দ্বিতীয় বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা ✦ কবিতা
নীলাঞ্জন দরিপা
আলগা দুঃখ, দেখা হবে
১।
এই রোদ এই মেঘলা দাবার বোর্ডের বুকে নেচে উঠছে বড়ো রাস্তা হাওয়া মারছে স্টোভ
সোনালী দানার ভুট্টা ধীর আঁচে জড়ো করছে কালো ছোপ, বাঘের বিষয়ে
তুমি কাকে চিঠি লিখছ এ অরণ্যে তুমি যে কী লিখতে পারো সে সম্পর্কে এখনো কারোর
কোনো ধারণাই নেই ফিসফাস উড়ছে তবু উদ্বায়ী মদের গ্লাস হাতে হাতে খালি হচ্ছে আনমনা গলায়
এই রোদ এই মেঘলা আমি তার মধ্যে শুধু দু’হাতে ফোটাচ্ছি দুপুরের
নিভৃত প্রলাপগুচ্ছ, বাহ্যত স্থগিত আছে আবর্তন অথচ যে অপকেন্দ্রে ছিটকে এল স্নেহজলরাশি
সে তোমাকে ছুঁয়েছে কি চাঁদ সে কি ভরিয়েছে কলঙ্কের ডোবা
না কি সে নিজেই ক্রমে ঘূর্ণিটাল সামলাতে না পেরে
বেহায়া সুড়ঙ্গ বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঘনঘোর টলোমলো মন
ফেরিওলা ডেকে ডেকে হাঁপিয়ে উঠেছে বলো এভাবে ফেরায় কেউ নাকছাবি, অতীন্দ্রিয় ডাক
চাঁদের বিষয়ে তুমি কাকে এত কথা লিখছ এ বর্ষায় তুমি যে কী নাচতে পারো সে সম্পর্কে এমনকি তোমার
ময়ূরও ধারণাশূন্য আমি তার পেখমের ছটা থেকে রঙ শুষতে গিয়ে
নিজের গুহার বাইরে এসে মুখে লাগিয়েছি ডোরাকাটা ভুট্টা পোড়া রোদ তারপর
শুধু বৃষ্টি নামছে আর আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দিচ্ছি ভয়ঙ্কর রাতের রাস্তায়
২।
দুটো সবজি ভাত একটা রানিংয়ে অমলেট দাদা ছেচল্লিশ, ছ’টাকা হবে কি
একটু একটু বুঝতে পারি বেঁচে আছি , অন্নপূর্ণা ইটিং হাউস
মিরিন্ডা দুপুরে তুমি শ্বাসে ক্লাস টুয়েল্ভের ঠান্ডা দাও, মায়ের বিষয়ে
কখনো লিখিনি আমি আর যা লিখেছি সবই অসভ্য প্রাচীন
ফিরতি পথে ঝাঁ ঝাঁ রোদ এখন আর নীল জামা গায়েও হচ্ছে না
দেখো প্রিয় মদ্যপান এলোমেলো পায়ের বিন্যাসে এই হাঁটা পথে সাফল্য তোমার
কীভাবে চিহ্নিত হল, আলগা দুঃখ,দেখা হবে! বিরহ-জমাট পথে তুমিই তো হস্টেল নাইট
দুটো জাহান্নম একটা লুকোনো জন্নত ব্রাভো তুমি তাকে খুঁজে পাচ্ছো হাতের তালুতে
একটু একটু খোলো চোখ শিয়রে আছে তো সেই কক্ষচ্যুত শনির কাজল
সুভান
১.
সৎকার
ভাঙা পিয়ানোর মতো অর্ধেক জীবন কেউ কেউ
যত্নে সাজিয়ে রাখে ঘরে। ধুলো মোছে নিজেরই
কপাল।
শহরের নামি রেস্তোরা থেকে নেমে এসেছে যুগল।
ভাড়াবাড়ি থেকে দুটো গলি পার করে রেশমের
পাড়াগাঁয়ে মিশে যায় ওরা।
সেই থেকে ছেঁড়া জিন্স ছাদের কিনারে,
চুপ করে সারা পাড়া ঘুরে আসে চিড়িয়াপাগল।
সেখানেও কেউ কেউ নিজেকে খুঁজতে গিয়ে
ভাঙা কোনো পিয়ানোয় পুনরায় হাত রেখে বসে।
পুরনো গানের মতো বেজে ওঠে
সেই সব তোমাকে না-পাওয়া দিনগুলি…
২.
