তৃতীয় বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা ✦ কবিতা
ফিচার ছবি : অঙ্কিতা বিশ্বাস
দুর্গা
ডাঃ সুপ্রতিম মন্ডল
তোমার দুর্গা মারা গেছে
অন্ধ সমাজ ,আগুন জ্বলে,
সেই আগুনে জমা আঁধার
ঠান্ডা শরীর কথা বলে।
সেই যে শরীর শুধুই নারীর!?
মুখ বাঁধা তার একটা কাপড়
নগ্ন সমাজ তারই মতন
আজ গণতন্ত্র সন্ত্রাসের গড়।
পচে গেছে যেখানে শিকড়
সেই গাছে ফলবে কেমন করে
নতুন ফল…..
রক্ত শীতল বিচার চায়
জানতে চায় না কে কোন দল।
মাংসের দোকান
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
গতকাল একটি লোক আমার জন্য ব্যাগে করে একটি মোরগ এনেছিল
মেপে দেখলাম মনে মনে
মোরগের গায়ে মাংস রয়েছে কিলো আড়াই
অথচ ব্যাগ থেকে বের করা মাত্র অসহায় মোরগটির দুই চোখে আমি
আড়াই কিলো মাংস নয়
আড়াই মিনিটের ভয় দেখতে পেলাম।
মোরগের চোখের সেই চাহনি আমাকে হঠাৎ ভাবিয়ে তুলল
কোনদিকে বাটখারা রাখব আমি
আড়াই কিলো নাকি আড়াই মিনিট
মনে হল প্রতিদিন এভাবেই ব্যাগ থেকে বের করে আনা হচ্ছে ওদের
কারো ওজন ষাট, কারো বাষট্টি, কারো চল্লিশ
কেউকেউ ষোলো বা সতেরো।কেউ তারো কম বা বেশি…
ওদের সকলের দুই চোখে এমনই ভয় দেখেছি
আড়াই মিনিটের ভয়
ওই মানুষটি চাইছিল আমি মোরগটি নিই
ওই মানুষটি আমাকে খুশি করতে চেয়েছিল
ওই মানুষটি হয়তো আমার অনুরাগী
কিন্তু আমি ওকে বললাম আমি আজকাল আর মাংস খাইনা …
আমি একথা বলতে বলতে দেখলাম
আমার চোখেও সেই
আড়াই মিনিটের ভয় নেমে আসছে…
লক্ষ কোটি তারার স্বর
অভিস্নাতা সান্যাল
মর্গ , চিতা ধর্ষিত আজ সমাজ জুড়ে ধর্ষকামী মনের আগল ভাঙরে আজি,জাগিয়ে তুলতে আমার আমি।
শান দিচ্ছে হিংস্র হায়না,স্বাপদ আছে মৌতাতে
বিপন্বতায় ভুগছে সমাজ তুইও কিন্তু লীন তাতে।
গা এলিয়ে,পা দুলিয়ে,আরাম যতই করিস ঘরে
তোর বুকেতেও মারবে ছোবল,বাঁচবিনারে বাঁচবিনা
যতই ভাবিস থাকবি দুরে পারবিনারে পারবিনা।
ক্রোধের আগুন আকাশ ছুচ্ছে, মানুষ আজ দিচ্ছে হাঁক
হায়না,স্বাপদ,ধর্ষকামী সমাজ থেকে নিপাত যাক।
চড়াম চড়াম ঢাকের শব্দ যতই বাজাস অন্দরে
জাগছে মানুষ উড়ছে নিশান বিষন্নতা ভেদ করে।
সাত সাগরে ঢেউ উঠেছে বজ্ৰ শোনায় হু হুংকার
মোমের আলোয় আকাশ জুড়ে লক্ষ কোটি তারার স্বর। ।
সময়
সৌরভ মহান্তী
মেয়েটা কাঁদছে
মেয়েটার চোখে জল নেই
আজ রক্ত
রক্ত ঝরেছে রক্ত ঝরেছে
আগেও এমন রক্ত ঝরেছে অনেক
এবার রক্তে আগুন জ্বালাও
এবার গলাতে শব্দ যোগাও
আজ ফেটে পড়ো সব
ফেটে পড়ো চিৎকারে!
