দ্বিতীয় বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা ✦ গদ্য
উৎসব
ঋত্বিকা দাস
দুর্গা পুজো যদি কেবলমাত্র দেবীমূর্তির আরাধনায় সীমিত থাকত, তাহলে এত লেখা, এত গান, এত শব্দ খরচ হয়তো হত না। তবে দেশ, বিদেশ, গ্রাম, শহর নির্বিশেষে আপামর বাঙালি কে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছে আবেগ। আর এই আবেগের এক বিশাল কেন্দ্রস্থল হল দুর্গোৎসব।
আমরা বাঙালিরা কিছুই ফেলে দিতে পারি না। তাই লাখ টাকার বড়ো ব্যানারের পুজোর পাশে স্বমহিমায় টিকে রয়েছে ঘরোয়া পাড়ার পুজো, নিমকি, মিষ্টি, কচিকাঁচার ক্যাপ ফাটিয়ে নাচ-গান-হুল্লোড়। আর রয়েছে সকাল থেকে কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে হয়ে কুমার শানু। চণ্ডীপাঠ ও মহিষাসুরমর্দিনীর মতো এইসব গানও দুর্গোৎসবের অঙ্গ। পাড়ায় পুজো হবে আর কিশোর কুমার ও কুমার শানুর গান বাজবে না? সে তো ভাবাই যায় না। এত এলাহী ভোজের পর প্যান্ডেলে বিরাজমান দেবীর ও বোধ করি একটু লতা মঙ্গেশকর বা মান্না দের কন্ঠ না শুনলে কেমন খালি খালি লাগে। হাজার হোক তিনিও তো কটা দিন ছুটি উপভোগ করতে এসেছেন এতদূর।
বিশ্বায়নের মাঝেও এইভাবেই টিকে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের ঐতিহ্য, পুরনো ও নতুন কে একসাথে নিয়ে চলার সংস্কৃতি, আমাদের ঘরে ফেরার আনন্দ, পূজাবার্শিকী , পূ্জোর ছুটি, পারার ফাংশন আর পুজোর উপহার।
এই ভাঙাচোরা রোজনামচা মধ্যবিত্ত জীবনে এইটুকুই আমাদের উৎসব। কটা দিন চারিপাশের পৃথিবী টাকে হলদেটে ঝিলমিলে আলোর সেলোফেনের আবরণের মধ্যে দিয়ে দেখতে কার না ভালো লাগে!
আলোকচিত্রঃ ঋত্বিকা দাস
শহরের দখল নেবে এলিয়েনের দল
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
আশির শেষভাগ কিংবা নব্বইয়ের শুরু-র পাড়া, ওই তো আমি, নবাব, পাপু, জয়, পাপাই …সামার ভ্যাকেশনের কিংবা মাধ্যমিক-পরবর্তী সন্ধেতে বসে রকে আড্ডা দিচ্ছি , বিশ্বায়নের ঢেউ ইন্ডিয়ান ওশ্যানের তীরে এসে ধাক্কা দেব দেব করছে, আমরা বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার দ্বিতীয় গোলটা দেখে ফেলেছি, “কেয়ামত সে কেয়ামত তক “-এ দেখেছি ‘আমির খান’ নামক এক রাজপুত্রকে, পাশের পাড়ার কেয়াদি-কে দেখে তারপর থেকে মনে হয় জুহি চাওলা ; “ম্যায়নে পেয়ার কিয়া”-তে ‘সলমন খান’ নামের এক স্বপ্নালু চোখের হিরোকে দেখে তার মত চুল করার চেষ্টায় আয়নার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, “আশিকি” নামক এক সিনেমার গান কুমার শানুর মুখে রাতদিন শুনতে শুনতে, রাহুল রয়ের পর্দা-চুল নিজেদের কপালের ওপর থেকেই সরিয়ে নিয়েছি বারবার। প্রথম সিগারেট খেয়ে পেয়ারাপাতা চিবিয়েছি জোরে জোরে, সরস্বতী পুজোর দিন প্রথম ‘জিন’ নামের কোনো অত্যাশ্চর্য পানীয় চেখে বাড়ি ফিরে ক্যালানি খেয়েছি , অষ্টমীর প্যান্ডেলে প্রেমে পড়বো পড়বো করতে করতেও পিছিয়ে