চতুর্থ বর্ষ-প্রথম সংখ্যা-গদ্য
আমার ঋত্বিক
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
১.
আজ ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মদিন।
সুরমা ঘটক, তাঁর স্ত্রী, আমি তাঁকে দিদা ডাকতাম। তাঁর সাথে গত ১০ বছর অনেক সময় কেটেছে। ঋত্বিকের কালচারাল ফ্রন্ট আমায় উপহার দিয়েছেন তিনি। আমি চোখের সামনে দেখেছি এই পরিবারটাকে শেষ হয়ে যেতে। আমায় বলতেন, ” সবুজ। জীবন্ত।” বড় সব কিছু মনে পড়ছে আজ। দিদা আমায় ঋত্বিকের
সাথে প্রেম, শিলং এর গল্প বলতেন। বলতেন, শিলং এ রবি ঠাকুরের কথা। বলতেন, দ্যাখ তো বাবা আমার লেখাগুলো যদি প্রকাশ করা যায়। আমি তাঁকে বলতাম আমার সময়ের গল্প। বলতাম জানো, এই ফোনে এখন ছবি বানানো যায়। অবাক হয়ে শুনতেন। কিন্তু বুঝতেন। আমার হাত ধরে অন্য ঘরে যেতেন। বলতেন, জানিস আমার কত প্রেমিক ছিল! কিন্তু তোর দাদু ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। তাই ওকেই বিয়ে করেছি। বিভূতিভূষণকে চিঠি লিখতাম প্রেমের। সুভাষ বোস রেডিও-তে বার্তা দিতেন । তোর দাদুকে বিয়ে করব, বাড়িতে বলছে, ছেলে কি করে? তোর দাদুর জবাব, “কি করে মানে? বলবে, সংস্কৃতি আন্দোলনের কাজ করেন”
দিদার কাছে ঋত্বিক জীবন্ত ছিলেন। বলতেন, ওঁকে দলের লোকেরা পলিটিক্স করে বের করে দিয়েছিল। পি সি যোশি শুধু পাশে দাঁড়ান। ৪৭ এ জেল খাটার গল্প বলতেন আন্ডারগ্রাউণ্ডে। বলতেন, ঋত্বিকের সেই খারাপ সময়েও দিদাকে দাস ক্যাপিটাল বলে ডাকার মজা। ম্যান মেকস হিমসেল্ফ পড়তে দেওয়া। কত কি মনে পড়ছে…ঋত্বিকের বইয়ের আলমারিটা ছিল ওই বাড়ির মূল আকর্ষণ..এরিক নিউম্যানের ‘গ্রেট মাদার’ বইটিতে ঋত্বিকের নোট নেওয়া চোখে পড়ত..ওঁর আইজেন্সটাইন, নাগার্জুনের সংগ্রহ আমায় বিস্মিত করত…পুনের ক্যম্পাসে কাজের সুবাদে গিয়ে চে গেভারার পাশে ঋত্বিকের গ্রাফিতিটা দেখে প্রবল গর্ব হয়েছিল বাঙালি হিসেবে এ শহরের জন্য আজ স্বীকার করলাম…
২.
নীতা কি চেয়েছিলেন?
একটা ঘর। সংসার। জীবন।
যখন তাঁর দাদা শিলং-র মানসিক হাসপাতালে গিয়েও জানায়, বাড়ির সবাই খুব আনন্দে আছে, বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে সবার, হইচই, নীতা কথা থামিয়েই চিৎকার করে
দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম…
ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি প্যান করে ঘুরতে থাকে। আসমুদ্র হিমাচল একাকার হয়ে যায় সে চিৎকার। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ভেঙে তছনছ করে। ছিটকে এসে রক্ত লাগে সমগ্র পুরুষতন্ত্রের সাদা পাঞ্জাবিতে। রবি ঠাকুর নীতাকে নিয়ে গান লিখলে লিখতেন, সকল গৃহ হারালো যার…। ঋত্বিক গ্রেট শিল্পীদের মতোই বড় নিষ্ঠুর। যেমন রবি ঠাকুরও। কিন্তু তারা কি জানতেন, আর তিন দশকের মধ্যে মেয়েদের ভূমিকার এমন বদল ঘটবে? সমাজের ভারসাম্যই যার জন্য যাবে বদলে?
আমার প্রজন্মেই ব্যপক হারে মেয়েরা সিঙ্গল ওমানহুড চাইল। পাশ্চাত্যে অনেক আগেই এই মোটিফ দেখা গিয়েছিল। আমাদের এখানেও ছিল। কিন্তু এত ব্যপক হারে হয়তো না। মেয়েরা আর “সংসার” চাইল না। কলেজ পাশ করার পর, তারা অনিশ্চিত কোনও একটা কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লিভ-ইন করে নিল। দেখল, এ আসলে সংসারেরই ব্যপার। নতুন বোতলে পুরোনো মদ। তাঁকেই চাকরি থেকে ফিরে রান্না করতে হচ্ছে। তো, সেই মেয়ে বেরিয়েও এলো। কলকাতা মা-বাবা”র কাছেই ফিরে, কুকুর/বেড়াল পুষে, কম্পুটারে কাজে ঢুকে গেল। মাঝেসাজে এদিক ওদিক ফ্লার্ট করে নিল। যেমন পুরুষরাও করে।
জোর দিয়ে বলব, ব্যপক হারে আমার প্রজন্মে এই মোটিফ দেখা গেল মেয়েদের মধ্যে। আমাদের আগের প্রজন্মের লেখায় এই মোটিফ আসেনি। সন্দীপন খুব কাছে গেছেন। কিন্তু না, এই চিহ্ন নেই। ধরার সুযোগ পাননি। নবারুণ অন্য ভাবে ধরেছেন, “বেবি কে” জাতীয় লেখায়। আপনি বলবেন, মেয়েরা ফেমিনিটি হারালে তো ঘর ও বংশ ও রাষ্ট্র টলে যাবে। আমি একমত হব না। এটা ঠিকই ফেমিনাজিরা বদলা নিতে চায়। কারণ যুগ যুগ ধরে পুরুষ তাদের পুজো করেছে আর রড ঢুকিয়েছে। কিন্তু এমন অনেক মধ্যবিত্ত পড়ালেখা জানা নারী আগের প্রজন্মের আমি দেখেছি, যাদের স্পেস চাইতে আদালত বা ফেসবুকে আসতে হয়নি। তারা সংসার সামলেই নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছেন। আর সে সংসারে কোনো এক্সপ্ল্যয়েটেশন নেই। আমার চারপাশে যে বন্ধুরা বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কে আছেন, এমন ভাবেই আছেন। আমি তাদের মধ্যে আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ দেখতে পাই। দেখি, আজকের নীতাদের..দেখি সত্যজিতের মহানগরের মাধবী মুখোপাধ্যায়দের..যারা নিজেদের হক বুঝে নিতে জানেন..
৩.
মানুষ মারা যাওয়ার আগে কিছু কথা বলে যায়। প্রেমিকা ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন কিছু কথা বলে।
এ সব কথার ওজন খুব বেশি। সবার নয় এ সব কথা। বৌদ্ধরা তাই ভাইব্রেশন বুঝে, যার বুকে বুদ্ধ আছে, তাকেই বলে যান এ সব..কেউ তাঁর বই দিয়ে যান লাইব্রেরিতে। কেউ ফ্ল্যাট দিয়ে যান মিশনকে। কেউ অস্ত্র দিয়ে যান লড়াইয়ের। কবীরের গানে, কোনও সন্তানহারা মা জোড়া মুনিয়ার খাঁচা খুলে দেন..