শাসকের ভয়ে আর কতকাল!
আর কতকাল চুপ করে সব সইবে!
রক্ত ঝরছে! রক্ত ঝরেছে অনেক
আগেও এমন রক্ত ঝরছে অনেক
উপড়ে ফেলো দোষীর মাথা!
উপড়ে ফেলো শাসকের ভয়!
এখনই সময়
এখনই সময়
রাস্তায় নামো সব।
মেয়েটা কাঁদছে
মেয়েটা কাঁদছে
মেয়েটার চোখে জল নেই
আজ রক্ত!
খড়কুটো
সঞ্চারি সিনহা রায়
এই যা পাওয়া গেলো
এটাকেই সব
বলে ধরে নিতে হবে।
এরই জন্য মায়ের গর্ভে থেকেছি নয় মাস,
তারপর আরও বৃহত্তর গর্ভে
চেষ্টা করেছি মুঠো খোলার।
পেটের ভিতর সিঁধিয়ে থাকা পা
আলগা করেছি ক্রমশ।
এই যা পাওয়া গেলো
প্রেম বিরহ আন্দোলন
কণিষ্কের মুণ্ডহীন শরীর
এবং সুবিচার
এটাকেই সব
বলে ধরে নিতে হবে।
এরই জন্য অপেক্ষা করছি বহুজন্ম,
বহু পথ মৌন মিছিলে-
আড়াল করেছি প্রেমিকের পরিচয়।
এই যা পাওয়া গেলো
সহজে হারিয়ে ফেলা
এই যা পাওয়া গেলো
না পাওয়ার বাসনা
এটাকেই সব, এটাকেই সব বলে
মেনে নিতে হবে।
প্রশ্ন
ঔরশীষ
আমি কি পেরেছি?
অন্তত চেষ্টা করেছি কী?
শুধু এটুকুই দাবী আছে আজো-
প্রতিরাতে রাস্তায়
প্রতিদিন রাস্তায়
কারা যেন টিটকারি দেয়
আমরা কী পারি নি?
যতবার ভেবেছি ঘুম নেমে এলো
আমাকে ঘুমোতে দেয় নি,
মেয়েটির চিৎকারে
মানুষের চিৎকারে
ঘুম ভেঙে গেছে। সজাগ দেখেছি
তখনো অনেক লোক
রাতের দখলে।
আমাদের কন্ঠস্বর
কদ্দুর পৌঁছাবে?
তবে ওই চোদ্দতলা কাঁপছে আজ
প্রতিটি ইঁটের ভিতর ঘুন
ওরাও তো জানে এই ধর্ষণ ও খুন
প্রাতিষ্ঠানিক
অতএব আমাদের টুঁটি টিপে ধরবার আগে
আমাদের বোধ ও মনন লোপাট করবার আগে
আমাদের উৎসবে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে
আমরা নিজেদের কাছে স্পষ্টবাদী হতে চাই
আরো একবার, এবং বারংবার
প্রশ্ন ছুঁড়ে, শুদ্ধ হতে চাই-
আমি কি পেরেছি?
অন্তত চেষ্টা করেছি কী?
সেই সব বাঙালিদের জন্যে
রঙ্গিত মিত্র
আমার পায়ে পায়ে
আগুন জ্বলে, শোনো
আমার পায়ে পায়ে।
এই যে আকাশ, ওই যে আকাশ
ডাকছে আমায়,
তবু,
আমার পায়ে পায়ে।
এই যে তুমি ভুল ভেবেছ
চিমটি কাটো, আমায়
সূর্যদানা আর এসো না
তবু আমার পায়ে পায়ে
এতো অন্ধকার, রাত্রি জেলে
চোখের ভিতর আলো
তবু আমার পায়ে পায়ে…
জতুগৃহ
দেবজ্যোতি রায়
বিকেলের আলো ক্ষয়ে যেতে যেতে শ্লোগান দিচ্ছে,
রক্তকালির ফ্লেক্স, পোস্টারে আগুনের ফণা
প্রমাণ লোপাট, বদলে ফেলেছে স্বপ্নকে লাশে?