গিয়েছি এই জেনে যে মেয়েটি বম্বেতে থাকে, পুজোয় মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ইনকাম নেই, পকেট মানি কিঞ্চিৎ আছে যা দিয়ে আর চলছেনা, গলি ক্রিকেটে ইমরান খানের রান-আপ নকল করে ছুটে আসা আছে, ‘শচীন তেন্ডুলকার’ নামের এক বিস্ময়-বালকের আবির্ভাব ঘটেছে ময়দানে যে ষোলো বছর বয়সেই আব্দুল কাদিরকে তুলোধনা করতে পারে। সাউথ সিটি নেই, গ্লোব আছে, গ্লোবে শ্যারন স্টোনের সোনালী চুলে খেলে বেড়ানো ‘বেসিক ইনস্টিংক্ট’ আছে, সিনেমা দেখতে গিয়ে হলে ছবি শুরুর আগে, স্ক্রিনজুড়ে ওঠানামা করতে করতে স্লো-মোশনে “সঙ্গম বিউটি পাৰ্লার” থেকে ছুটে আসা সমুদ্রযুবতী আছে ; ও.এ.টি.-তে ‘এল.আর. বি.’ আর ‘শিভা’ আছে, হঠাৎ চায়ের কাপে ‘তোমাকে চাই’ আছে , বিবেকানন্দ পার্কের আড্ডা আছে ; কথা দিয়ে কথা রাখা আছে, মোবাইল ফোন নেই; ব্যালকনি থেকে ছুঁড়ে দেওয়া চিঠি ও ফ্লাইং কিস আছে, ই-মেইল নেই। পাড়া আছে, এপার্টমেন্ট নেই। রোম্যান্স আছে চিরভাসমান হাল্কা মেঘের মত।
একটা কলকাতা ছিল, এখন নেই …
বন্ধ ঘরে টেলিফোন বেজে চলেছে একটানা, কেউ তুলছেনা, কেঁপে উঠছে দেয়াল, নড়ে উঠছে জানলা, আচমকা রিসিভার তুলে নেয় হাওয়া – “হ্যালো, কে বলছেন ? না, ওই নামে এখানে কেউ থাকেনা, রং নাম্বার ….” ; অপর দিক থেকে বলে ওঠে কেউ – “এটা ২৪৬৬….তো ? এখানেই তো …এখানেই তো রোদছায়া থাকে , এখানেই তো ছিল মেঘমন … বাড়ি ভেঙে নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট এ পাড়ায় , ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে থাকে উৎসুক লং স্কার্ট আর আদুরে ল্যাব্রাডর, এ সময় অশত্থ গাছ , ভাঙা স্কুটারের হেডলাইট আর বন্ধ কিচেন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় ? বন্ধ ঘরে ছায়াজন্ম , কার্নিশে খেয়ালি প্রত্ন- বেড়াল ফোনের শব্দে লেজ নাড়িয়ে চমকে ওঠে, ফোন বেজে চলেছে একটানা, ভাঙা আয়নায় তরঙ্গ ওঠে , আচমকা রিসিভার তুলে নেয় হাওয়া – ” হ্যালো , কে বলছেন ? ওই নামে এখন আর এখানে কেউ থাকেনা, একদিন ছিল, আর ফোন করবেননা দয়া করে …” ; অপর দিক থেকে বলে ওঠে কেউ – ” সেই সেদিন খুব কালবৈশাখী, মনে পড়ে ? বিদ্যুতে বিদ্যুৎ, গুলমোহর গাছেদের আন্দোলন, ছাদের উপকথা ….মনে পড়ে ?” ; বাড়ি ভেঙে নতুন ক্যাপসুল লিফট, টেরেস গার্ডেন এ পাড়ায় এখন, এ সময় গুম হওয়া সম্পর্কের দলিল নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় ? টেলিফোন বাজে একটানা, দেয়ালের পোস্টারে হেসে ওঠে ধুলোপড়া গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। সেই কবে কারা এসেছিল মার্চ মাসে, সেই কবে কারা চলে গিয়েছিল কোনো অক্টোবরে, চকচকে ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়া লং স্কার্ট সেসব জানেনা, হাওয়ার রেকর্ডেড ভয়েস বলে ওঠে – ” ওই নামে এখানে কেউ থাকেনা …”, ন্যাপথলিন খেয়ে মরে যায় ভুতুড়ে আলমারি ..