কেমন আছি বলবো না আর তোমায়
একটাই ঘর এখনো আমি ইটের পর ইট দিয়ে
বানাতে চাইছি; কিন্তু ঘরের যে শেষ নেই, এত দুয়ার
এত খিড়কি, জাফরির ফাঁক দিয়ে গলে পড়া আংটি,
চিঠি হারিয়ে ফেলা খাম, সিলিং ফ্যানের ঘরঘর শব্দ,
ঢেকে রাখা ভাত ও উপেক্ষায়, নদীর মতো সরে সরে
যায় সেই ঘর।
বারবার ইট সরে যায়। আমি ইট রাখি ইটের ওপর।
চুন থেকে সুরকির কথা সরে যায়।
ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখি আলো।
কতদূর তোমার ঠিকানা?
নতুন সরণি?
চিঠি থেকে যায় তবু নরম।
হারানো কাগজে কী আর মাথা রাখা যায়?
ফোন বেজে যায়…
এই এক খেলার মতো খেলা।
কেমন আছি আর বলবো না তোমায়…
অমিত কাশ্যপ
ছায়া
ছায়াটা সরে গেছে, অবসরপ্রাপ্তরা বসতেন
প্রাতঃভ্রমণের পর একটুখানি নিরিবিলি
প্রবীণ সম্মেলন বলা যায়, গল্প থাকত-
নিদ্রাহীনতার ওষুধ, স্ত্রীবিয়োগের হাহুতাস
ছেলে-বউমার কাহিনি, খেলাধুলা, ভ্রমণ
একটু রাজনীতিও ঢুকে যেত মধ্যে মধ্যে
সকাল সরে সরে এখন মধুদার চায়ের দোকান
দোকানের একটুখানি ছায়া, বৃদ্ধরা বসেন
মধু ম্লান হাসে, বাবুরা কদিন চা খান
থাকবেনি আর এই দোকান, ভাঙা পড়বে
বৃদ্ধরাও ম্লান হাসেন, প্রোমোটারির দখলে মাঠ
রাস্তার ওপর ঝুপড়ির দোকানও দখলে
অর্ণব দেব নারায়ণ রায়
ইতরেতর
একটা মানুষের মৃত্যু যেন কিছুই নয় এইভাবে ওরা দেখছিল –
একটা মানুষের মৃত্যু কিচ্ছু না, এরকমভাবে মোবাইলে উঠছিল একটা মানুষের শেষ টানের ভিডিও,
মনে রাখার মতো সেলফি —
সেলফির পেছনে দরজা-খোলা সাদারঙের পালকি,
সামনে খাবি খেতে খেতে একটা মানুষ মরছিল —
একটা মানুষের মৃত্যু যেন কিছু না, এমনভাবে ওরা দেখছিল
কাছাকাছি কোনও মানুষ ছিল না
কতকটা মানুষের মতন দেখতে প্রাণী ছিল,
যারা জানতো একটা মানুষ এখনই মরবে,
সুতরাং বুদ্ধি করে সেলফি নিচ্ছিল
একটা মানুষের মৃত্যু যেন কিছু না, এমনভাবে ওরা দেখছিল
পালকি-ড্রাইভার কোমরে হাত রেখে অপেক্ষা করছিল, একটা মানুষের মরার জন্য
যেন একটা বুড়ো কোলাব্যাং চিত হয়ে শুয়ে আছে ফুটপাথে,
এরকমভাবে পাশ কাটিয়ে দু-একজন হেঁটে যাচ্ছিল
একটা মানুষের মৃত্যু যেন কিছু না, এমনভাবে ওরা দেখছিল
একটা মানুষের বদলে ওখানে কোনও যুবতী নারী তার বিশ্রস্ত কাপড়চোপড়ে পড়ে’ থাকলে
ওরা তক্ষুনি কাছে ছুটে গিয়ে দেখতো শরীর — ঘন হয়ে তখনও তুলতো সেলফি।
এই হাসপাতাল এবং
এই তার করোনার চিকিৎসা—
সুপার, নার্স, জমকালো ডিগ্রীওয়ালা ডাক্তার, অ্যাম্বুল্যান্স, অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভার —
এবং আরো অনেককিছু —
হায় রে ভালমানুষের সরকার !