সুরমা ঘটক যেমন বলতেন, ঋত্বিককে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে! সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, নীতাকে লো এঙ্গেলে যে রাতে মোর গানে যেভাবে দেখেন ঋত্বিক
তা বুর্জোয়াদের এতাবৎকালের সব দেখা ভেঙে দেয়। আমি দেখলাম, ওই মুহূর্তে বেঁচে উঠলেন ঋত্বিক। বেজে উঠলেন। ঋত্বিক যুক্তি-তক্কো”র শেষে যখন বললেন, কিছু একটা করতে হবে তো…মানিকবাবুর মদন তাঁতি মনে কর..সেটা তাঁর অন্তিম উচ্চারণ। সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরলো তাতে..
প্রতুল মুখোপাধ্যায়র গান নিয়ে একটা বড় ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাতে উনি বলেছিলেন, মা মারা যাওয়ার আগে যেভাবে ওঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মনে হচ্ছিল, সমস্ত প্রাণ ঠিকরে বেরতে চাইছে। ঢুকে আসছে শরীরে। ট্রান্সমাইগ্রেট করতে চাইছে। যেমন পুশকিনের আত্মা ডস্টভয়স্কির শরীরে ও পরে কালভিনোর শরীরে ঢুকে যায়..প্রবাদে..আমি মানুষকে মারা যাওয়ার মুহূর্তে দেখেছি। আপনারা দেখেছেন? দেখেছি পায়খানা করে ফেলছে মানুষ। বা মদ ঢেলে দিচ্ছে স্ক্রিনে। বা, দেবদূতের মতো পরীর হাতে বিলিয়ে দিচ্ছে আত্মা। নীল চোখ নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ছে কফিনে। গুরুস্থানীয় কিছু মানুষ আমায় কিছু কথা বলে গেছেন। যা, আমি এ জীবনে কাউকে বলতে পারব না।চেষ্টা করব, সে কথার সম্ভ্রম রাখতে, কাজে। মাঝে মাঝে, মারা যাওয়ার কথা ভাববেন। দেখেবন মনে হবে, সমুদ্রের সামনে বসে আছেন। বুনুয়েল যেমন ডাইরিতে রীতিমত ফ্যান্টাসি করে ফেলেছিলেন কীভাবে মারা যাবেন তা নিয়ে। বাথরুমে না দেবালয়ে। প্রেমিকাদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোর কথাও ভেবে গেলেন পরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আগে।
ট্রেন যদি জীবন হয়, কাশবন পেরিয়ে অপু কিন্তু তা দেখতে পেল, দুর্গা পেল না। পা মচকে পড়ে গেল। নারীবাদী ব্যখ্যায় রুশতী সেন এমনটাই লিখেছিলেন। বা, অপর্ণা”র মারা যাওয়ার খবরে থাপ্পর মারে অপু। মুখ বেঁকে যায়। নীতাকেই আত্মত্যাগ করতে হল। শেষ সিনে আরেক নীতাকে আমরা আবার দেখলাম কলেজ যেতে একই ছবিতে। মাও বলেন, কারও মারা যাওয়া পাহাড়ের মত ব্যাপক আর কারো পালকের চেয়েও হালকা। মানুষ মারা যায় ঠিকই। মানব থেকে যায়। আর তাকে অগ্রজের কাজের ভারও শোধ করতে হয়, এক জীবনেই। চুল্লিতে হাত-পা-মাথা-ঘিলু ফেটে যাওয়ার আগে! ততদিন জীবন জীবিতের বিশ্বাস করতেন ঋত্বিক।
৪.
ঋত্বিক ঘটকের গল্প নিয়ে বাংলায় বিশেষ কেউ আলোচনা করেননি। অথচ লোকটা গল্পগ্রন্থে প্রায় ১৮/১৯টি গল্প লিখেছেন। এ ছাড়া লিখেছেন কবিতা-নাটক সহ অজস্র লেখা। কিন্তু আমাদের একটা স্বভাব, একজন কোনও বিশেষ একটা কাজে দক্ষ তাই তাঁর আর অন্য কাজের খোঁজ না রাখা। ঋত্বিকের লেখা নিয়ে সেটাই হয়েছে। বাঙালির অবহেলা। যতটা তাঁর মদ্যপান নিয়ে আলোচনা হয়েছে, লেখা নিয়ে তার সিকিভাগও হয়নি। একমাত্র, বাংলা ভাষায়, তাঁর লেখা নিয়ে জরুরি আলোচনা করেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় আর অবশ্যই নবারুণ ভট্টাচার্য। এ ছাড়া শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। কালচারের হোতারা অবশ্য তাতে বিশেষ কল্কে দেয়নি।
বাঙালির একটা সোভিয়েত ছিল এককালে। ছিল। কারণ, আজ আর তা নেই। ৯১-সালে সেই সোভিয়েত মারা যায়। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা লেখেন, এন্ড অব হিস্ট্রি। নবারুণ বলেন, অনেকেই তাঁর মত আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন এরপর। কিন্তু সে সময়েই হারবার্ট লেখা হয়। আত্মহত্যা করেন হারবার্ট। নবারুণ বেঁচে যান। এবং ঘটনায় নড়ে যায় প্রশাসন ও রাষ্ট্র।
বাঙালির সোভিয়েত ছিল- বলছিলাম। তাই লেনিনগ্রাদে মেঘ করলে দেশপ্রিয় পার্কের লা কাফেতে ঝড়জল হত। সস্তায় রপ্তানি হত ভস্তক-রাদুগার বই। বরিস পলেভয়-গোর্কি-তলস্তয়-পুশকিন থেকে সোলঝিনিৎসিন-পাস্তেরনাক-মায়ারহোল্ড- বুলগাকভ। লেনিন-স্তালিন-আইজেনস্টাইন। মানুষের মত মানুষ-ইস্পাত-মা-দুনিয়া কাঁপানো দশদিন-ফাঁসির মঞ্চ থেকে। বাঙালি সত্তর দশকে তাই কিছুটা ফরাসি এবং অনেকটাই রাশিয়ান হয়ে উঠেছিল। শিল্প-সমাজ-পরিবেশের আকাশে বাতাসে ছিল রাশিয়ার ঘোর। সেই ঘোরাচ্ছনতা সেই রোমান্স থেকেই তাঁরা জীবন দেখতেন। উত্তাল হত কফি হাউস। রাসবেহারী মোড়। মিছিলের মুঠো। রাস্তার গুলির শব্দ। বোমা। যুবকের ভেসে যাওয়া লাশের পাহাড়। বরানগর-কাশীপুর। নকশালবাড়ি। ফ্রান্স-৬৮। আপামর দুনিয়ার ছাত্র প্রতিবাদ। দেওয়াল লেখা। কবিতা-নাটক-মিছিল।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে মণিভূষণ ভট্টাচার্য, কবিতার ধাঁচ দেখলেই বোঝা যায়, এই চলন স্রেফ বাংলার না।এখানে মিশে আছে রাশিয়া। মিশে আছেন মায়াকভস্কি। মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে যিনি কবিতা বলবেন তাঁর কাজে লাগবে এই কবিতা। অনেকটা সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন। সচেতন ভাবেই যেন সোজাসাপ্টা লেখা। সিধে। কাব্য নেই। আছে ম্যানিফেস্টো। সুকান্ত ভট্টাচার্য যার জ্বলন্ত উদাহরণ।
