চতুর্থ বর্ষ -প্রথম সংখ্যা-সমালোচনা
চলচ্চিত্র সমালোচনা : কিলারস অফ দ্য ফ্লাওয়ার মুন
পরিচালক : মার্টিন স্করসেসি
স্ক্রিনপ্লে : মার্টিন স্করসেসি– এরিকরথ
ক্যামেরা : রদ্রিগো প্রিয়েতো
মূলবই : ‘কিলারস অফ দ্য ফ্লাওয়ার মুন‘ – ডেভিড গ্রান
সম্পাদনা : থেলমা স্কুনমেকার
সঙ্গীত : রবি রবার্টসন
অভিনয় : রবার্ট দে নিরো, লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও, লিলি গ্ল্যাডস্টোন, জেসি প্ল্যামোনস, ব্র্যান্ডন ফ্রেসার এবং বাকি কলাকুশলীগণ
আলোচনায় : দেবার্ঘ্য দাস
অতীত কখনোই পুরোপুরি অতীত নয়—তা রয়ে যায় ভূমিতে,গল্পে এবং সেইসব মানুষের আত্মায়, যারা এর ভার বহনকরে– Whose story is told? Whose silence is staged?”
মার্টিন স্করসেসির Killers of the Flower Moon একটি প্রশ্নপত্র নয়, এটি ইতিহাসের গায়ে পোড়া একচিহ্ন, যাকে দেখে প্রশ্ন উত্থাপন হয়, ন্যায়-বিচারের দাবি ওঠে—আর দর্শক নিজের নৈতিক অবস্থান নিয়েও সংলাপে জড়িয়ে পড়ে।এটি চলচ্চিত্র নয়, এটি আত্মনিহতের প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল, যেখানে ক্যামেরা হয়ে ওঠে কাফনের ফালি। মার্টিন স্করসেসির কিলারস অফ দ্য ফ্লাওয়ার মুন এক অনবদ্য চিত্রকাব্য, যেখানে প্রতারণা, লোভ ও পদ্ধতিগত হিংসার মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক গভীর বিষণ্ণগাথা।ডেভিড গ্র্যানের গবেষণামূলক গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই সিনেমা ১৯২০–এর দশকের ওসেজ হত্যাকাণ্ডকে তুলে ধরে, যা পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়েছিল তেলসমৃদ্ধ ওসেজ জাতির জমি দখলের জন্য।কেবল ঐতিহাসিক একটি কাহিনী নয়, বরং শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক পৃথিবীর প্রতি একধরনের প্রলাপ, যেখানে স্করসেসি আমেরিকান সিনেমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন।
শুরুতেই সিনেমাটোগ্রাফার রদ্রিগো প্রিয়েতো ওসেজ জাতিকে এমন একটি রঙের ক্যানভাসে উপস্থাপন করেন যা প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং ভয়ানক ধ্বংসের মধ্যে একদোলাচলের জন্ম দেয়।ক্যামেরা প্রায়শই ওকলাহোমার বিস্তৃত ভূমিতে থমকে দাঁড়ায়—প্রেইরি ঘাসের সোনালি আভা এবং আকাশ ছুঁতে থাকা তেলের কূপের কালো ধোঁয়া যেনএকে অপরের প্রতিফলন। প্রিয়েতোর ফ্রেমিং অত্যন্ত সূক্ষ্ম।বিস্তৃত দৃশ্যগুলো প্লেইনের বিশালতা ও বিচ্ছিন্নতাকে তুলেধরে, আর কাছ থেকে তোলা ক্লোজ–আপ দৃশ্যগুলো চরিত্রগুলোর মানসিক টানাপোড়েন ফুটিয়ে তোলে।আলোএবংছায়ার ব্যবহারেএকটি দমবন্ধপরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যেখানে লুকিয়ে থাকে গোপনীয়তা আর পাপ।