এতকিছুর মধ্যেও যে একটাও মানুষ ছিল না সেটাই সত্যি।
একটা মানুষের মৃত্যু যেন কিছু না, এমনভাবে ওরা দেখছিল
ওরা কাক আর কুকুরদের দেখে কিছুই শিখতে পারেনি
ওরা কাক আর কুকুরদের দেখে সম্প্রীতি শেখেনি, উদ্বেগ শেখেনি
আসলে ইতর প্রাণীদের চাইতেও মানুষ অনেক বেশি ইতরেতর ।।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আন্দোলিত বাহুর স্মরণমঞ্চ থেকে
আন্দোলিত বাহুর স্মরণমঞ্চ থেকে দূরে সরে যাওয়া
কোনো জনপদের ভোরবেলার রাগের সঙ্গে পরিচয় নেই
এমন কিছু অল্পজলের নদী
আজও আমার সঙ্গে অনেকটা পথ হেঁটে এলো
শুধুমাত্র নদীর পায়ের ওঠানামা নয়
খুলে আসা মাংস আর শুকিয়ে যাওয়া চামড়া থেকে
যতটুকু অত্যাচারিত ভূগোলের সন্ধান পাওয়া যায়
তার প্রায় সবটাই অস্বীকারের কুয়াশায় ঢাকা
পাগলের শূন্যতার মতো চাঁদের ধূসর আলোয়
কিছু জটিল ছায়া মনে করছিল এখনই সময়
মঞ্চের যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়িয়ে দেওয়ার
যদিও কিছু নাভিশ্বাসের হঠাৎ উন্মোচন
তাদের ভীষণই চিন্তায় রেখেছে সকাল থেকে
বৃষ্টির শব্দের মতো দূরে কোথাও
একটা বিদ্রোহের মাথা চাড়া দেওয়া
জোলো হাওয়ার মতো ভেসে আসছিল
যতক্ষণ না বৃষ্টিতে ভিজছে ধুলোগানের শরীর
ততক্ষণ পর্যন্ত স্মরণমঞ্চ থেকে উঠে আসবে
ভাঙা কাঠ আর পেরেকের ধাতব চিৎকার
উর্বর ভূমির সবুজে আখ্যান
পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে নিহিত বন্যভূমির সততা
বইয়ের পাতায় অক্ষরের নিরাপদ আশ্রয়ে রক্ষিত
পূর্বাপর আপোষহীন কন্ঠস্বর ——- এসবই ছিল আমাদের
প্রতিদিন সকালবেলার জানলাঘরের প্রথম উষ্ণতা
সব জলে নিজস্ব অক্ষর ডুবিয়ে বসে ছিল
আমাদের করতলের পূর্বপুরুষ
তবুও কোথাও যেন বাঁধ ভেঙে গেছে বলে
সারারাত নদীর উঠোন দিয়ে পায়চারি করলো
সকালের সমস্ত প্রতিবেশীরা
বয়স হয়ে গেছে বলে সমস্ত গল্পের চুল আজ পাকা
যাবতীয় অপেক্ষার ধৈর্যবিন্দু কখনও আসে না গণনায়
অথচ কিছু যান্ত্রিক কান্নার বিষন্ন রঙে
সারাদিন মেঘলা হয়ে আছে দুপুরের ছবিঘর
জনবহুল স্টেশনের কথা বলতে মাংসের হাহাকার
আর অগণন ভেজা ঠোঁট
আড়াল না থাকায় হাড় আর রক্তের তুলিতে ডুবে যাচ্ছে
ক্যানভাসের সমস্ত উর্বর ভূমির সবুজে আখ্যান।
চন্দন ঘোষ
জ্যোৎস্না-কথন