ঋত্বিক ঘটকের গল্প “কমরেড” বা “আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে”-তে একটা সোভিয়েত প্রভাব পাই আমি। তাঁর গদ্যে সোভিয়েত গদ্যের প্রভাব আছে। আছে নিপাট বাংলাও। কিন্তু মতাদর্শ আর গদ্যচলনে আছে সোভিয়েত। আমার মতে। যার সরাসরি প্রভাব আছে নবারুণের গদ্যে। এ নিয়ে কেউ আজও কথা বলেনি। আমার একটা দীর্ঘ লেখা লেখার ইচ্ছে অনেকদিনের। এখানে তার কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করব।
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, দেশভাগের ট্রমা কীভাবে মিশে যাচ্ছে ঋত্বিকের গদ্যের চরিত্রে। মিশে যাচ্ছে মূল্যবোধহীনতা। ভেঙে যাওয়া পরিবার। ভেঙে যাওয়া সমাজ। আশ্রয় খুঁজছেন ঋত্বিক। কালিদাসের মেঘের বর্ণনার মতোই একা তাঁর চরিত্ররা। খুব একা। কার্যত গোপাল হালদার ভূমিকাতেও এই সমাজের ভেঙে যাওয়া আর তার প্রভাবের কথা মোটা দাগে বলছেন।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে নবারুণ বন্ধু হিসেবে কিছু স্মৃতির কথা জানান। ভবানীপুরে তাঁর, বাবা বিজন ভট্টাচার্যর আর আত্মীয় ঋত্বিকের সাথে দারিদ্রময়, মলিন অথচ মেধাবী বেঁচে থাকার সূত্রে। সেখানে নবারুণ বলেন, মা-হীন বালক নবারুণকে ভালোবেসে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন ঋত্বিক। বিদেশী ছবি। ফেরার পথে সে ছবির গল্প গুছিয়ে বলে দিতেন, যাতে বালক নবারুণের বুঝতে অসুবিধে না হয় ছবিটি। একটি ইন্টারভিউতে নবারুণ জানান,
” দ্যা ওয়ে ঋত্বিক গিলছিল পাশে বসে ইভান-স চাইল্ডহুড, আমি বুঝেছিলাম, এর একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। ঋত্বিকের পরের ছবির কাজে তারকভস্কির গভীর ছাপ ছিল।”
এই যে ঋত্বিকের স্টোরি টেলিং, তার প্রমাণ আমরা পাই এ গল্পগুলোয়। এবং অবশ্যই নবারুণের গদ্যে। নবারুণের কবিতাতে তো সোভিয়েত ছাপ স্পষ্ট। গদ্যেও
ঋত্বিকের হাত ধরে স্বরের ভাষায় প্রকট সোভিয়েত স্টোরি টেলিং। অনেকেই ঋত্বিকের বাড়ির বইয়ের আলমারিতে আইজেনস্টাইনের সংকলন দেখেছেন। দেখেছেন কি যত্ন করে ফুটনোট নেওয়া সেখানে। এ ছাড়াও নবারুণের কাছে ঋত্বিকর এরিক নিউম্যানের লেখা গ্রেট মাদার বইটিতেও রয়েছে যত্ন করে ফুটনোট নেওয়া। অর্থাৎ, মন দিয়ে, গভীর অভিনিবেশ দিয়ে তিনি পড়তেন। পড়েছিলেন ইয়ুং যেমন। মাদার কাল্টের সূত্রে। পড়েছিলেন মানিক। মদন তাঁতি। আইজেনস্টাইন।”গিলেছিলেন” ইভান-স চাইল্ডহুড। আর সেগুলির স্টোরি টেলিংর প্রভাব আছে নবারুণের গদ্যে।
আমার কাজ থিওরি খারা করা না। শিল্প ওভাবে হয়ও না। আমি আমার আন্দাজের কথা বললাম। কিছু প্রমাণ দিয়ে। নিদান দিচ্ছি না। কমলকুমারকে ফরাসি সাহিত্য দিয়ে ব্যাখ্যা করে, মিথ বানিয়ে অনেকটাই, বাঙালি অনেক বেওসা করেছে। কারণ তাঁর কোনও উত্তরাধিকার নেই। অথচ হুতোম আছে, আছে শ্রীরামকৃষ্ণ কথাম্রত্র প্রভাব তাঁর গদ্যে। আমি তাই “বিদেশ” দিয়ে কখনওই ব্যাখ্যা করছি না ঋত্বিকের গদ্য। বলছি, একটা প্যাটার্ন যা হয়তো নবারুণের গদ্যের অবচেতনের স্বরে ছিল। কারণ নবারুণ তো শেষ মোহিকান বিজন ও ঋত্বিক ঘরানার।
ইন্টারন্যাশনাল বাজলে বুলেট ফুলেট পরোয়া করব না-বলতেন নবারুণ। সোভিয়েত নস্টালজিয়া থেকে আজীবন তিনি বা তাঁর প্রজন্ম বেরতে পারেননি। হাজার ভুলের কথা জেনেও। যেমন বেরতে পারেননি ঋত্বিকের ও বিজনের প্রভাব থেকে। এবং সন্তানসম আমাদের রক্তে মিশিয়ে দিয়ে গেছেন সে সংক্রমণ। এবং নবারুণ ও ঋত্বিক-দু জনেই আজ সবকিছু ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক, সদর্থে।
৫.
ঋত্বিক ঘটক আজ কমোডিটি। বিক্রি করা যায় ভালো। যেমন কমোডিটি সত্তর, নকশাল। এ শহরের পূর্ণ সিনেমা হলে কোমল গান্ধার পোড়ানো হয়েছে। আর আজ মেঘে ঢাকা তারা-র রিমেক বাজারে পাওয়া যায় সস্তায়। আজ আরেক দেশভাগ-মহামারী-মন্বন্তরের সামনে আমরা। আজ কলকাতা ফেস্টিভ-এলইডি-আইপিল-স্কাইপে। আইপিল আর আইপিএল। পুরো ফ্যাব, ইন্ডিয়া। স্বচ্ছ, ভারত! আজকের খুশিখুশি তন্বীরা জানে না, কেন ঋত্বিকের মুখে রক্ত উঠে আসত! ফ্রেম ভেঙে কেন রাপচার নেমে আসত আর শোনা যেত দোহাই আলি দোহাই আলি! কেন বাংলা ঢেলে দিতে হয় সাদা পাতায়..
সত্যিই বীভৎস মজা! কেচ্ছা-অপমান-খিস্তি-ল্যাং মারামারি-কাঠিবাজি-ফোড়ন কাটা-দাঙ্গা-দুধে সোনা-এম্বুলেন্স আটকানো-গো মূত্র-গোলি মারো। সবাই কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সেলিব্রিটি। জেন-এক্স আর ফ্রি-সেক্স। ফি বিকেলে স্টারবাকসে পেছন দুলিয়ে চলছে দাঙ্গা-দীপিকা-রণবীর-বালুলালু-পিএইচডি-সেপারেশান। কম্বো। আমি-বর-বস-ফেসবুক। ব্যাস। ফ্যাবইন্ডিয়া-মাগিবাজি-ঢ্যামনামো-এঁটোকাটা-মালখাওয়া-পিআর-তানিশক। এলঈডি-মেডিক্লেম-সেভিং একাউন্ট-ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স-বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট আর রাজারহাট নজরুলতীর্থ। স্বস্তির চর্বি গদগদ কি ভীষণ স্তনবতীদের। তরুণ লেখক সম্পাদককে থানার বড়বাবু ভেবে হাত কচলাচ্ছে। কমপ্ল্যান খুকি মিছিল থেকে ফিরে এসি চালিয়ে টেডিবিয়ার জাপ্টে স্পাইডারম্যানকে বলছে, করছ না কেন আমাকে? করো!