সাক্ষ্য দিচ্ছে বিস্ফোরণের ইতিহাসকণা।
রাস্তা বলছে আপরাধকারী- নিপাত যাও
জনতা তুলেছে আখরি আওয়াজ- মৃত্যুদণ্ড
প্রতিটি মিছিলে শোক, প্রতিবাদ- শব্দব্রহ্ম শনাক্ত করে-
অনেক গভীরে ষড়যন্ত্রের শেকড় ছড়ানো,
আত্মত্যাগের নামাবলি গায়ে চলেছে ভণ্ড!
শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারেনি, কেউ কোনোদিন
সীমানা, মেয়াদ, শেষ হয়ে যায় ফতোয়া জারির।
শিল্পশোভন সমবেদনাকে সন্দেহ ক’রে
শত তরঙ্গে দখল নিয়েছে গোটা রাত্রির।
মাথার ভেতর জনজোয়ারের অজস্র ঢেউ
গ্রামে ও শহরে তীব্র ঘোষণা ইস্তাহারে
আগ্নেয়াস্ত্র পরিণত হবে খেলনা পুতুলে!
নিশাচর পাখি চোখ রেখে গেছে, শিকারি দৃষ্টি
শাসক দেখছে- জতুগৃহের অমোঘ আগুনে সব পুড়ে যায়, বানানো গল্প, ভাষ্য ও টীকা।
স্কিনগার্ড
অর্ক সান্যাল
দেহের ভিতর কিডনি, লিভার, কভার করে চামড়া-
ভিতর টা তো একই রকম, বাইরে ওরা আমরা।
পুরুষ নারী, সমাজ, স্পর্শ, এসব আটকে চামড়া তেই-
দৃষ্টি সুখের ধর্ষকরা লুকিয়ে মনের কামড়াতেই।
রোদ আটকায় সান স্ক্রিন যদি, দৃষ্টি থামবে কিসে?
ঠিক কবে থেকে লিঙ্গ দুটি থাকবে মিলে মিশে।
শরীর যদি কেতাব হবে, মলাট গুলো ভিন্ন, কৌতূহলের বিকৃতি তাই করবে ছিন্ন ভিন্ন?
ঠিক কি আছে সুতোর তলায়, ঠিক কি আছে নীচে?
চেরা নদীর লালসা গুলো বইছে স্রোতে মিছে।
মিথ্যা সবই, হরমোন নাকি স্নায়ুর কথা বলবে?
সৃষ্টি এবং ধ্বংস কেন এক ছিদ্রেই চলবে?
“না” এর মানে “না” বোঝা, বেশ শক্ত বিষয় অতি-
বুঝতে কত লাগবে সময়, চলবে কত ক্ষতি?
সেই রাতে যদি বিকৃত কাম, মানবাধিকার খুঁজতো –
Anatomy টা ওদের থেকে মেয়েটা বেশি বুঝতো।
ম্যাঁয় সময় হুঁ
ভাস্বতী গোস্বামী
সিন ওয়ান টেক ওয়ান
নিখুঁত উদয়-অস্তর প্ল্যান মাফিক
ইঞ্চি টেপে অদৃশ্য হবে মাঠ
তার সময় উঁচিয়ে দৌড় মারল কেউ
আর লুঙ্গির ঝরা জল স্পষ্ট হয় কুরুক্ষেত্রের গা-য়ে
অর্জুনের ঘোড়াগুলো সে-ই জল খায়
আর নড়েচড়ে
পরিবর্তন আসছে…
কাট্
অপেক্ষায় একটা রাষ্ট্র ধরবে গাছে
ফল
এখন পুরো পংক্তিটাই যতি
যতির কথায় মনে পড়ল
একটি মেয়ে জ্যোতি
যা’র সূর্যগুলো চিবিয়ে খেলো কেউ
তাদের হাড়ে শিকার লেখা
তার লাস্ট বেলও ডায়েরি হয়ে গ্যাছে কবেই…
সিন টু টেক থার্টি টু
কমলা বাগানে ঢেউ ওঠে
যখন গান বদলে দ্যায় স্কেল
সকাল যায় সাইকেলের দেশে
বিকেল ফিরে আসে দাগের ওপর দিয়ে
মনে পড়ে
আগুনের গন্ধে আলো না জ্বললেও
দাঁতের পরীক্ষা নিতেন কেউ…
কাট্
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার না