গ্যাসল্যাম্পের মৃদুআলো কিংবা তেল রিগের জ্বলন্ত আভা – মাঝেমধ্যে একপ্রেতাত্মার মতো আবির্ভূত হয়, মনে করিয়ে দেয় মানুষের লোভের ধ্বংসাত্মক শক্তিরকথা। ইতিহাসের সর্বজ্ঞ দৃষ্টি থেকে চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যেকার দ্বৈততা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এবং তা ছবির মূল ভাবনাগুলোর দ্যোতনা প্রতিফলিত করে এবং পাশাপাশি দর্শকদেরও তাদের নিজস্ব অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করে! স্করসেসি এবং এরিক রথের লেখা চিত্রনাট্য মূলগ্রন্থের প্রচলিত কাঠামো থেকে ভিন্নপথে হাঁটে।ডেভিড গ্র্যানের বইটি মূলত এফবিআইয়ের তদন্তকে কেন্দ্র করে লেখা, সেখানে সিনেমাটি আনা হয়েছে আর্নেস্ট বার্খার্ট (লিওনার্ডোডিক্যাপ্রিও) এবং মলিকাইল (লিলিগ্ল্যাডস্টোন)-এর সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে ; এই পরিবর্তন কাহিনীকে করেছে আরো ব্যক্তিগত এবং হৃদয় বিদারক।
স্করসেসির গল্পবলার ধরন ধীর এবং গভীর।এখানে কোনো নাটকীয় মোড় বা সহজ সমাধান নেই; এটি এক অগ্নিগর্ভ ট্র্যাজেডির মতো উন্মোচিতহয়।চিত্রনাট্যটি ভরপুর সাজানো গোপন বার্তায়, ডিকোডিং করলে দেখা যাবে উপনিবেশবাদ এবং পুঁজিবাদ কীভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে সিনেমা যেন সেই কথাই বলছে। ওসেজ জাতির সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি এই ছবির আরেকটি বড়প্রাপ্তি।ওসেজ পরামর্শদাতাদের সঙ্গে কাজ করে স্করসেসি তাদের আচার–অনুষ্ঠান, ভাষা এবং ঐতিহ্যকে আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।মলি কাইল এক প্রতীকী চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন—প্রতিরোধ ও ক্ষতির প্রতিমূর্তি হিসেবে।
আর্নেস্ট বার্খার্টের ভূমিকায় লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিওর অভিনয় নৈতিক দ্বিধার এক পর্যালোচনা।তার চরিত্রটি সরল ভিলেন নয়, আবার আদর্শ নায়কেরও নয়—সে এমন এক মানুষ, যাকে লোভের চক্রে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার প্রেম এবং প্রতারণা একই সময়ে মলির জীবনে বয়ে এনেছে ধ্বংসের ঝড়।।ডিক্যাপ্রিওর অভিনয়ে সংযম স্পষ্ট; তার ছোটছোট অঙ্গভঙ্গি এবংএকঝলক দৃষ্টি তার অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে। লিলি গ্ল্যাডস্টোনের মলি এই ছবির হৃদয়।তার নীরব গরিমাএবং গভীর দৃষ্টি অনেক সময় কথার চেয়েও বেশি অর্থ বহন করে।গ্ল্যাডস্টোনের অভিনয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু– একটি জাতির দুঃখ এবং শক্তির ধারক। রবার্ট ডি নিরো উইলিয়াম হ্যালের চরিত্রে এক ভয়ংকর শান্তি নিয়ে হাজির হন।মিষ্টি কথা এবং নিষ্ঠুরতার এক জটিল কুটিল সংমিশ্রণ, যা শোষণের অন্তর্নিহিত চরিত্রকেই প্রকাশ করে।জেসি প্লেমন্সের টম হোয়াইটের মতো সহ–অভিনেতারা দৃঢ় অভিনয় দিয়ে কাহিনীকে সমৃদ্ধ করেছেন।