‘সব পুড়ছে/ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে/ আমি পুড়ছি।‘ কলকাতা তো এখন একটা চুল্লি। চকচকে চুল্লি। ইতরের দেশ। ধর্ষণ করে সেলফি তোলা হয় রাজারহাটে। ফেসবুকে আত্মহত্যার কথা লিখে সেনসেশান বাড়ানো। ওটুকুই ধক। সম্পাদক বলেছিলেন তাঁর ফ্রেম কাঁপে। সিনেমাগুলি তাই হয়নি। এ জাতি আরও অনেক জিনিয়াসের মতোই তাঁকে উন্মাদ বানায়। অথচ তিনি গ্রামার বানাচ্ছিলেন। স্কিতসফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন ঋত্বিক শেষবেশ।
আসলে, ফ্লপ করেছিল দর্শক তিনি জানতেন ও বলতেন। আজ বি-এফ-আই শট-বাই-শটে ঋত্বিককে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে। বার্গম্যান-তারকভস্কির পাশে নাম হচ্ছে তাঁর। মুখ দিয়ে তাঁর উঠে আসা রক্ত গেঁথে রেখেছেন সুবিমল-দীপক-সন্দীপন-অনন্য-সঞ্জয়-নবারুণ-উদয়ন-মণি-জন’রা। সব তাঁরই তো ছেলেপুলে। চেতলার একরত্তি ঘরে আইজেন্সটাইন সংগ্রহ..ওই ভেঙে যাওয়া ফ্রেম তো রুনু গুহ নিয়গীর নাগাল টপকে মৌলালির অন্ধকার বাড়ি থেকে চারু মজুমদারের উড়ন্ত বাঘের থাবা। উড়ে যাওয়া ব্রিজ। সন্দীপনের থেকে ধার নিলাম শব্দগুলো। মানিকের মদন তাঁতি। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর শ্রমিক হাসপাতাল পরিকল্পনা। সারি সারি গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসা জুলিয়াস ফুচিক, শ্রীঅরবিন্দ, গ্রামশি, সক্রেটিস, চে গেভারা। সুখি-সুখি, খুকু-খুকু, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান পাশবালিশ সাহিত্যের উপর লং-মার্চ, গীতা ও রবীন্দ্রসংগীতের রক্ত। বন্ধ কারখানার সামনে থুথু ও পেচ্ছাপের পাশে বসে শ্রমিকদের সুদিনের গল্প শোনাচ্ছেন ভ্লাদিমির লেনিন। সত্যজিৎ রায় বলছেন, বাংলাদেশকে উনি যেভাবে দেখেছেন তা আমি পারতাম না।
আর, স্বয়ং ঋত্বিক বলছেন, ‘আমৃত্যু আমার জীবনে কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব না। যদি সম্ভব হত, তাহলে অনেক আগেই করতাম। আর ভালো ছেলের মত গুছিয়ে বসতাম। কিন্তু তা হল না। হয়তো হবেও না। তাতে বাঁচতে হয় বাঁচব, নয়তো বাঁচব না। কিন্তু শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে পারব না।’
ছোট এক কাপ
সুপ্রিয় মিত্র
এও এক অদ্ভুত যৌনতা। কোনও পেন পছন্দ হলেই একটা কিছু লিখে দেখতে ইচ্ছে করে। তা সে নতুন পেন হোক বা কারও বুক পকেটের। এই যৌনতা থেকে অমুকও দূরে নয়। কিন্তু পেনটা ছিল অনেকটাই দূরে, বুঝলেন তো।
সাতসকালে চায়ের দোকানে গিয়েছে অমুক, একটু চা খাবে, ওল্ড-নর্মাল চেখে দেখবে। সাতসকাল মানে সাতসকাল। ভোর ছ’টা। অমুক ভেবেছিল ভাইরাস ঘুমিয়ে আছে। মানুষ তার কাশি নিয়ে, উপসর্গ নিয়ে তখনও ততখানি জাগ্রত নয়। ‘একটা চা’ বলতে না বলতেই, পাশ থেকে আওয়াজ এল ‘আমাকেও একটা চা।’
মুখ ফিরিয়ে অমুক দ্যাখে, দেশের বাড়ির লেখক। কিছুদিন বিদেশে কাটিয়ে, কিছুদিন দিনাতিপাত করে নিজভূমে ফিরেছেন। দেশের নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে কিছু স্থিতির আশা পেয়েছেন তিনি। এখন টিকে থাকতে গেলে দেশপ্রেম বোঝানোটা জরুরি। কিন্তু যা হয়, কারও প্রতি প্রেম বোঝাতে গেলে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ খুব জরুরি আজকাল। তাই দিনাতিপাতের ক্লিন্নতা লিখে বেদনার খ্যাতিই দস্তুর। সেই লেখকের পেন ঝাড়লে কেমন কালি পড়ে, জানতে ইচ্ছে করবে না? বুকপকেটে এঁটে তাঁর ঘোরকৃষ্ণ সোনালি ডাঁটিঅলা পেন যেন সাপের জিভ, লকলক করছে।
কিন্তু সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করে, ভাইরাসকে জাগিয়ে কী লাভ মশাই? অগত্যা, কলমকে লতা লতা বলে এড়িয়ে থাকা যাবে না, আপাতত কিছুক্ষণ, অন্তত?
চা ততক্ষণে চলে এসছে। কিন্তু অমুক এই যৌনতাকে অবদমন করতে না পারছে না আর। হাতের কাছে যা পাই, তা-ই ধরি, তা-ই কলম। তা-ই নিঃসরণ। শেষমেশ নিউজপেপারটাকেই মুড়ে পেনের মতো আঁকড়ে লেখার ভান করে যেই না চায়ের টেবিলে ঝুঁকে কাঠের গায়ে ঠেকিয়ে ধরল, হড়হড় করে বমি হয়ে গেল পেপারের সমস্ত শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে পেপার হয়ে গেল সাদা। পরমুহূর্তে স্বয়ং সেই সাদা পাতা তার সমস্ত শব্দ হারিয়ে পুষ্টির অভাবে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল তামাম তর্জনীর শিকড়ে হোঁচট খেয়ে সোজা কাঠের শক্ততম অংশে। ফলে, পেন এখন সাদা পাতা।
এই সাদা পাতা দেখে আরওই উত্তেজনা বাড়ে অমুকের। আরও বেশি করে পেনের অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওদিকে, মোক্ষম সময়ে, লেখকেরও সেই সাদা পাতা চোখে পড়ে গিয়েছে।
অমুক কিছু নারাজি প্রকাশের আগেই গলাখাঁকারি দিয়ে ‘একটু দেখি’ বলে লেখক টেনে নিলেন পাতাখানি। খসখস। খস খস খসখস খস খস। প্রথমেই লেখেন— রাতের গভীরে এই লেখা আমি এখন লিখছি। এই লেখা আনখশির সততায় চোবানো।
ওমনি সময় ডেকে উঠল সকালের পাখি। লেখক লিখতে থাকেন। লিখেই চলেছেন লিখেছেই চলেছেন লিখে। অমুক মাথা নিচু করে কাঠের সেই শক্ততম অংশে চোখ পেতে রাখে, যেখানে সেই পেপার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।
এবার আপনি হয়তো বলবেন— একটা কাঠ, তাও আবার চায়ের দোকানের টেবিলের কাঠ; শাল, মেহগিনির নিচে নামবে না মুহ্যমান কাঠ, অর্থাৎ পুরনো পুরু কাঠ তো বটেই, তার সঙ্গে চায়ের দোকানে থেকে থেকে সে আরও বেশি করে পাহাড় অঞ্চলের পাইন-টাইন অ্যাম্বিয়েন্স পাচ্ছে, মানে কোণে কোণে ঠাসা কাঠ হতে কে আটকাবে একে, মানে বেজায় শক্ত, উমদা পোক্ত! তার আবার ‘শক্ততম’ কী? মজা মারাচ্ছ? তুমি শালা সেদিনের ছোকরা, তোমার বয়সে স্বয়ং প্রোটোজোয়াও কোষ বিভাজন করতে লজ্জা পায়, তো তুমি কিনা কাঠের শক্ততর, শক্ততম উপমা বোঝাবে!আমি তখন বলব, আপনি বুঝছেন না। কাঠটা যখন গাছ ছিল, তখন হয়তো তার মাথার দিকে একটা ডালের গায়ে হার্টশেপ চিহ্ন দিয়ে একটি বানর আর একটি বানরি বা বানারী, কিংবা আপত্তিকর মনে হলে গল্পের গরুকেও ভেবে নিতে পারেন— তা, প্রেমপূর্বক মানুষকে দেখে দেখে তাদের আদ্যক্ষর খোদাই করে নবরূপে ‘ভাগুযোবি’’ শিখেছিল, মানে যোগ-বিয়োগ এটসেটরা, তারপর তো পার্কের সেই লোকরা ভাবল— সে কী! গাছের টঙে উঠে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করছে! তাও আবার শালপ্রাংশু গাছে! মানে ব্যাপারটা তাদের অজ্ঞানতার আপত্তিতে, বুঝলেন তো, বানরে বানরে হোক বা বানরে-গরুতে, পরের স্টেপে পা ফেলা মাত্র আপনাদের আপত্তি হতই। তা যা হোক, আপত্তিকর মনে হলই যখন, কোতল করে দিল গাছটাকে। এবার ভাবুন, কী চরম একটা প্রেমের দৃষ্টান্ত হায় রে, মানে, রাধাকেষ্টর পর এমনি যুগল আর হতনিকো হতনিকো, হায় হায়— তাহলে বলুন, এই গাছ কী অপরূপতারই না সাক্ষী! সেই গাছকে কিনা খতম করার পরেও কাঠের অন্তঃস্থল প্রেমের বোধে বেঁচে রইল যুগলের অপেক্ষায়।
এদিকে হায়, পেপার জুড়ে আজকাল বানর-বানর, বানর-গরুর দাপট। তাই সেই দাপটের ছোঁয়া, যেমন তেমন নয়, প্রেমময় অবস্থা— পেপার-পেনের ডগা দিয়ে সেই ছোঁয়া যেই না পেল এই কাঠ, চিরবিরহিনী কাঠ, ব্যস, অভিমানে অভিসারে সে আরও কাঠ হয়ে গেল। এবার মিলছে তো? আপনি যদি আজ আমায় জিজ্ঞেস করেন, কোথায় সেই দোকান, সেই কাঠ? আমি কিন্তু হাসব! বেদম হাসব। মানুষের কাণ্ড দেখে আপনাদের কৌতূহল ফুরচ্ছে না, আপনারা গাছেরও কাণ্ড দেখতে চান!