এই জন্ম উপত্যকাও আমার না
গন্ধরাজ লেবু থেকে ‘মা’ হতে চাওয়া সময়টুকু ধ’রে
এই ‘আমি’-ও আমার না
( ডিসেম্বর ২০১২। দিল্লির রাজপথে চলন্ত বাসের মধ্যে একটি মেয়েকে গণধর্ষণ ক’রে, তার যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে পাশবিক অত্যাচার করা হয়। মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল। কুখ্যাত এই ‘নির্ভয়া’ কেস কবিতাটির উৎস। )
চোখ রাখুন টিভির পর্দায়
ভাস্বতী গোস্বামী
অমলধবল ডালপালা
খুকুমণি ওঠো রে…
মমবাতির আলোয় আলোয় রাত হেঁটে যাচ্ছে
পদ্ম থেকে খুলে পড়ে হাত পা
চাঁদের গায়ে ছিটকে যাওয়া তরল
কোজাগর জাগে
কে?
ভূতুড়ে সাইট
এখন মেরুদণ্ড ভেঙে ভেঙে গোছাচ্ছে শ্রমিক
তার শব্দটা কলমে ফিট হচ্ছে না
সঙ্গ পরশহারা…
গোল হয়ে বসে আছি সবাই
টুকরো টুকরো মাংসে ঝোল লাগছে
লাল লাল ঝোল রক্তের স্বাদ
টুকরো টুকরো হয়ে বসে আছে সময়
নৈশভোজের রাতে
পালকি চলে রে–এ—এ পালকি চলে…
ফরেনসিক এসে গেছে
শরীরের চিহ্ন নেই কোথাও
ভূতুড়ে বুদবুদগুলো জাগছে, ঘুমোচ্ছে, জমছে
তন্দ্রামতোন
মেঘ শুকিয়ে যাচ্ছে ধোঁওয়ায়
পরিষ্কার ন্যাপথালিন মোড়া ফরেনসিক
পালকির দাগে এসে দাঁড়ালো
জানে না কি মরণ নাচে…
দাঁতের বয়স নেই, ঘুম নেই
মাটিতে মিশছে না কিছুতেই
জোরালো অন্ধকারের মুখে ক’টা দাঁত ফুটতে দেখা গেল
টর্চগুলো বে-শরম আলো খোঁজে
জোনাকিরাই এ যাবৎ অন্ধকার ছিল
( সেপ্টেম্বর ২০২০। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে এক দলিত মহিলাকে গণধর্ষণ ক’রে হত্যা করা হয় এবং তারপর পুলিশি ব্যবস্থাপনায় সকলের অলক্ষ্যে তার দেহ দাহ করা হয়েছিল। এই কাহিনীই কবিতাটির প্রেরণা।)
চোখ রাখুন টিভির পর্দায়
ভাস্বতী গোস্বামী
আইয়াপ্পা ও মোহিনী
তাক্কা তাক্কিট্টা
জুন জুন করে পাখিদের ডানা হলো
আকাশটা জাফরি হয়ে যায়
বৃষ্টিবেলুন
মাটিতে পড়েই ফুঁসে উঠছে আবার…
তাক্কিট্টা তাক্কাদিমি
মা শুয়ে আছে রাস্তার ওপর
বুকে হাত দিয়ে দ্যাখ্ শ্বাস পড়ছে কিনা
অন্তর্বাস কেটে কেটে মন্দিরচূড়ো বানাচ্ছে মিস্তিরি
স্তনের আলোয় পরব আসবে…
তাক্কাদিমি ধিধিথেই
ভরা মাসে জোয়ার এলে তারারাও ডুকরে কাঁদে
কোন নড়াচড়া বোধ করি না আর
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে
মা ভিজে গেছে
জুন জুন মেঘ পাখি হয়ে দরজায় দাঁড়ালো…
তেই তেই ধিধিথেই
নূপুরে অশুচি ছিল
তাই টান মেরে খুলে দিয়েছে
জুন এখন পরিষ্কার, শীত এলো ব’লে
দরজা বন্ধ করছ কেন?