“চল, আবার প্রেম করি দুজনে। চল, আবার বাবুঘাটের সেই কদম গাছটার নীচের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। চল, আবার বাদামওলা এসে আমাদের চুমু খাওয়া ভেস্তে দিক। চল আবার টেলিপ্যাথি ম্যাজিকে দেখা হয়ে যাক জল থই-থই কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে। জ্যোৎস্নাময় লেপচাজগতের রাস্তা ধরে হেঁটে চাঁদের বাড়িতে যাই। চল, চল, আবার সেই ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আর একবার প্রোপোজ কর আমায়।
#
এ কী! তুমি কাঁদছ? চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে দু-ফোঁটা জল। আমার হাতের মধ্যে তোমার আঙুলগুলো কেঁপে উঠছে নাকি? অথচ ওগুলো তো অনেক অনেকদিন কাঁপেনি। তুমি শুনতে পারছ আবার? আবার বুঝতে পারছ সব? অনেকদিন তুমি শুধু তাকিয়ে রয়েছ আমার দিকে। তোমার প্রিয় ফার্স্ট ফ্লাশ চা-ও খেতে পারনি। গড়িয়ে গেছে ঠোঁটের কোনা দিয়ে। আমিও তো অনেকদিন কাত হয়ে শুয়ে আছি তোমারই পাশে। পা-দুটো আজ আর নড়ে না। একটা ব্রেকডাউন গাড়ির মধ্যে শুধু টিকটিক করছে ওই মগজটা।
#
জড়িয়ে ধর আমার আঙুল। ভোর হয়ে আসছে। পূর্ণিমার চাঁদের মেয়াদ শেষ হয়ে এল। জানলার ধারে কাঁঠালগাছের পাতার নীচে ডেকে উঠেছে ভোরের প্রথম কোকিল। পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে। ওরা কি এবার বেরোতে চাইছে?
#
চল, আমরা আবার হাত ধরাধরি করে হেঁটে হেঁটে
চলে যাই আমাদের নিজস্ব চাঁদের বাড়ির অভিমুখে।”
শুভ্র সরকার
১. জীবন, এক গোরখোদক
একটা ডাক
বোঁটার যতোটুকু প্রশ্রয় জোটে
পাতার কপালে
অমন
একটা ডাক
জানালাকে করে তোলে
গ্রহণযোগ্য
‘কুয়োয় পড়ে যাওয়া ঘটি-বাটি তোলাবে গো’
মেয়েটি
তীরবিদ্ধ হরিণীর সুনির্মম দৌড় খুলে
উড়িয়ে দেয়
জীবন—
ভরদুপুর কুয়োর ভিতর থেকে
লাফিয়ে ওঠে একজোড়া
উজ্জ্বল লাল বর্ণের
খরগোশ
রাত হলে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে
অচেনা পুরুষসঙ্গীর
হাতে
ফেটে পড়ার অহংকারের ভিতর লাল হয়ে ওঠা ডালিমের সংসারভাবনায়
জীবন
এক গোরখোদক
প্রতিনিয়ত যে লাশের দিকে গড়িয়ে যেতে দেখে
কবর
২. প্রত্যাবর্তন
মৃত মানুষের হাতেও ছড়িয়ে আছে আয়ুরেখা
তুমি সেই পথ ধরে ফিরে আসো
ফিরে আসো
যেখানে বাড়ির দরজা জানে না
নিজেকে খুলে দিলে কেউ কেউ ঠিকানা হয়ে যায়
ঢেউ জানে না, ভেঙে যাবে জেনেও কেনও সে ফিরে যায় নদীতীর!