বলিহারি চায়ের দোকান।
স্বর্ণচাঁপা রোদ
সমরেশ মুখোপাধ্যায়
সকাল ৭.১২ মিনিটের শেয়ালদা বনগাঁ লোকাল।বনগাঁ লোকালের সেই ঠাসাঠাসি ভিড়টা অবশ্য নেই।আজ রবিবার বলেই হয়তবা।ট্রেনটা বেশ ফাঁকা ফাঁকাই লাগছে।আমার নাম স্বর্ণচাঁপা। স্বর্ণচাঁপা ধর।প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।গত দু’বছর কোভিড মহামারি আর লকডাউনেই কেটে গেছে।পড়াশুনা ক্লাস পরীক্ষা কোনকিছুই ঠিকঠাক হয়নি।পৃথিবী যে আবার কখনও স্বাভাবিক হবে এই ধারনাটাই উঠে গিয়েছিল মন থেকে।এতদিন গৃহবন্দি থাকার পর ইদানীং বেশ লাগে বাইরে বেরতে।ভারতবর্ষ এমনিতেই জনারণ্য। এমন জনবিস্ফোরণের দেশে মানুষ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যায় দ্রুত।চতুর্দিকে চলমান এই অসংখ্য বৈশিষ্ট্যহীন মানুষকে পিঁপড়ের মত মনে হয়।একঘেয়ে এই দৃশ্য ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।কেউ কারও দিকে তাকায় না।কেউ কারও কথা ভাবে না।শুধু মারপিট, সংঘর্ষ আর হিংস্রতা।স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক কিছু জীবের আনাগোনা, স্রোত ও বিস্মৃতি। এইভাবেই চলে যাচ্ছিল আমারও।এই পিপীলিকা জীবন,এই মশা মাছি জীবন নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস ছিলাম না কোনও কালেই।আমার জন্ম ২০০২ এ।তাই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম,ট্যুইটার, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এদেরকে আমি জন্মাতে দেখেছি।আরও অনেকের মত এই যন্ত্রের সঙ্গে কেটে যায় আমার বেশির ভাগ সময়টা।লকডাউনের সময়েও স্মার্ট ফোনই আমার এবং আমার পরিবারের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।পরিবার বলতে বাবা, মা আর আমি।আমাদের দেশের বাড়ি গোবরডাঙ্গা। চাকরির সুবাদে বাবা দীর্ঘ দিন ধরে কলকাতার বাসিন্দা। দমদমের নাগেরবাজারে আমাদের ফ্ল্যাট আছে।যে কথা বলছিলাম।আজকাল বই পড়া, খবর কাগজ পড়া, এমনকি টিভি দেখা,রেডিও শোনা এ সব উঠে গেছে।ফোনেই সব কিছু পাওয়া যায়!আবেগহীন, অনুভূতিহীন এই যন্ত্র দানব আমাদের সবকিছু খেয়ে নিচ্ছে। পারস্পরিক আলোচনা, বোঝাপড়া, সহমর্মিতা সব ভারচুয়াল… বায়বীয় হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা সেটাই মেনে নিচ্ছি। আমাদের বাড়িতে প্রত্যেকের পারসোনাল স্মার্ট ফোন আছে।অধিকাংশ সময় আমরা ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকি।যে যার মত ফোন ঘাঁটতে থাকি আমরা।কেউ এলে বিরক্ত হই।এমনকি খাওয়ার সময়,কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়ও ফোন ঘাঁটতে থাকি ।আজকাল উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া কোনও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া হয়না আমাদের।বরং ফোনে বা হোয়াটঅ্যাপে বা খুব বেশি হলে ভিডিও কলে খোঁজ নিয়ে নিই সক্কলের।ফলে সামাজিকতা, আদান প্রদান অনেকটাই উঠে গেছে।যা আছে তা নেহাতই কৃত্রিম,লোকদেখানো কিছু ইমোজি।আত্মীয় স্বজন চেনা পরিচিত কারও জন্মদিন,মৃত্যুদিন,এমনকি কেউ মারা গেলেও আমরা যেটা দিয়ে থাকি।অপর পক্ষও তেমনি।ভাত রাঁধা,বাথরুম যাওয়া, মারা যাওয়া এমনকি আত্মহত্যা করার লাইভ দৃশ্যও সক্কলে ফেসবুকে ছাড়তেই বেশি পছন্দ করে।আর লক্ষ্য রাখে কটা লাইক পড়ল।সেকারণেই বারবার ফোন খোলে তারা।মিনিটে মিনিটে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।আজকাল এই কথাগুলিই আমার মনে হতে থাকে বেশি বেশি করে।কেননা বিষাদ নিঃসঙ্গতা এগুলো আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় ইদানীং। বিশেষ করে লকডাউন আর কোভিডের সময় চূড়ান্ত বিপর্যস্ত মনে হত নিজেকে।আজ এতদিন পর বাইরে বেরিয়ে তাই বেশ লাগছে।এখনও কেউ কেউ সচেতনভাবে মাস্ক ব্যবহার করছে।তবে বেশিরভাগেরই মুখে মাস্ক নেই।বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা বলছেন ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষেরই হার্ড ইমিউনিটি গ্রো করেছে।এর একটা বড় কারণ অবশ্যই ভ্যাক্সিনেশন।
২.
ট্রেন কখন ছেড়ে দিয়েছে বুঝতে পারিনি।হঠাৎই আমাদের সামনে একজন সুদর্শন যুবকের আবির্ভাবে সচকিত হয়ে উঠলাম সকলেই।মা,বাবা এবং অবশ্যই আমি।ব্লু ট্রাউজার আর ব্ল্যাক টি শার্ট পরা ছিপছিপে লম্বা এই যুবক।আশ্চর্য মায়াময় তার এই উপস্থিতি।আকর্ষকও বটে।যুবকটি আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,’বসতে পারি?’