নূপুর বাঁধব কোথায়?
ধিধিথেই ধিধিথেই ধিধিথেই
পদ্ম ফুটিয়ে ফুটিয়ে একটা মন্দির বানিয়েছি
স্তনের মুখে দেবতা বসে আছে
এটা তো মোহিনীঅট্টম, না রে?
তালি দিতে দিতে শিশু আইয়াপ্পা হয়ে ওঠে
গোপুরমের কুয়াশায় মোহিনীস্বচ্ছ্তা
শুয়ে থাকা মায়ের কোল নূপুরে কেটে গেছে
( ২০১৮-য় সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, কেরলের সবরিমালা মন্দিরে ২০১৯-এর জানুয়ারি দুজন মহিলা প্রবেশ করেন। ঘটনাটি আলোয় আসার সঙ্গে সঙ্গে এঁরা সমাজে তীব্র বিরোধিতা ও শাসানির সম্মুখীন হন এবং মন্দির কর্তৃপক্ষ ও পূজারীরা মন্দির প্রাঙ্গন শোধন করার ব্যবস্থা নেন। কবিতাটি সেই ঘটনা কেন্দ্র করে। )
চোখ রাখুন টিভির পর্দায়
ভাস্বতী গোস্বামী
ইণ্ডিয়ান পিনাল কোড ৩৭৬
মিছিলের পায়ে গান
অন্যদিকে দু একটি মানুষ
ভার্চুয়াল মানুষ বদলে দিচ্ছে গানের ভূমিকা
নখের দিন বেড়ে ওঠে
অন্ধকারে তার টুকরো
নাম মনে পড়ছে না
গ্রাফিক্সে মুখ ব্লার হল
কান্নাও তত ভাইরাল নয়
বুক পেট নাভি চিবিয়ে
কোমরে পালক ছিঁড়ছে কেউ
তার নামটা মনে পড়ছে না
দু চোখের পাতায় গুলি শুনলাম
রেললাইন আর বসতির বুক চিরে
রাস্তা, অবিরাম পার হয়ে যাচ্ছে
(অক্টোবর ২০১৭।বিশাখাপত্তনমে প্রকাশ্য দিবালোকে অগুনতি পথচারীর চোখের সামনে ধর্ষিতা হন এক মহিলা। সে দৃশ্য ভিডিও হল, ভিডিও ভাইরাল হল, অথচ কেউ এগিয়ে আসে নি সেই অসহায় নারীর সাহায্যে। কবিতাটি সেই ঘটনা-কেন্দ্রিক। )
.
চোখ রাখুন টিভির পর্দায়
ভাস্বতী গোস্বামী
ঘুড়ি
মাঠ বেয়ে নেমে আসছে ছায়ার সানাই
একটা লাল ঘুড়ি পুড়তে পুড়তে হারিয়ে গেল
এ মাথায় বিলাওয়াল না রেডিও?
শিরদাঁড়া গুটিয়ে রাখছে অন্ধকার
গুহার নীচে জল
সাঁতারের হাতগুলো আগে মেপে নেয়
হাড় আর বুকের ওজন
কে বাজায়?