সব চোখ নিয়নতাড়িত, সব চোখ নির্বিকার, ঢেউবিহীন জলাশয়, কোনো চোখে “সেদিন চৈত্রমাস” নেই, সর্বনাশ নেই। চেনা রাস্তায় হেঁটে যাওয়া অচেনা লোকের মত , বাড়ি-ঘর – গাছ -বারান্দা – ইস্ত্রিওয়ালা- গাড়ি মেকানিক- এইচ.ডি.এফ. সি. ব্যাংকের নিরিবিলি ব্রাঞ্চ -চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নেপালি কুক – কেউ আর চিনতে পারেনা, আমিও আর চিনতে পারিনা কাউকে। বহ্নিশিখা ভার্গবের বাড়ির একতলায় ছোটখাট আর্ট গ্যালারি এখন , গাড়িবারান্দা উবে গেছে , চোরকাঁটা বিঁধে গেছে পিয়ানোআঙুলে। স্মার্টফোনে ভেসে আসে স্মার্ট এস.এম.এস. – ” মনের মত বন্ধু /বান্ধবী পান , যোগাযোগ এই নম্বরে, বোল্ড রিলেশন …” , এভাবেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গেছে প্রেম, স্লিভলেস চৈত্র-সেলের দিনে সব চোখ পাথরের, সব চোখ স্মৃতিহীন হিপহপ গান, কোনো চোখে শালবন নেই, দূরের উইন্ডমিল নেই। হৃদয় নেই, হার্ট রয়ে গেছে এখনো।
‘মিউজিকওয়ার্ল্ড’ নেই, তবু ‘মিউজিকওয়ার্ল্ড’-এর সামনে দেখা হল কেন ?
স্মৃতির শহর কলকাতায় প্রচুর অদ্ভুত নামের গলি আর রাস্তা – “লাভলক স্ট্রিট / প্লেস” শুনলেই মনে হয় এখানে ল্যাম্প-পোস্টের ম্লান আলোয় কারা যেন ‘লিপ-লক’ করতে করতে নিজেদের ‘লাভ’-টাকে “এবার লক কিয়া যায়” নাকি ভাবছে ; “ম্যাঙ্গো লেন” -এ যেন গরমকালে ঝরে পড়ছে হাজার হাজার হিমসাগর আম, আর সকলে সেই আম কুড়িয়ে নেবার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে ; “ছকু খানসামা লেন”-এ যেন জুনের নির্জন দুপুরে নষ্ট বাবু খানসামাকে ডেকে বলছেন – ” যা, তোর আজ ছুটি …”, বলে বাড়ি ফাঁকা করে ফেলছেন গোপন কোনো ছক করবেন বলে ; “গুলু ওস্তাগর লেন” বা “দর্জিপাড়া”-র ভুলভুলাইয়া গলিতে হাজার বছর ছায়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এই বুঝি কোণের হলুদ বাড়ির ছাদ থেকে হাত নেড়ে উঠবেন গুলুবাবু -” কী যে আপনারা রেমন্ডস থেকে স্যুট কেনেন, আমার কাছে আসুন স্যার, এখনো সেরা স্যুট আমিই বানাতে পারি …”
দক্ষিণ,মধ্য পেরিয়ে একবার উত্তর কলকাতার দিকে যাবো, ধীর পায়ে। আসলে , “উত্তর কলকাতা” কোনো জায়গা নয়, এক বোধের নাম। এই যে মায়াবী , মেঘলা দিনে আপনি নেমে পড়লেন শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে , আর তারপর জয়পুরিয়া কলেজ পেরিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন শোভাবাজার সিংহদুয়ারের দিকে , এটা একটা কবিতা – ধুলোপড়া ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে যেন হেঁটে গেল হারানো সময়। শ্যামপুকুর স্ট্রিটের আলস্যঘেরা পার্ক পেরিয়ে এক একটা দিন যে কোথায় ভেসে যায়, কেউ জানেনা ; এক অন্য কলকাতা যখন ছুটে চলেছে কার্ল লুইসের মত, তখন শোভাবাজার রাজবাড়ি, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের পাশে “বিপজ্জনক বাড়ি” তকমাধারী দুঃখী এক প্রাচীন হাওয়ামহল , বাগবাজার ঘাটের কাছে রংচটা, হলুদ দেয়াল তখন