বাবা যেদিকে বসেছিল সেদিকেই বাবার পাশের সিটটাতে সে বসতে চাইছে।গাড়ি যেদিকে চলছে তার উল্টোদিকের সিটে রয়েছি আমি আর মা।জানলার পাশেই তবে উল্টো দিকে।কেননা ট্রেনের হাওয়ায় আমার আর মা দুজনেরই অ্যালার্জি।হাওয়া লাগলেই নির্ঘাত সর্দি কাশি জ্বর।কিন্তু বাবার ওসবের কোনও বালাই নেই।ফাঁকা গাড়ি হলে আর সহজে সিট পেলে গাড়ি যেদিকে ছুটছে সেদিককার জানলার পাশের সিট বাবার বেশি পছন্দের।ছেলেটির এই আবেদন আজকালকার দিনে বিরল।বিশেষ করে লোকাল ট্রেনে।যেখানে সিটে বসা নিয়ে রীতিমত মারপিট হয়।একবার ট্রেনে উঠলেই যে যেখানে পারে হুটোপাটা করে বসে পড়ে।সেখানে পাশের সিটে বসার আগে অনুমতি চাইছে।আশ্চর্যের বইকি!বাবা শশব্যস্ত হয়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন না।’ছেলেটি মৃদু হেসে বাবার পাশে বসে পড়ল।তারপর বাবার উদ্দেশ্যেই বলল,’আর একটু হলেই ট্রেনটা মিস করতাম।রোববার বলে জায়গাটাও পেয়ে গেলাম।’বাবা ওর কথা শুনে হাসল,’আপনি বুঝি অনেক দূরে যাবেন?’
‘একদম।প্রান্তিক স্টেশন।বনগ্রাম। ‘বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার দিকে চাইল’,আপনি?’
‘ আমরাও আপনার প্রায় কাছাকাছি, চাঁদপাড়ায়।’বাবার কথা বলার সময়ই ও দু ‘দুবার আমাকে আর মাকে দেখল নির্নিমেষ, ‘এঁরা আপনার পরিবার,তাই তো?’বাবা বলল, ‘হ্যাঁ আমার স্ত্রী মনোরমা, আর মেয়ে স্বর্ণচাঁপা । ‘ ‘আমি সৌরভ।সৌরভ সমাজপতি।হাতিবাগানে থাকি।’ খুবই আন্তরিক শোনাল ছেলেটির গলা।এতক্ষণ ট্রেনে উঠেছে অথচ এখনও পর্যন্ত ওর হাতে মোবাইল দেখিনি।এটা খুবই আশ্চর্যের একটা ব্যাপার।বিশেষ করে আজকালকার দিনে।তবে ওর হাতে একটা খুব দামি ক্যামেরা রয়েছে। এটা অবশ্য প্রথম থেকেই আমি খেয়াল করছি।এসব কথা যখন ভাবছি তখনই হঠাৎ সৌরভের চোখের উপর আমার চোখ পড়ে গেল।আয়ত গভীর টানা টানা সে চোখ বড় শান্ত, বড় বেশি প্রত্যয়ী।এক চাউনিতেই ওর সম্পর্কে আমার আগ্রহ যেন বহুগুণ বেড়ে গেল।এরই মধ্যে একটা রিং টোন শুনে চমকে উঠলাম।’দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না,সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’।আশ্চর্য আজকালকার আধুনিক বাঙালি তরুণ তরুণীর অধিকাংশই আর রবীন্দ্র সংগীত পছন্দ করে না।তারা বরং অরিজিৎ সিং-বা আতিফ ইসলাম বা হানি সিং- এ অনেক বেশি ইন্টারেস্টেড।আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সৌরভের পকেটে রাখা ফোনে রবীন্দ্র গান বাজছে।যথেষ্ট পুলকিত হলাম।সৌরভ পকেট থেকে ফোন বার করল।হ্যাঁ স্মার্ট ফোনই!’বলো মা।আমি ট্রেন পেয়েছি।এই তো বিধান নগর ঢুকছে।’সৌরভের গলা,বিনয়ী এবং দৃঢ়।কথা বলা হয়ে গেলে সৌরভ ফোনটা আবার পকেটে রেখে দিল।কোনও ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ওপেন করল না!বাবা বলল,’ একটা কথা জিগ্যেস করব?’বাবা বড্ড কথা বলে।সৌরভ নিশ্চয় বিরক্ত হচ্চে।কিন্তু আমি দেখলাম ও বিরক্ত তো হলই না, বরং হেসে বলল,’একটা কেন হাজারটা প্রশ্ন করুন।কথা বলতে আমি খুব ভালোবাসি।’সৌরভের কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি,বাবা জিগ্যেস করে বসল’,কি করা হয়?’খুবই অসম্মান জনক প্রশ্ন।কিন্তু এবারেও সৌরভ সেই আগের মতই শান্ত ও স্থির,’তেমন কিছু না।ঘুরে বেড়াতেই বেশি ভালো লাগে আমার।”আর কিছু?’ফের বাবার প্রশ্ন। ‘আর একটু আধটু লেখালেখির চেষ্টা করি।’সৌরভ সেই আগের মতই শান্ত।বাবাও যেন এই ছেলেটি সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে পড়ছে,’বাঃ বাঃ খুব ভালো।এখন আপনি বনগ্রামে কি ঘুরতে যাচ্ছেন?’বাবাকে থামিয়ে সৌরভ বলল, ‘ হ্যাঁ।বিভূতিভূষণের বাড়ি।আর একটা কথা,আমাকে দয়া করে আপনি বলবেন না।আমি আপনার থেকে অনেক ছোট!’ছেলেটির সৌজন্য বোধও তারিফ করার মত।বাবা বলল,’বেশ বেশ ঠিক আছে।তা বনগাঁতেই বিভূতিভূষণের বাড়ি?’ ‘আজ্ঞে না।বনগাঁ স্টেশন থেকে অন্তত আট কিলোমিটার দূরে।গ্রামটার নাম চালকি বারাকপুর।যাননি বুঝি কোনও দিন?’বাবাকে একটু আনমনা দেখাল,’আসলে অনেকবার ভেবেছি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।আমার খুব প্রিয় লেখক।’সৌরভ আগ্রহ ভরে বাবার কথা শুনছিল,’যাবেন আজকে?আমার সঙ্গে? কাছেই তো,চাঁদপাড়ার পরের স্টেশনই বনগাঁ!’বাবা আমার আর মার দিকে তাকল।আমরা দুজনেই রাজি।
৩.