অন্ধকার হুমড়ি খায়
আলোর অর্গ্যান
চোখ খাবলে নিয়ে
নদী পাহাড় উপত্যকা আর ফুলবাগানের টুকরো
আহা চোখ! আহা আলোর চোখ হয় না
(জুন ২০১৭। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে এক মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়।পরে আদালতের পথে যাওয়ার সময়ে,সেই মহিলার গায়ে অগ্নি সংযোগ ক’রে পুড়িয়ে মারা হয়। কবিতায় সেই হতভাগ্যের ছায়া।)
ন্যায়ের চিঠি
সৌম্যদীপ সান্যাল
তারা এলো, রাতে—
অন্ধকারে ঢাকা হিংস্র মুখ,
স্বপ্ন ভাঙল অঝোরে রক্তের ধারায়,
নির্বাক হলো নদী,
শুন্যতার মাঝে বুকের আর্তনাদ।
তুমি ছিলে ফুল,
তোমার গায়ে ছিল ভোরের সুবাস,
তাদের ছোঁয়ায় ঝরে গেলে,
মাটির নিচে হারিয়ে গেলে
অন্যায়ের অন্ধকারে।
তুমি এখন শুধুই স্মৃতি,
তবু বাতাসে আজও ভেসে আসে
তোমার নীরব চিৎকার,
আমাদের বুক কাঁপিয়ে তোলে
প্রতিবাদের আগুন।
ন্যায় চাই,
এই পৃথিবীর বুকে চাই
তোমার জন্য সন্মান।
তারা যতই ঢাকুক মুখ,
জ্বলবে বিচার, হবে প্রতিবাদ,
তোমার জন্য আজও লড়ব আমরা।
তোমার রক্তে লেখা প্রতিটি ক্ষণ,
তোমার আর্তনাদে গাঁথা ন্যায়ের চিঠি—
সেই পত্রেই রবে আমাদের শপথ:
ন্যায়ের আলোয় হবে তোমার মুক্তি।
উল্কাপথ
চিরায়ত চট্টোপাধ্যায়
উল্কাপথে একলা চলেন ঋষি
এড়িয়ে সকল ব্যর্থ হাতছানি
সব বৈশাখী কালই আসবে বুঝি
ঝরা পাতায় ভরবে কী ফুলদানি
দু এক ঘণ্টা বৃষ্টি হবে জোর
এক দু ফোঁটা চোখের জলের ভীড়
আমরা কেউই ফিরবো না আর ঘরে
আমরা সবাই হত্যা পরের বীর
গর্জে উঠুক রাজপথের এই গান
কণ্ঠভরা শহুরে বিকেলবেলায়
আড়াল থেকে বেরিয়ে আসুক ক্ষয়
আমরা খুঁজি বালির ধুলো খেলা
তিলোত্তমা, তোমার নামের দেশে
আজকে উঠুক কান্না ভেজা ঝড়
উথাল-পাথাল আছড়ে পড়ুক ঢেউ
তোমার জন্য আমরা জাতিস্মর
দধীচি তোমার আত্ম বিসর্জনে
উঠলো বেজে ডঙ্কা নিনাদ রব
বধ হবে ঠিক মগধের এই দেশে
ছিন্ন হবেই জরাসন্ধের শব
একটু পরে রক্তে ভেজা গ্রামে
আসবে নেমে শান্তি অবশেষে
সেদিন তুমি চোখটি তুলে দেখো
অকাল বোধন পূর্ণ অনিমেষে….
মৃত্যু
সেলিম মণ্ডল
১
সব মৃত্যু একা করতে পারে না
কিছু কিছু মৃত্যু কাঁধে কাঁধ রেখে বলে—
লড়তে হবে
আমাদের লড়তে হবে
২
মৃত্যুও জন্ম দেয়
এত এত মানুষ নেমে পড়েছে রাস্তায়—
কী জন্য?
জন্ম দিতে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে।
৩
বদলা, না বদল— মানুষ কী চায়?
খুনির সাজা, না শাসকের গদি?
এই প্রশ্নের মাঝখানে শুধু আলো হয়ে থাকে মানুষের আঙ্গুলী
কণ্ঠরোধ
অনুস্কা সেনগুপ্ত
উৎসব ফিরে এলো ঘরের মেয়ে ফিরলো না,
সেদিও সূর্য উঠেছিলো তিলোত্তমার আকাশে,
তবুও তাদের ঘরে নিশিযাপন।
নারকীয় নিধন যজ্ঞের সেই রাতে
কণ্ঠরোধ করলো ওরা
চিরদিনের মতন।
তিলোত্তমা জাগলো, লক্ষ কণ্ঠে
কান্নার প্রতিধ্বনি-প্রাণ নেওয়ার আর্তনাদ
শুনলে তুমি?