কিলারস অফ দ্য ফ্লাওয়ার মুন মূলত পদ্ধতিগত সহিংসতা এবং ইতিহাস মুছেফেলার একটি চিন্তাশীল অন্বেষণ।স্করসেসি কোনো সহজ উত্তর বা স্বস্তির সমাপ্তি দেননা; বরং তিনি দর্শকদের উপনিবেশবাদ এবং পুঁজিবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করেন।স্করসেসির ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার এক ধৈর্যশীল অধ্যয়ন।ক্লাসিক থ্রিলারের ছাঁচে গড়া এই গল্পটি ত্বরিত গতির পরিবর্তে ধ্যানী, থিতু, এবং দার্শনিক এক গতি অর্জন করে।সে নিজেই বারবার গল্প বলা নিয়ে প্রশ্ন তোলে—’কে বলে‘, ‘কেন বলে‘, এবং ‘কারা শুনতে চায়না‘? মলির দৃষ্টিকোণ সিনেমার মানসিক ব্যাকবোন, কিন্তু চূড়ান্ত স্লো–বার্ন স্টাইল দর্শক কেজো করে বসিয়ে রাখে আত্মানুসন্ধানের আদালতে।স্করসেসি এখানে আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন—এই গল্প বলার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রশ্নকরেন, “আমি কি ইতিহাস উদ্ধারকরছি, নাকি সেই ইতিহাস থেকেই নিজেকে রেহাই দিচ্ছি?”ছবির শেষ দৃশ্যগুলো, যেখানে আধুনিক মাধ্যমের প্রেক্ষাপটে এইঅপরাধগুলো পুনর্বিবেচনা করা হয়, কাজের শক্তি এবং দায়িত্বের প্রতি একধরনের কাহিনি বলার মেটা–মন্তব্য দর্শকদের জন্য ছেড়ে দেন স্করসেসি।
কিলারস অফ দ্য ফ্লাওয়ার মুন শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়, একটি অভিজ্ঞতা—একটি চলচ্চিত্রিক কবিতা, যা ক্রেডিট শেষ হওয়ার পরও দর্শকের মনে গেঁথে থাকে।এর সূক্ষ্ম নির্মাণশৈলী, জটিল অভিনয় এবং নির্ভীক গল্প বলার মাধ্যমে স্করসেসি আমাদের ক্ষমতা, পরিচয় এবং সহযোগিতার বিষয়ে কঠিন প্রশ্ন করতে বাধ্য করেন।এই চলচ্চিত্র কেবল দেখার নয়, তা অনুভবের—আর এই অনুভব কখনোই স্বস্তিদায়ক নয়।বরং দর্শককে বারবার ফিরে যেতে হয় নিজের অবস্থানে: আমি কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম, যখন এই ইতিহাস লেখা হচ্ছিল? এই প্রশ্নই সিনেমাটিকে রূপ দেয় এক ethnographic confession-এর। ইতিহাস, রাষ্ট্র, প্রেম, সহিংসতা—সবকিছু মিলে এখানে একটি নিষ্পাপ প্রজন্মের উপর চাপিয়ে দেওয়া পাপের উত্তরাধিকার বহন করাহয়।
এই ছবি ওসেজ জাতির দৃঢ়তার প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন জানায়, পাশাপাশি সেইসব ব্যবস্থার যা সমগ্র ওসেজ জাতির পরিকল্পিত পথে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল সেইসব কিছুর বিরুদ্ধে দৃঢ় নিন্দার বার্তা দেওয়ার চেষ্টাকরাহয়েছে।সিনেমার শেষে ক্রেডিটের নীরব মহিমায়, ছবিটি মনে করিয়ে দেয় যা দিয়ে এই লেখাটির শুরু – অতীত কখনোই পুরোপুরি অতীত নয়—এটি রয়ে যায় ভূমিতে, গল্পেএবংসেইসব মানুষেরআত্মায়, যারা এর ভার বহন করে।
মনোজ কুমার ও ভারতীয় সিনেমার দেশাত্মবোধ
দীপ্তেশ মুখার্জী
যখনই ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা ওঠে, তখন এক অবধারিত নাম এসে পড়ে — মনোজ কুমার। তিনি কেবল একজন অভিনেতা নন, ছিলেন এক সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতীক, যিনি পর্দায় তুলে ধরতেন ভারতবর্ষের অন্তরের কথা। তাঁর সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, ছিল একধরনের ভাবনা, আহ্বান, এবং কোনো কোনো সময়ে প্রতিবাদ। ১৯৬০ থেকে ৭০-এর দশক পর্যন্ত হিন্দি সিনেমার পর্দায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ছিলেন মনোজ কুমার। তাঁর জীবনদর্শন, অভিনয়শৈলী, ও চলচ্চিত্র নির্মাণ সবই মিলে তাঁকে করে তুলেছে এক ব্যতিক্রমী স্রষ্টা।