বনগাঁ স্টেশনে নেমে বেশ ভালো লাগল আমার।সৌরভের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার দারুণ জমে গেছে।আমার থেকে বছর তিনেকের বড় ও।মাস্টার্স করে রাজ্য সরকার অনুমোদিত একটা বাংলা মাধ্যম স্কুলের বাংলার শিক্ষক। স্কুলের চাকরি। তাই ছুটি ছাটা একটু বেশি।ওর ঘোরাঘুরির নেশার সঙ্গে বেশ মানানসই।সৌরভ আবার লেখালেখিও করে।স্টেশনে নেমেই সৌরভ বলল,’এই নিয়ে ৩০ বার বনগাঁয় এলাম!যখনই মনখারাপ হয় বনগাঁয় চলে আসি।বছরে দু’ তিনবার তো বটেই।কোনও কোনও বছর চার পাঁচবারও এসেছি।’
সৌরভের কথা শুনে বাবা বেশ অবাক হয়ে গেল,’তাই বুঝি!’ ‘হ্যাঁ কাকু।ছোটবেলায় বাবা মার সঙ্গে যখন আসতাম তখনও বনগাঁ বেশ গ্রাম গ্রাম ছিল।চালকি বারাকপুর তো এক্কেবারে গ্রাম।সরু সরু মাটির রাস্তা আর রাস্তার দুপাশ জুড়ে আড়শ্যাওড়া,পেতনিঝোপের সারি।সে যে কী দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।আসলে আমার বাবা মাও বিভূতিভূষণের খুব ভক্ত।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল সৌরভ।আমি অভিভূত হয়ে শুনছিলাম।আজকালকার তরুণরা ঠিক এরকম হয়না।আমি অন্তত দেখিনি।গ্রামে গঞ্জে কেউ খুব বেশি একটা যেতে চায়না।শহর,ফাস্টফুড, কর্পোরেট জীবন। এসবই তাদের বেশি পছন্দের।একধরণের স্বার্থপর, ব্যক্তি সর্বস্ব জীবন তাদের কাঙ্ক্ষিত।এখনকার বনগাঁ যদিও অনেক বেশি ঝকঝকে।নামি দামী অনেক বিপনীতে সজ্জিত।রাস্তাঘাটও বেশ সুন্দর।তবে মহানগরী কলকাতার তুলনায় তা তো কিছুই নয়। তাহলে বারবার কিসের আকর্ষণে এখানে ছুটে আসে সৌরভ!একটা টোটো রিজার্ভ করে নিয়েছিল ও।ফলে আধাঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম বিভূতিভূষণের বাড়ি।এরকম মনোরম গাছপালা ঘেরা বাড়ি এর আগে আমি কখনও দেখিনি।গোটা বাড়িটা জুড়েই অসংখ্য গাছাপালা আর লতায় পাতায় ভর্তি।কদম, আম,জাম,কাঁঠাল,বকুল আরও কত নাম না জানা গাছের বিবরণ পেশ করতে লাগল সৌরভ।কথা বলতে বলতে কখন যে আমি আর সৌরভ একটা ঝোপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়ালই করিনি।একটা বসন্তবৌরি না একটা বউ কথাকও উড়ে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে।শরতের মিঠে রোদে দোল খাওয়া একটা ছোট্ট পাখি আর কাঁঠালের কোয়ার মত একটা মিস্টি গন্ধমাখা ফুলের দিকে আঙুল তুলে সৌরভ বলল,’বলুন তো ওটা কি ফুল?’আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিক।জানিনা।’আর পাখিটা?’তাও তো চিনি না।তাই নিরুত্তরই থাকলাম।হঠাৎই সৌরভ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল গাছটার দিকে, ‘আপনি দেখছি কিছুই জানেন না।আরে এটা হল কাঁঠালিচাঁপা ফুল,আর ওই যে সোনার মত রঙের মিস্টি ফুলগুলো ওগুলো হল স্বর্ণচাঁপা। অনেকটা আপনার গায়ের রঙের মত।’লজ্জায় আমার মুখটা রক্তাভ হয়ে উঠল।আমি সেই উত্তাপ টের পাচ্ছিলাম।দূরে দেখলাম বাবা আর মা একটা বিরাট কদমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে।পাখিটা কখন যেন উড়ে গেছে বুঝতে পারিনি।শরতের মিঠে রোদে ছেয়ে আছে স্বর্ণচাঁপা। সৌরভ বলেছিল এই ছোট্ট পাখিটার নাম টুনটুনি।
‘সলিল’-নামক নীল-ধ্রুবতারা
পার্থজিৎ চন্দ
এক একটি মুহূর্ত থাকে, এক একটি অভিজ্ঞতা থাকে, যার ভেতর দিয়ে যাবার পর ব্যক্তিমানুষ সম্পূর্ণ ‘নতুন’ রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। স্পষ্ট মনে আছে, সে এক মেঘ-ভাঙা রোদের দুপুর। রেডিও-তে বেজে উঠেছিল ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা…।’ অর্কেস্ট্রেশন বিষয়টি কী, প্রিল্যুড শুনে কীভাবে সলিল’কে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকে অথবা থাকে না; কীভাবে সলিলের গান অতর্কিতেই প্রায় আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে- সে সব নিয়ে ভাবার দিন শুরু হয়নি।
আমার শীর্ণকায়, শ্রমিক-ইউনিয়ন করা বাবা, জীবনের নানা প্রান্তে ঘুরে-ঘুরে আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা অর্জন করা বাবা শূন্যে হাত ঘুরিয়ে দেখিয়ে চলেছিলেন কীভাবে ‘সলিল চৌধুরী’-নামক এক শিল্পীর সুরে পায়রারা, কপতেরা, পারাবতেরা ভেসে চলেছে। নেমে আসছে। আবার উড়ে যাচ্ছে। পায়রার সেই বাতাসের বুকে গড়ে তোলা ব্যালের সার্থকতম সুরের প্রকাশ একই সঙ্গে বুক ও মাথার ভেতর প্রবেশ করার পর, আমার বিশ্বাস, আমার নবজন্ম হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, সার্থক শিল্পের প্রধানতম লক্ষণ- সে আমাদের বিন্দুমাত্র ‘সুযোগ’ না-দিয়ে অক্টোপাসের মতো আক্রমণ করে, আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে।
এরপর থেকে সলিল আমার কাছে কী এবং কেন- তার কোনও ব্যাখ্যা প্রায় নেই। হৃদয় ও মস্তিষ্কের মেলবন্ধনে ব্যাখ্যা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। যা থাকে তা হল অবগাহনের আনন্দ।
আজ, তার জন্মক্ষণের থেকে এতটা দূরে দাঁড়িয়ে মনে হতে বাধ্য, ভার্সেটাইল জিনিয়াসের সমস্ত লক্ষণ স্মরণ করার পরেও যদি শুধুমাত্র কোনও একটি কারণকে তাঁর কবজকুণ্ডল বলে চিহ্নিত করতে বলা হয় তা হলে সেটি অবশ্যই তাঁর ‘স্বচ্ছ’ রাজনৈতিক অবস্থান ও শিল্পবোধ।
তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মকথন ‘জীবন উজ্জীবন’-এ লিখেছিলেন, ‘কারণ রবীন্দ্রসংগীতই হচ্ছে সমকালীন বাংলা গানের জমিনের শেষ প্রান্ত- তারপরেই বঙ্গোপসাগর।’
এবার আসা যাক তাঁর আরেকটি বিস্ফোরক পর্যবেক্ষণের কাছে, ‘অর্থাৎ বিগত পঞ্চাশ বছরে প্রধানত সিনেমার মাধ্যমে সমকালীন ভারতীয় সংগীতে যে পরিমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষা ঘটেছে- তার বিবর্তনে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকসংগীত, মার্গ সংগীত এবং পাশ্চাত্যের ক্ল্যাসিকল্ এবং লোকসংগীত ও পপ সংগীতের যে মিশ্রণ ঘটে, তাকে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীতে পরিণত করেছে এবং একটি সর্বভারতীয় সাংগীতিক ভাষা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে, এ-বিষয় গবেষণার জন্য আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই’।
এ-পর্যবেক্ষণ ও তাকে তুলে ধরার অধিকার যে গুটিকয়েক ভারতীয় সংগীতকারের আছে তাঁর মধ্যে সলিল অন্যতম। কারণ, তিনিই সেই সংগীতকার যিনি আইপিটিএ-পর্বে নৌ-বিদ্রোহের সময়ে ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’ থেকে শুরু করে সারা-ভারতের কোণে-কোণে, মুখে-মুখে ফেরা ‘পাগল হাওয়া’ (জিন্দেগি ক্যায়সা হ্যায় পহলি) পর্যন্ত অবলীলায় সফর করেছেন। শৃঙ্গগুলিকে জয় করেছেন একের পর এক।
কেন সলিলের গানের কথা-প্রসঙ্গে ‘রাজনীতি’র কথা এবং শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতার কথা আসবে সে প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া দরকার। হয়তো অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করবেন, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কম্যুনিস্ট-পার্টি ও শিল্পের ভূমিকা নিয়ে তিনি যদি একটি সন্দর্ভ বা দলিল রচনা করে যেতেন তা হলে সেটি অমূল্য হিসাবে গৃহিত হত ভাবীকালের কাছে। পার্টিজান রাজনীতি যে দেশকাল-নিরেপেক্ষ হতে পারে না এবং শিল্প ও শিল্পীর ভূমিকা যে ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ পালন করা নয় তা বারবার দেখিয়ে গেছেন সলিল।