শুনানির রাত আসুক, যেই রাতে রাজপথ হাসবে
অভয়া শান্তি পাবে, অভয়াদায়িনীর আগমনে।
সেই রাতে মিলবো আমরা উৎসব পালনে।
শিল কাটাও…
রিয়া চক্রবর্তী
আজ সারা সকাল জুড়ে আমি আমার জিভটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কথামৃতের তলায়, ম্যানিফেস্টোর নীচে, ফুটপাথের বইয়ের ভাঁজে… নেই… নেই… কোথাও নেই। অথচ কতও কীই যে বলত সারাদিন… “যাহা গম্ভী না হো, আশু ভী না হো”-র কথা, বারুদের কথা, মানুষের গল্প, মুক্তির গল্প, জেদের গল্প… একা পেলেই আমাকে শোনাত এসব…
আমি তখন রোদে পুড়ছি… প্রখর সে রোদ… হন্যে হয়ে ছায়া খুঁজছি… ছায়া পেলাম। কিন্তু জিভটা আমাকে একা ফেলে কোথায় যেন চলে গেল। দেখা নেই, শোনা নেই… আস্তে আস্তে আমিও বেশ ওকে ছাড়াই বাঁচতে শিখে যাচ্ছিলাম… এমন সময় হঠাৎ একদিন চৌকাঠে এসে দাঁড়াল আবার। থাকল কিছুদিন। পোষাল না। আবার বেপাত্তা। আস্তে আস্তে ওর অজ্ঞাতবাসের মেয়াদটা বাড়ছিল। আমি তখন সরীসৃপের মতো মাটি চাটতে চাটতে, মুখোশের পর মুখোশ বদলাতে বদলাতে আকণ্ঠ মঞ্চ দাপাচ্ছি… ভুলেই গেছিলাম যে ও কোনোকালে ছিল…
আজ, অনেকদিন পর, যখন বোবার অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত লাগছে…
যখন প্রলাপের কাছে পৌঁছতে চাইছি… তখনই খেয়াল পড়ল ও নেই… কোথায় এখন ওকে খুঁজি বলুন দেখি?… আসামের দিকটায় যাব একবার? কাশ্মীরে? নাকি উন্নাহে?
এভাবে যদি ও ছাড়া থাকে, তাহলে তো সরা দেশ, সারা দেশের গল্প জেনে যাবে একদিন… জেনে যাবে কারফিউ, কাঁটাতার, লক্ষ্মণগণ্ডি, গণধর্ষণ, ডিটেনশন ক্যাম্প… সঅব…
ওকে নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে? ভাবুন… ভাবুন… বরাহমিহিরও একদিন ঠিক এমনই সঙ্কটে পড়েছিলেন…
দেবীপক্ষের কয়েক টুকরো…
রিয়া চক্রবর্তী
কৈলাস থেকে নামছে উমা। কোচবিহারের কাছে কে যেন আর্তচিৎকার করে উঠল- ‘মাগো… বাঁ…চা…ও…’
লক্ষ্মীর মতো গলাটা না?
‘ও লককি… মা কী হয়েছে? কোথায় তুই?’