স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে ভেসে আছে আবহমান। বৌবাজারের ভীম নাগের মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা আলোছায়া সময়, ঝাপসা ট্রামে চড়ে ঢিমেতালে এগিয়ে চলে সামনের দিকে , উঠে যাওয়া সিনেমাহল, বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলা মদের ঠেক পেরিয়ে একটা ট্রাম ঢুকে পড়ে সত্তর দশকের কলেজ স্ট্রিটে , কফিহাউসের টেবিলে টেবিলে তখন নতুন দিনের স্বপ্ন, বিনয় লিখে চলেছেন “গায়ত্রী, ফিরে এস, চাকার মত ফেরো …”, কমলকুমার মজুমদার ট্রাম থেকে নেমে পড়ে তড়িঘড়ি হেঁটে চলেছেন খালাসিটোলার দিকে , আর প্রেসিডেন্সির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে ঘনঘন হাতঘড়ি দেখছে কাব্য-প্রিয় প্রেমিক। উত্তর কলকাতার অলি-গলি-পাকস্থলীর ভেতরেই তো রয়েছে এ শহরের গোপন রোম্যান্স , গুলু ওস্তাগর লেনের দোতলার বারান্দা থেকে ভেসে আছে বেথুন কলেজের দু-বিনুনী মেয়েটির চোখ, মনে হয় , কথা কিছু বাকি রয়ে গেছে , এই গলিতেই তো গুলি লেগেছিল সত্তর দশকের পিঠে, আর তৃণাদিকে জোর করে চুমু খেয়েছিল বে -পাড়ার ছেলে। যে কলকাতা শপিং মল, বারিস্তা আর রংচঙে বহুতলের কলকাতা , যে কলকাতায় সকালের ভালোবাসা সন্ধের মিথ্যে নিয়ন হয়ে যায় , যে কলকাতায় কেউ বলেছিল” দেখা হবে “কিন্তু আর দেখা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন , সেই কলকাতা , উত্তর কলকাতা নয়। উত্তর মানে এক স্মৃতির শহর, বিশ্বায়নের হাঙরের হাঁ-মুখের সামনে দাঁড়ানো শেষ প্রতিবাদ, হানি সিংয়ের বিপরীতে গিরিশ ঘোষ , ফাঁকা ফ্ল্যাটের যৌনতার বিরুদ্ধে ভেসে থাকা অপাপবিদ্ধ প্রেমিক-চিলেকোঠা, গ্লাস ক্যাপসুল লিফটের উড়ালের বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আহিরিটোলার গুলতানি-চাতাল, হিপ হপ গানের ডিস্কোপ্রিয়তার অপোজিটে বরানগরে ভাস্কর চক্রবর্তীর দেড়তলার ঘর, আইফোন এক্সের উল্টোদিকে শান্ত দাঁড়িয়ে থাকা লিটল ম্যাগাজিন।
আসলে, যা বলেছি আগে, উত্তর কলকাতা কোনো জায়গা বা ভৌগোলিক অবস্থান নয়, উত্তর কলকাতা একটা বোধ, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলা এক স্মৃতিপথ, সমস্ত ভাঙনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা দুঃখিত প্রতিবাদ, বিশ্বায়নের বিপরীতে কলার তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বলিভিয়া, বহুতল হয়ে যাওয়া শহরের পেটের নীচে চাপা পড়া সম্পর্কের দলিল। দক্ষিণ কলকাতার কিছু কিছু জায়গার মধ্যেও তাই রয়ে যায় উত্তর কলকাতার চিঠি – দক্ষিণের কালীঘাট, ভবানীপুর অঞ্চলের অলি-গলির মধ্যে, শ্যাওলা-পাঁচিলের আঁকিবুঁকির মধ্যে , লোকাল কমিটির বন্ধ অফিসঘরের দেয়ালে , প্রাচীন শরিকি বাড়ির কার্নিশে, স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া পোষা হুলোবেড়ালের চোখে, সরস্বতী পুজোর চাঁদায়, সদানন্দ রোডের ছাদ থেকে উড়িয়ে দেওয়া পেটকাটি