ভাঙা পাড়, মাতৃস্তনে শিশুর নখের আঁচড় বুকে নিয়ে
শুধু জানে—
তোমার ফিরে আসা, প্রিয়
অন্ধ লোকটার রঙ না জেনে
কুড়িয়ে নে’য়া ফুল
৩. দুর্যোধনের উরু
(জয়ন্ত জিল্লু, আপনাকে)
ক
মানুষ অনেকটা জানালার মতো। আটকাতে ভুলে গেলেই ভিজে যায়। ভেজা জানালার অধিবিদ্যার ভিতর চুল খুলে রাখে দ্রৌপদী। আর তুমি পাখিদের যৌনতা নিয়ে কল্পনা করো। বুঝতে পারো— যৌনতার শেষে থাকে বাবার মাকে ছেড়ে যাওয়া। গাছকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটা পাতা, পৃথিবীকে শীতকালের দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে কুয়াশা একপ্রকার অন্যমনস্কতা। তুমি বুঝতে পারো— ভুলে যাওয়া অব্দি মানুষ মনে রাখে।
আমার মনে রাখা আছে বৃষ্টির অভিসন্ধি। যার ভিতর জানালা খুলে তুমি আমার থেকে নিজেকে ফেরত চেয়েছিলে। এরপর আজীবন জানালার উদ্দেশ্যে টোকা নয়, আমি ছুড়ে দিয়েছি দুর্যোধনের উরু।
খ
ক্লিপের দাঁত ফাঁকি দিয়ে প্রতিবেশীর ছাদে উড়ে যাওয়া তোমার লাল অন্তর্বাস মেয়ে— সে বোঝে ফেরত চাওয়ার সঙ্কোচ।
৪. বাঙলা ভাষা
নদীর গালের টোল পার হলে আমাদের বাড়ি। যেখানে জল ও জালের পার্থক্য জানতে আপনাকে বেছে নিতে হবে মাছের জীবন। যেখানে বাড়ির ভেতর আছড়ে পড়ে মাদি কুকুরের সন্তানকে খুঁজে বেড়ানো। উঠোনে দড়িতে নেড়ে দে’য়া শৈশব মাড়ভাঙা কাপড়ের মতো খুলে যায়। খুলে যাওয়া শায়ার বাঁধন যেখানে চৈত্রের মাঝপুকুর। শীতকাল প্রথম ঋতুস্রাবের স্মৃতির মতো বিস্তীর্ণ। হাওয়া এমন অবৈতনিক ঘুড়ি, ওড়ার দৃশ্য থেকে নদী শিখে নেয় পাখিদের মিমিক্রি। জলের পাঁজর বিদ্ধ হয় মাছরাঙার মনোযোগে। যেখানে প্রতিরাতে দিনমজুর স্বামীর বুকে চড়ে, স্ত্রীলোকেরা নিজের ঠোঁট কামড়ে প্রার্থনা করে ভোরবেলা।
৫. বাঙলা কবিতা
কুড়ালের দাঁতে গাছের শরীর—
চরবাসীর দুঃখের ভেতর জেগে ওঠা ত্রাণের নৌকার
পরিহাস
যেন
বহু বছর পর, বাবা
ধুলো ঝেড়ে লাল মলাট দে’য়া একটা খাতায়
মেলে ধরছেন প্রাক্তন প্রেমিকার
যোনি
স্রোতস্বিনী দে
আরও একটা দিন
এক আকাশ জোছনা মাথায়
পাড়ি দেব দূর মোহনার হাতছানিতে,
বালিয়াড়ির গন্ধ মাখা বিকেল যেখানে
পূরবীর তুলিতে আঁকে দিগন্ত ,
অচীন সেই বালুতটে সিবিল আজও
খোদাই করে চলে অমৃত্যুর আখ্যান।
যুবতীর হাজার বছরের বৃদ্ধ শরীর থেকে
জেগে ওঠা ঘ্রাণে, প্রাচীন নগরীর যত প্রেত
এসে ঘিরে ধরে যুগান্তপারের সভ্যতাকে।
সাক্ষী থাকে ছায়াপথের অলিতে গলিতে ফেরা নক্ষত্রের দল…
কী বলব তাকে, হঠাৎ যদি মুখোমুখি দাঁড়ায় সেই নাবিক,
বেরং নোনা জলের ক্ষনিক আভাসে জুড়িয়ে দেয় প্রতিক্ষণের দহন…
তার ভ্রমরকালো চোখের তারায়
নিজের বিকৃত প্রতিফলন দেখে শিউরে উঠি যদি!
হারিয়ে ফেলি ভাষা চিরন্তন তমসার গহ্বরে!