মনোজ কুমারের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৪ জুলাই অবিভক্ত ভারতের অ্যাবটাবাদে (বর্তমান পাকিস্তান)। দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার দিল্লিতে চলে আসে। দেশভাগ, বাস্তুচ্যুতি ও স্বাধীনতার উত্তাল সময়কে চোখের সামনে দেখে বড় হয়ে ওঠা মনোজের মনে গেঁথে গিয়েছিল এক গভীর দেশপ্রেমের অনুভব — যা পরবর্তী কালে তাঁর সিনেমার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছিল।
মূল নাম হরীকৃষ্ণ গোস্বামী হলেও, অভিনেতা দিলীপ কুমারের প্রতি মুগ্ধ হয়ে নিজের নাম রাখেন ‘মনোজ কুমার’। অভিনয়জগতে প্রবেশ তাঁর জন্য সহজ ছিল না, কিন্তু একবার সুযোগ পেয়েই নিজেকে মেলে ধরেন পর্দায়।
মনোজ কুমারের অভিনয়ের মধ্যে ছিল এক অসাধারণ সংযম। তিনি কখনোই অতিনাটকীয়তায় বিশ্বাস করতেন না। তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গি ছিল ধীর, স্পষ্ট, অথচ গভীরতায় ভরা। চোখের অভিব্যক্তি, গলার টান, শরীরের ভাষা — সবকিছু মিলিয়ে এক এমন ধরণ তৈরি করেছিলেন, যা “ভারতীয়” বলেই মনে হতো।
তিনি ছিলেন ‘the thinking man’s hero’। তাঁর চরিত্রে থাকত দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা ও আত্মত্যাগের ছাপ। এই স্টাইল একদিকে যেমন দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলত, তেমনি ভারতীয় মধ্যবিত্তের জীবনের সাথেও একধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যেত।
মনোজ কুমারের সিনেমার মূলমন্ত্র ছিল ‘দেশ’। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন শিল্পীর কাজ কেবল বিনোদন নয়, সমাজকে পথ দেখানো। ১৯৬৫ সালের ‘Shaheed’ সিনেমায় ভগত সিং-এর চরিত্রে তাঁর অভিনয় তাঁকে প্রথম সাফল্য এনে দেয়। এরপর তিনি নিজেই চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও অভিনয় করেন ‘Upkar’ (১৯৬৭)-এ — যা ভারতের প্রথম ‘Green Revolution’-এর পটভূমিতে নির্মিত এক স্মরণীয় চলচ্চিত্র।
এই ছবিতেই প্রথম তিনি পরিচিত হন ‘Bharat’ নামের চরিত্রে। এই চরিত্র এক নতুন প্রতীক হয়ে ওঠে — একজন কৃষক, সৈনিক, দেশপ্রেমিক — এক কথায় ভারতবর্ষের অন্তর্গত আত্মা।
এরপর একের পর এক ‘Purab Aur Paschim’ (১৯৭০), ‘Roti Kapda Aur Makaan’ (১৯৭৪), ‘Kranti’ (১৯৮১) — সবখানেই দেখা যায় তাঁর সেই চিরাচরিত ‘ভারতীয়তা’র দর্শন। তিনি তাঁর সিনেমায় প্রশ্ন করেছেন, “কেন আমাদের দেশে রুটি, কাপড় আর বাসস্থান এক বিলাসিতা হয়ে উঠেছে?” আবার, “কেন পাশ্চাত্যের চাকচিক্য দেখে আমরা নিজেদের ভুলে যাই?”