ঘুড়িতে, চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনির পোস্টার-হাসিতে, “মা লক্ষ্মী জুয়েলার্স”-এর ঘুপচি ঘরে, “গ্র্যান্ড সেলুন”-এর ধুলোপড়া আয়নায়, বাবার যুবক মোটরসাইকেল আর মায়ের যুবতী ধনেখালি শাড়ির আঁচলে – তাই চিরকাল রয়ে যায় উত্তর কলকাতার পদছাপ। যা কিছু পুরোনো, যা কিছু হারাতে চায়নি কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে , যা কিছু চোখের কোণে মুক্তো আর মনের কোণে নীল রং , সবই আমাদের উত্তর কলকাতা, আমাদের দক্ষিণ কলকাতা, আমাদের কালীঘাট, আমাদের ভবানীপুর, আমাদের প্রতাপাদিত্য রোড, আমাদের গিরিশ পার্ক, আমাদের গুলু ওস্তাগর লেন।
গুলু ওস্তাগর লেন, মোহনবাগান লেন, হাতিবাগান, আহিরীটোলায় ঘুরপাক খেয়ে মরছি, হাতড়ে বেড়াচ্ছি স্মৃতিমুখ, খুঁজে বেড়াচ্ছি বসন্তে হারিয়ে ফেলা প্রেমের গন্ধ , আর সন্ধে নেমে আসছে শহরের মাথার ওপর, ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে ল্যাম্পপোস্ট, উত্তর কলকাতাবিহীন একটা কলকাতা আঙুল তুলে বলে উঠছে -” এই কে তুমি …কোথা থেকে এসেছো, কোথায় যাবে ? এখানে তোমার কোনো জায়গা নেই, এ শহরে কোনো পুরোনো মোটিফ নেই, নতুন মোটিভ আছে, খাপ খাওয়াতে পারলে থাকো নইলে চলে যাও যেখানে যাবার …”
মনে হয়, কেউ ছিল পাশে একদিন, হেঁটেছিল পাশাপাশি কয়েকটা বছর, তারপর চলে গেছে কালের নিয়মে, ম্যাজিশিয়ানের আশ্চর্য ইশারায়। চলে গেছে বহুদূরে , আর দেখা হবেনা কখনো, ছেড়েছে শহর, দেশ, সমস্ত সীমানা, অথচ একদিন ছিল, কাছে ছিল এতটাই , তার নিঃশ্বাস এখনো চোখের ওপর এসে পড়ে , আর চমকে উঠি হাজার মানুষের ভিড়ে। খুব শীত করে ওঠে, এই বাতাসে ভেসে আসা শীতলতা, এই কেঁপে উঠে সিগারেট ধরানো, শহরের ক্যানভাসে এই ছবি খুঁজে চলা – এই অমোঘ, অনিবার্য দূরত্ব অন্তরীণ করে নেবার নামই “উত্তর কলকতা ” ….পুরোনো দালান, গাড়িবারান্দা, তেতলার গাছঘেঁষা ঘর, জানলায় ভেসে থাকা হারানো মানুষের মুখ – সবকিছু ভেঙে ভেঙে আমাদের শরীর ও মন স্কোয়্যার ফুটে মাপা হবে একদিন, একদিন রংচটা লেটারবক্স থেকে সময়ের রাস্তায় উপচে পড়বে ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের চিঠি, সেদিন আর কোনো উত্তর কলকাতা থাকবেনা, কোনো কান্না থাকবেনা , সবকিছু চকচকে, রঙীন হয়ে যাবে, শপিং মলের হাঁ-মুখের ভেতরে ঢুকে পড়বে হাসিখুশি জোকার। নিমতলা ঘাটের গাঁজার ধোঁয়ায় ভেসে উঠবে পূর্বজন্ম, জোড়াসাঁকো থেকে ছুটতে শুরু করবে মেহের আলি, “সব ঝুট হ্যায় …” বলতে বলতে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়, ভিন গ্রহ থেকে নেমে এসে শহরের দখল নেবে এলিয়েনের দল …
মৃত্যুর সঙ্গে একটা বিকেল
দেবার্ঘ্য দাস
ভেবেছিলাম রোদে পুড়তে পারে, আঁচে বা শ্রাবণে মেঘেদের উপস্থিতি আরামদায়ক বটে। নিয়ে যেতে এসেছ বলেই কি আমায় ধরা দিতে হবে? মাতাল বনে গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়ে আছো আমার জন্য তার মধ্যে কতকটা নিষ্পাপ ক্রুরতা লুকিয়ে আছে তা কেউ জানে না!