সেদিনও বুঝি এমনি করেই অচেতন চেতনার জাল ছিঁড়ে আদিম অর্কিডের বন্য সুগন্ধে ধোঁয়াটে সন্ধ্যে গড়িয়ে
চুঁইয়ে নামবে রাত, আমার চেনা শহরের ক্যানভাসে। শিরায় শিরায় ছলকে যাবে
সিগারেটের শেষ রেশটুকু, নিঃশেষে পুড়ে ছাই হয়ে হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
আশাবরী আলোয় নেয়ে শুরু হবে আরও একটা দিন…
প্রণয় দাস
স্মৃতি
আজ ঝড়ের মুখে পড়বার আগে
থেকে থেকে ভেসে আসছিল তোমার মুখশ্রীটি
সেই শান্ত বিকেলে অশান্ত বৃষ্টিভেজা
ও তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখবার মুহূর্তগুলো
মুহূর্ত ফুরিয়ে যায় তবে স্মৃতিরা ফিরে আসে গভীর হয়ে
জীর্ণ হৃদস্পন্দনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা।
প্রেম ও প্রেমালাপের প্রাচীন পন্থা গুলিও একে একে তারপর
এবং রয়ে যায় ততখানিই সাবলীল।
তুমি উপহাস করেছিলে যখন জানিয়েছিলাম
‘হাওয়ায় কথা ভেসে আসে’
আজ বলছি ‘মেঘে স্মৃতিরা ভেসে আসে’
এবার নিশ্চয় আমায় পাগল বলে জানবে তুমি –
সে নাহয় বললে তবে এদিনে আমি
সময়ের সান্নিধ্যে হয়ে উঠছি বেমানান
আর সময় তোমার সান্নিধ্যে _ আচ্ছা
সবকিছু এতো বেমানান হয়ে ওঠে কি করে ?
জানো বাবুঘাটের যে সিড়িটিতে আমরা বসতাম
সেখানে এখন মা গঙ্গা শ্যাওলা জমিয়ে রেখেছে
যেন কেউ বসতে না পারে তাতে
আসলে শ্যাওলা নয় স্মৃতি, প্রেম কিংবা বলতে পারো মেঘ।
তোমার আমার ব্যবধানে যে অমোঘ মেঘ জমে আছে
তা বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়নি এখনো
শুধুই ঝড় আর ঝড় সে এক উত্তাল ঝড়
যা এক জীবনে থামবার নয়।
আসলে ঝড় থামানো যায় তবে প্রলয় নয়
তুমি যে প্রলয়ের প্রলেপ ছেড়ে গেছো
তা ভুলে থাকা যায় শুধু মুছে ফেলা যায় না স্মৃতি থেকে।
কেননা বর্ষার মেঘে স্মৃতিরাও ভেসে আসে অহরহ।
বিস্মৃতি
রেস্তোরায় বসে আছি
হঠাৎ শুনতে পেলাম ভাঙা স্বরে কেউ ডাকছে _ ওয়েটার,
একবার এদিকটায় __ বড্ডো ইচ্ছে হলো
পেছন ফিরে বলি কে আপনি ?
আমাদের সংবিধানে বাক স্বাধীনতার কথা বলা হয়ে থাকে
তবে চাইলেই সব কিছু বলা যায় না
চাইলেই ষাট-এর ঘরে এসে প্রেম জীবনের
স্মৃতি গুলিকে ফিরে পাওয়া যায় না।
যথারীতি না পেরেছি মহোদয়ার স্বর চিনতে
না পেরেছি পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করতে
মহোদয়ার নাম কি আমার জানা ?
কিংবা মহোদয় কখনো কি প্রেমে পড়েছেন ?
আসলে শহরটাকে চিনতে আমার আর বাকি নেই
ভাষা ভাষা স্মৃতিতে আমার মনে পরে
একটা সময় ছিল যখন
তুমি, না না তুমি নও আমি , আচ্ছা হয় তুমি নয় আমি
হয় তুমি নয় আমি পথ ভুল করতাম
শেষ যখন তোমার চোখে জল দেখেছিলাম
অভিমান করে তোমায় একটু বকে দিয়েছিলাম
আচ্ছা প্রিয় তারপর ?
তুমিই বোধয় একদিন বলেছিলে,নাকি আমি ?