মনোজ কুমার কখনো সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হননি, কিন্তু তাঁর ছবিগুলো ছিল সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা বহনকারী। ‘Roti Kapda Aur Makaan’ ছবিতে তিনি তুলে ধরেছিলেন বেকার যুবকের হতাশা, দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন, এবং সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই।
‘Purab Aur Paschim’-এ তিনি পশ্চিমের মুক্ত সমাজের ভেতরের ফাঁপা অহংকারকে তুলনা করেন ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরতা ও সংযমের সঙ্গে। এইসব বার্তায় মনোজ কুমার তুলে ধরতেন এক ব্যতিক্রমী জাতীয়তাবাদ — যা আধুনিকতাকে অস্বীকার করত না, কিন্তু নিজের শিকড়কে আঁকড়ে ধরতে বলত।
এই সময়কালে বলিউডে যেমন রোম্যান্টিক হিরো (রাজেশ খান্না), অ্যাংরি ইয়ং ম্যান (অমিতাভ বচ্চন), তেমনই ‘দেশপ্রেমিক হিরো’ হয়ে উঠলেন মনোজ কুমার।
তাঁর সিনেমা ছিল ভিন্নধর্মী — সেখানে নাচগান থাকত, কিন্তু তার পেছনে থাকত বক্তব্য। সংলাপে থাকত আবেগ, কিন্তু তার গভীরে থাকত দর্শন। আর এইসব মিলিয়েই গড়ে উঠেছিল একটি নতুন ধারার ভারতীয় সিনেমা, যেটা সমানভাবে জনপ্রিয় এবং চিন্তাশীল।
তাঁর পরিচালিত ছবিগুলির চিত্রনাট্য, গান, এবং সংলাপ আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। “Mere Desh Ki Dharti” গানটি আজও ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে অন্যতম।
তবে মনোজ কুমারের সিনেমা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। অনেকেই মনে করতেন, তাঁর দেশপ্রেম ছিল অতিরিক্ত আদর্শবাদী। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে অনেক সময় তাঁর সিনেমা একটু একঘেয়ে বা পুরাতন ধাঁচের মনে হতো।
কিন্তু একজন শিল্পীর সার্থকতা এখানেই যে, তিনি নিজের দর্শনকে কখনো বিক্রি করেননি। মনোজ কুমার বরাবরই বিশ্বাস করতেন, “আমার সিনেমা যদি কাউকে ভাবতে শেখায় — তবে সে সার্থক।”
৮০’র দশকের পর মনোজ কুমার ধীরে ধীরে পর্দা থেকে সরে আসেন। ততদিনে ভারতীয় সিনেমা পাল্টে গেছে। কিন্তু তিনি যেটা রেখে গেলেন, সেটা হলো এক অমলিন উত্তরাধিকার — দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের সিনেমা।
২০১৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান দেয়, এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার-এ ভূষিত করেন।
মনোজ কুমার ছিলেন না নিছক একজন হিরো। তিনি ছিলেন এক সমাজচিন্তক, একজন গল্পকার, একজন চিত্রনির্মাতা — যিনি চেয়েছিলেন সিনেমাকে ব্যবহার করে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে। তাঁর সিনেমা আমাদের শেখায়, দেশপ্রেম শুধুই জয় হিন্দ বলায় নয় — বরং তা রোজকার জীবনের দায়িত্বে, প্রতিবাদে, প্রশ্নে আর আত্মত্যাগে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ নানা রাজনৈতিক মোড়কে ঘেরা, তখন মনোজ কুমারের সিনেমা আমাদের মনে করিয়ে দেয় — দেশপ্রেমের আসল অর্থ কী।