ঘটনাটি অনেকেরই জানা, তবু আরেকবার উদ্ধৃত করবার ইচ্ছা দমানো গেল না; কারণ, মৌলবাদের (তা রাজনৈতিক হলেও) ফাঁদ ও অপযুক্তি যে কী মারাত্মক হতে পারে তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করছে সলিলের একটি গান এবং তাকে কেন্দ্র করে ঘনিয়ে ওঠা বিতর্ক। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে হাহাকার করে উঠেছিল, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে / ধান দেব মেপে…।’ অতি-বিখ্যাত এই গানটির এক জায়গায় ছিল, ‘হায় বিধি বড়ই দারুণ / ক্ষুধার আগুন জ্বলে আহার মেলে না’। দাঙ্গা-দেশভাগ-উদ্বাস্তু মানুষের ঢল এসব তো শিল্পে ছায়া ফেলবেই। না-ফেললে তা অশ্লীলতা হিসাবেই বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু, যখন একজন বাঙালি কৃষক-বধূর গলায় ‘বিধি’ শব্দটি ধ্বনিত হবার কারণে সলিল’কে পার্টি থেকে বিতাড়িত করার কথা ভাবা হতে থাকে, আক্রমণ করা হতে থাকে তখন সন্দেহ থাকে না যে সঙ্ঘের শরীর থেকে, যে কোনও স্ট্রাকচারড-ফ্রেমের ভেতর থেকে ফান্ডামেন্টালিজমকে দূর করা ভীষণ কঠিন একটি কাজ।
তবু তিনি ‘সলিল’ এবং মুক্তির স্বপ্ন দেখে যাওয়া একজন স্রষ্টা ও দ্রষ্টা। এই মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেও তিনি রচনা করেছিলেন সেই ঐতিহাসিক গান, ‘যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি…’।
২
এবার একবার সলিলের ভার্সেটাইলিটির দিকে ফিরে তাকানো যাক। ‘হেই সামালো হেই সামালো’ (১৯৪৮) বিদ্রোহের আগুনকে ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকে দিকে। অকল্পনীয় সাহস ও নিরীক্ষার ক্ষমতাই যে একজন শিল্পীকে শেষ পর্যন্ত গড়পড়তা শিল্পীর উচ্চতা থেকে মুক্তি দিয়ে মহৎ-স্রষ্টার স্তরে পৌঁছে দেয় তার জীবন্ত উদাহরণ, ‘হয়তো তাকে দেখোনি কেউ হয়তো দেখেছিলে’ (১৯৫০)। রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’কে বিনির্মাণ করে সমকালের ক্ষতের মধ্যে স্থাপন করা নিয়েও বিতর্ক তাড়া করেছিল তাঁকে। কিন্তু সময়ের হাতে ধ্বস্ত ‘কৃষ্ণকলি’র রূপ সময়েরই সাক্ষ্য বহন করছে।
শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, শিল্পীর সংকট ইত্যাদি নিয়ে বারবার সলিলকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। যেমন ১৯৬৯-এ বাঙালিকে মাতোয়ারা করে দেয়, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’। এর এক দশকেরও আগে প্রকাশিত হয়েছিল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠেই গীত হয়েছিল, ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি’ এবং ‘দুরন্ত ঘূর্ণীর এই লেগেছে পাক’ (১৯৫৮)। এখন এখানে অবশ্যই লক্ষ করার, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’তে ‘দিশাহারা’ শব্দটি আছে; কিন্তু এটিও যে একটি বিশেষ মানসিক সংক্ষুব্ধ অবস্থার প্রকাশ সেটি উপরিচর প্রবণতা দিয়ে বোঝা সম্ভবপর নয়। একটি গান, যেটি আইপিটিএ-র সময় গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস, সেটি রেকর্ড করার সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বেছে নেওয়া (যার সম্ভাব্য কারণ, হেমন্তের কণ্ঠ) নিয়ে বিতর্ক তাড়া করেছে তাঁকে। কিন্তু, এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আন্তর্জাতিকমানের প্রতিবাদের গান, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ (১৯৬৩) গেয়েছিলেন দেবব্রত; সেখানেও শিল্পী নির্বাচনে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।
কিন্তু, কেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর সংগীতের জগতে সব থেকে বড় ‘ঘটনা’ তার আরেকটি কারণ অবশ্যই ছায়াছবির গান। বাংলা চলচিত্রে তাঁকে বেশি ব্যবহার করা হয়নি বলে একটা চোরা আক্ষেপ আমাদের মধ্যে কাজ করেই। তবু, জিনিয়াসের কয়েকটি কাজ স্মরণ করা জরুরি। খ্রিষ্টীয় প্রার্থনার আদলে ‘সিস্টার’ ছায়াছবিতে তিনি সবিতা চৌধুরী ও অন্যান্য শিল্পীদের জন্য রচনা করেছিলেন, ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু’। ১৯৮৫-তে ‘প্রতিজ্ঞা’ ছায়াছবিতেও তিনি ‘তুমি মাতা পিতা তুমি হে’- গানটি ব্যবহার করেন, যার মধ্যে প্রার্থনা-সংগীতের ছায়া রয়েছে।
সলিলের সব থেকে বড় অসাধ্যসাধন সম্ভবত হিন্দি-ছায়াছবিতে তুমুল সাফল্য অর্জন এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সুরের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরা। শচীন দেববর্মণের হাত ধরে যে ধারা শুরু হয়েছিল সলিলের হাতে তা পূর্ণতা পেয়েছিল।
একটি ছায়াছবির সবগুলি গান সলিলের সুরের জাদুতে সারা-ভারতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ‘মধুমতি’র কয়েকটি গানের উল্লেখ এবং সুরের বৈচিত্র্য লক্ষ করলেই বোঝা যাবে সলিল আসলে কী মহাবিস্ফোরণ,
১- দিল তড়প তড়প কে, ২- যুল্মি সঙ্গ আঁখ লড়ি, ৩- চড় গ্যায়ো পাপী বিছুয়া, ৪- ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল, ৫- জঙ্গল মে মোর নাচা কিসি নে না দেখা এবং ৬- আজা রে পরদেশি…
-অবশ্য শিল্পের মৌলবাদী ধারণা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তার আগেই ‘দো বিঘা জমিন’ ছায়াছবির ‘ধরতি কহে পুকার’, ‘হরিয়ালা শাওন ঢোল বাজাতা’র সুরে আসমুদ্রহিমাচল জয় করে নিয়েছিলেন তিনি।
উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে যাওয়া যায়, এবং প্রমাণ করা যায় কেন তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এখনও পর্যন্ত সংগীতকার হিসাবে এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতমদের একজন।
এই সংক্ষিপ্ত সফরনামা শেষ করার আগে একটা হাহাকারও কি কাজ করছে না? তিনি দুটি গান, ‘আমার কিছু মনের আশা’ এবং ‘প্রান্তরের গান আমার’ রেকর্ড করিয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়’কে দিয়ে। স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘বম্বেতে হঠাৎ আমার কাছে মোহরদির স্থানে স্থানে চোখের জলে অস্পষ্ট একখানা চিঠি এল- ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে’।
পরে উৎপলা সেন চমৎকার গেয়েছিলেন্ গান দু’টি; কিন্তু, শিল্পের মৌলবাদ যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এই ঘটনা তার ‘উজ্জ্বল’ উদাহরণ।
আধুনিক সময়ে গান এবং তাতে সুর ও বাণীর ভূমিকার মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করার দিন শেষ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের পর বাণীর গভীরতা বেশ কয়েকজন গীতিকার স্পর্শ করেছেন। কিন্তু, কথা ও সুরের এ-বৈচিত্র্যে সলিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-নামক দুটি মহা-শৃঙ্গ বাদ দিলে, ‘একক’।
বাঙালির প্রেম-দ্রোহ-আত্মসংকট থেকে শুরু করে আত্মপরিচয়ের যে বিশাল অনবরুদ্ধ আকাশ-চাঁদোয়া, সেখানে সলিল নীলাভ তারার মতো জ্বলজ্বল করছেন।
হয়তো প্রতিদিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন।