রক্তের গল্প।
ছাত্র: স্যার, শেষ প্রশ্ন — আজ যদি নতুন করে শুরু করতে পারতেন, কিছু বদলাতেন?
ঋত্বিক: (মুচকি হেসে) কিছুই না।
[ঘরে নিস্তব্ধতার হাওয়া। ছেলেটার চোখে জল, গলায় দলা পাকানো শব্দ। ঋত্বিক জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন, দূরে ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ছায়া মিলে যাচ্ছে…
ঘোর কেটে গেলে সম্বিত ফিরে আসে তরুণের। সেই চেনা আলো আধারি মদের দোকানের চাতাল। হালকা মাথা ঝিমঝিম করছে, কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি থেকে ধুলো ঝেড়ে চাতাল থেকে নেমে হেঁটে যায়। কানের মধ্যে ফিসফিস করে কথাটা বেজেই যাচ্ছে –
“ভাবো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো। আমার তো হলো না। তোমরা ভাবলে কাজ হবে..”]