আচ্ছা হয় আমি নয় তুমি বলেছিলে সময় বড় অভিমানী
সময়ের উর্ধে সকলই নাকি অসম্ভব
দিন রাত্রি নাকি সময়ের আদতেই চলে ,
কেন বললে না প্রয়োজনে সময় বেমানানও হয়ে ওঠে,
সময়ের সাথে সাথে স্মৃতি শিথিল হয়ে আসে !
আজ সাহস করে যখন রেস্তোরায় পেছন ফিরে দেখেছি
ঠোঁটের কোন তিলটা বড্ড চেনা মনে হলো।
অদৃশ্যে দৈববাণীর অভয় পেয়ে যখন জিজ্ঞাসা করলাম,
মহোদয়ার নামের সঙ্গে আমার কোনো কী যোগ রয়েছে ?
তার রূঢ় চাহনিতে বুঝতে পেরেছি , ষাটের ঘরে এসে আমার মতো
স্মৃতিকে পেছনে ফেলে, সেও বিস্মৃতিকে আপন করে নিয়েছে
দেবমিত্রা দাস
বান্ধবী গাছ
একদিন, দুদিন, তিনদিন,
আমি ডাকবাক্সতে চিঠি ফেলেছি।
আমার দরজায় কোনো তার কড়া নাড়েনি।
একদিন, দুদিন,
আমি ব্যালকনির তারে কথাদের মেলে রেখেছি।
ভেজা কথা রোদে শুকিয়ে গেছে।
বৃষ্টির ছাঁটে তবু কথারা ভেজেনি।
একদিন,
আমি কথার পাশে কথা সাজিয়েছি,
কথার ভাঁজে কথা লুকিয়েছি।
বহুদিন কথায় কথায় রাত ভোর হয়নি।
আঙিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কথারা
বাষ্পে ভেসেছে, অল্প হেসেছি আমি।
মুখবন্ধ খামে, অভিমানের সিলমোহর পড়েছে।
আলোর মত কথাদেরও বিচ্ছুরণ হয়,
প্রতিফলন হয়।
কথার বুকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে
আমার কথার ঝাঁক।
গুটি গুটি হেঁটে এসে চোখ পেতে বসেছে।
তারপরেই সেই ভীষণ নিম্নচাপ।
অতিমারির মত রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে মনখারাপ।
নৈশ বাতি তবু জ্বলছিল।
তারপরে বিদ্যুৎ চলে গেলো ঝড়ে।
আছাড়ি পিছাড়ি কেঁদেছিল মেঘ।
আমি শুধু সাক্ষী ছিলাম,
আমি, শুধুই সাক্ষী ছিলাম।
পরদিন সেই বৃষ্টির অন্য রূপ,
পেলব, কোমলাঙ্গী, এক উন্মাদিনী।
চিলেকোঠার বন্দিনী কথারা
হঠাৎ জামিন পেয়ে সেদিন দেখে,
পাশের বাড়ির ছাদে, বান্ধবী কথারা
বৃষ্টি ভিজেছে রাতদিন, তাদেরই অপেক্ষায়।
অর্ঘ্যদীপ
সাঁকো
জটিল কিছু লেখার মতো নেই
সহজ, তুমি অন্য দেশে থাকো
বৃষ্টি পড়ে অঝোর সারাদিন
স্মৃতির ভিতর দোদুল্যমান সাঁকো
পার হয়ে যাই সন্ধে নামার আগে
কোথায় যেন পিয়ানো বাজে দূরে
জটিল কিছু ভাবতে পারি কই?
আমি কেবল সহজ কোনও সুরে
তোমায় খুঁজি অন্য সবার মাঝে
বয়স বাড়ে বৃষ্টিপাতের মতো
এক জীবনের এইটুকু সঞ্চয়
সহস্রবার হৃদয় ভাঙার ক্ষত
রইল প’ড়ে স্মৃতির ভিতর সাঁকো
হাওয়ায় দোলে মেয়েলি ডাকনাম
জটিল কথা মিথ্যে হল সবই
সহজ, তোমায় বিদায় জানালাম…
অসাধারণ সব creation, তার মধ্যেই বি স্মৃতি মন ছুঁয়ে গেল, এরকম সুন্দর সুন্দর কবিতা আরো পড়তে চাই।
আশা রাখি ভালো কবিতা পাঠকদের উপহার দিতে পারবো। পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ।।