হেমন্তের প্রান্তে সেই বাগিচায় মোরাম পথে রাত্রি নেমেছে।
“কত ভাগ্যের ফলে না জানি
পেয়েছ এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় তরী
সুধারায় যেন ভরা না ডোবে।।…”
এরপরেও আমায় নিয়ে যেতে চাও? গহ্বরে তলিয়ে গেছে আলো, হারিয়ে গিয়েছে বিশেষ সংবাদ। সেখানে ধানের ক্ষেতে গোলাপ ফুলের খবর পাওয়া যায়। পাঠাশালার জমি গেছে চাল সারাতে। সামনের মশুমে বৃষ্টি নামলে ধারাপাতের টুংটাং বন্ধ।
বন্ধ সমবেত কলরব। হে প্রিয়, তুমি তো রয়ে গেছ এই শুকিয়ে যাওয়া স্রোতে, ব্যালাড ভিজে দুপুরের গান হয়ে বারবার ডেকে নিচ্ছ কেন? যে চারাদের কাল ফুল হয়্যে ওঠার কথা ছিল, বৃষ্টির নরমে সেখানে কোমলগান্ধার। মনে পড়ে রবি ঠাকুর তখনই –
“শিমুল কাঠই হোক
আর বকুল কাঠই হোক
আগুনের চেহারাটা একই।।”
ছিমছিমে হাওয়ায় মাখানো শহরের পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্যারম রঙের সন্ধ্যে। পাশ দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে সোহাগি সফর। নয়নাভিরাম বলতে যা বোঝায় সেই মৃত্যুর নকশাও লেপ্টে আছে ফিরদৌসের শরীরে। মার্কেজের রফিক লেনের বাড়ি বা আমার ছেলেবেলা সবটাই রয়ে গেছে উঠোনতলায়। সেখানে আজও টিকে আছে দু-একটা ইঁট যার গায়ে গন্ধ লেগে আছে; আমি স্মৃতি নামে ডাকি। সেই স্মৃতি মৃত্যু নামে হাতছানি দেয়। জানান দিচ্ছে প্রতিটা দেয়াল-লিখন, পরম্পরা রাস্তা পেরিয়ে দেখে নিচ্ছে পুরনো চাল আজ আর বাড়ছে কিনা?
তাহলে ওই কথাই রইলো – মৃত্যু তোমার কথাই পড়ছি এখন।
কাল যে পথ মেখেছিল চোখে, ইতস্তত
সন্ধ্যের গন্ধ জড়িয়ে উড়তে থাকা মৌমাছি ভেঙে দিয়েছে নীরবতা
কতদূর হেঁটে যাওয়া যাবে?
কত পথ আলো হয়ে ফুটবে সময়ের শেষে।
শহরতলি আর কাছে সরে আসা মেঘে মেঘে ব্যাকুলতা
অন্য প্রান্তে বৃষ্টি নেমেছে আড়ালে
তোমাকে দেখব বলেই নাটকের মহড়ার ছল
তারা জ্বলে উঠে মুখের আদল দিয়ে যায়
ঘুম নামে এলিয়ে যাওয়া চোখে
বাকি ভালবাসা জানান দিতে চায়!
যে করিডোরে মেঘলা খেলা করে
বিষন্নতায় দোলাচল হাস্নুয়ানা;
হিসেব গরজ একটু প্রশ্রয়
নাহয় বিকেলে এইটুকু স্পর্শ থাক।