কে ডাকল তাকে? – রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লক্ষ্মী বায়েন চমকে উঠল। কতোদিন পর কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকল… বোন সতুকে যেদিন মিলিটারি জিপ এসে তুলে নিয়ে গেল, সেদিন লক্ষ্মী চুপ করে ছিল। যেদিন সতুর মাঝখান থেকে চিরে দেওয়া দেহ বিলের ধারে পাওয়া গেল, সেদিন লক্ষ্মী নিথর হয়ে ছিল। ভয় করছিল তার চিৎকার করে কাঁদতে…
বাতাসে কটু গন্ধটা তীব্র হচ্ছে ক্রমে… পণবন্দী দুর্গা মাহাতো থেকে মহামায়া রায়রা পুড়ছে। ঘামের মতো কিছু কান্না আটকে উমা সরেনের অ্যাসিড ক্ষত মুখে। অকালমৃত মেয়ে ভ্রূণটার কপালে তৃতীয় নয়ন… ব্রাহ্মণ-পথের ছায়া শ্যামা মান্ডির পিঠে বত্রিশ ঘা চাবুক…
মহালয়ার কুমোরটুলির… খোলা বাজারে বিকোচ্ছে দুর্গারা… দশ হাতেও নিজের আব্রু বাঁচাতে পারছে না দুর্গা…
তারাবতী কাউর শিউরে উঠে দেখে মহাযোগী শিব এসে দাঁড়িয়েছে তার দরজায়। প্রতি রাতেই আশ্রম জুড়ে চলে এমন দেবতা দেবতা খেলা… জ্বলছে তারাবতীর তৃতীয় নয়ন… বিনা অস্ত্রে তারাবতী এগিয়ে আসছে… লজ্জা ফেলে তারাবতী উঠে দাঁড়াচ্ছে…
শিব অবাক চোখে তাকে চিনতে চেষ্টা করে। নেশার ঘোরে সব অস্পষ্ট তার।
শিব দেখছে তারাবতী কাউরকে… দুর্গা দেখছে শিবকে… মর্তলোক দেখছে দুর্গাকে… কৈলাস ছেড়ে নেমে আসছে একা এক মেয়ে…
বিসর্জনের ঢাক বাজছে… কোন ঘরে আজ ফিরবে তবে উমা?
আর নয় ভয় হবেই হবে জয়
পূজা আচার্য্য মুখার্জ্জী
বিচার পাবেনা এই সমাজে, বিচারক নিজে দোষী।
হাত কাঁপে তাই নরপশুদের লাগাতে গলায় ফাঁসি।
কত নির্ভয়া এই সমাজে লোভের শিকার হবে?
যতদিন মেয়ে তুমি রইবে নীরব এই সমাজের ভবে…
ভুলে যাও সব মায়া মমতা, সুখের ঘরবাড়ি,
তুলে নাও হাতে মেয়েরা এবার বিজয় তরবারি।
কেটে ফেলো সব নরপশুকে, ঘুচে যাক কাম-লোভ,
বিজয় রথের সারথি হয়ে মুছে ফেলো যত অসম্মানের ক্ষোভ।
তাই আর চুপ নয়, করো চিৎকার, তোলো বিজয়ের হাত,
এক জোট হয়ে নরপশুদের কেটে ফেল কালো হাত।
একটা কথা শুনে রেখো, আমরা দেখবো এবার শেষ,
দেখেছো মোদের সংযম, কিন্তু দেখবে এবার দ্বেষ।
মাথা হবে খান খান, টানবো দড়ি পড়বে রাজা।
প্রমাণ মোরা করবোই, তুলবো জয়ের ধ্বজা।
আমরা নারী, আমরাই পারি গড়তে সফলতা…
আমরা লড়েই জয় করবো আমাদের স্বাধীনতা।।
আমি দ্রৌপদী
মলয়া গুহ বিশ্বাস
আমার জন্ম হয়েছিল কুরু বংশ ধ্বংস করার জন্য।
সজ্ঞাহুতিতে আমার জন্ম, তবুও আমি বিবস্ত্র হয়েছিলাম:
যারা আমায় ছুয়েছিল, আমার কারণে নির্বংশ হয়েছিল,
তৈরী হযেছিল মহাভারত।
সেদিন ও কিনতু রথী মহারথী মাথা নিচু করে ছিলেন।
টু শব্দ করেননি।
আমি সীতা, ধৈর্যর প্রতীক বলে চিহ্নিত তোমাদের শাস্ত্রে।
আমাকে হরণ করার অপরাধে ধ্বংস হয়েছিল বীর প্রতাপরাক্ষস রাজ।
সময় চলে যায়, যুগ পাল্টায় পাল্টায় না শুধুমাত্র অসুর শক্তি।
যে আমাকে নষ্ট করে তাকেই আমি লালন করি,
বিনিদ্র হয়ে মাতৃসুধায় তাকে ভরিয়ে তুলি।
আমাদের শরীর নিয়ে খেলা এবার বন্ধ করো।
তাকিয়ে দেখ ঐ শরীর আর তোমার মায়ের শরীরের কোনো তফাত নেই।
মোমবাতি নয় এবার জ্বলবে বারুদ।
