দ্বিতীয় বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা ✦ গল্প
ঊর্ণনাভ
হৃষীকেশ বাগচি
(১)
ভারতের এক হারিয়ে যাওয়া পাখি হিমালয়ান কোয়েল। অনেকে বলেন এই পাখির প্রজাতি এখনও হারিয়ে যায় নি। হতে পারে পাহাড়ি জঙ্গলে এখনও গুটিকয় আছে। আমরা তার দেখা পাচ্ছি না। যে প্রজাতি একবার হারিয়ে যায় তা আর কখনও ফিরে আসে না। ফরেস্ট আউলেট এক পেঁচার প্রজাতি। বহু বছর না দেখা যাওয়ায় সবাই যখন ভেবেই নিয়েছিল তা হয়ত অবলুপ্ত হয়ে গেছে, আবার তাকে দেখা গেছিল সাতপুরার জঙ্গলে। অনেকেই বিশ্বাস করেন হিমালয়ান কোয়েলকেও আবার কোনোদিন ঠিক দেখা যাবে।
দেবব্রত সান্যাল একজন নামকরা পাখি বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার পাখি নিয়ে অনেক গবেষণাপত্র বের হয়েছে। ইদানিং অবশ্য তার তেমন কোনো পাবলিকেশন নেই। তাও প্রায় বছর পাঁচেক হতে চলল। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে দেবব্রত সান্যাল ফুরিয়ে গেছেন। আমাদের দেশে যা হয়। সফল মানুষদের লোকে দ্রুত ভুলে যাবার চেষ্টা করে। হেরে যাওয়া লোকের ব্যর্থতাকে নিজেদের অবসাদের মলম হিসেবে অনেকদিন ব্যবহার করে।
দেবব্রতর পক্ষে তাই নতুন কিছু না করলেই নয়।
অনেক বছর ধরে সে হিমালয়ান কোয়েলের হ্যাবিটাটের ওপর কাজ করছে। সে নিজেও বিশ্বাস করে তারা হারিয়ে যায় নি। উত্তরাখন্ডের স্থানীয় গাইডদের সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। একজন কিছুদিন আগে তাকে জানিয়েছে এমন এক পাখির ডাক সে কিছুদিন ধরেশুনছে যা আগে কখনও শোনে নি। এই কথা শোনার পর তার উৎসাহ হঠাৎ করেই বহুগুণ বেড়ে গেছে। সময় নষ্ট না করে বেশ কিছুদিন হল মুসৌরিতে এসে বসে আছে। গত সাতদিন ধরে গাইড পবন নেগির সাথে গভীর জঙ্গলে যাচ্ছে কিন্তু কোন আশ্চর্য কারণে সে আসার পর থেকে সেই পাখির ডাক আর শোনা যাচ্ছে না।
পবন আশা ছেড়ে দিলেও সে আশা ছাড়ে নি। তাই আজ সকাল হবার আগেই গাড়ি নিয়ে চেনা জঙ্গল ছেড়ে অন্য এক দিকে সে একাই বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তার ধারে জিপসিটা দাঁড় করিয়ে সে গলায় বাইনো আর পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে যদিও এখানকার জঙ্গল খুব ভালো চেনে তবু এইদিকের জঙ্গলে সে এর আগে কখনও আসে নি। ঘন্টা দুয়েক চলার পরে তার হঠাৎ মনে হল সে হয়ত পথ হারিয়েছে।
যে মুহুর্তে এই কথা মনে এল অজানা এক ভয় তাকে গ্রাস করল। এই জঙ্গলে লেপার্ডের সংখ্যা যথেষ্ট। কয়েকদিন আগেও এক মানুষখেকো লোকালয়ে ঢুকে একজন গ্রামবাসীকে মেরে খেয়েছে। এখনও তার সন্ধান পাওয়া যায় নি। গ্রামের লোকেরা লেপার্ডের ভয়ে রাতে ঘরের ভেতর গরু-বাছুর নিয়ে ঘুমোচ্ছে।
যদি সেই লেপার্ডটা হঠাৎ করে তার সামনে চলে আসে! জঙ্গলের মধ্যে পাখি খুঁজতে এসে সিগারেট ধরানো নীতিবিরুদ্ধ। তবু প্রচন্ড উৎকন্ঠায় সে একটা সিগারেট ধরালো। জঙ্গল এখানে এত ঘন যে সূর্যের আলোও ঠিকভাবে এসে পৌঁছচ্ছে না। প্রায় অন্ধকার। চারিদিকে এত শুকনো পাতা পড়ে আছে যে সে যে নিজের জুতোর ছাপ দেখে ফেরবার পথ ধরবে তারও কোনো উপায় নেই। বারবার মোবাইল বের করে টাওয়ার দেখতে লাগল। এই জঙ্গলে টাওয়ার থাকার প্রশ্নই নেই।
একটা বিরাট উঁচু সিডার গাছের নীচে বসে ও ভাবতে লাগল কী করা যায়। সে আর সামনে এগোতে চাইল না। একমাত্র পবন যদি তার খোঁজে এদিকে আসে তবেই তার পক্ষে উদ্ধার হওয়া সম্ভব। না হয় এই জঙ্গল থেকে বের হবার চেষ্টা করলে সে আরো গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যেতে পারে। জঙ্গলের এই এক রহস্য। অনেকে এক হপ্তা ধরে পাঁচশ মিটার বেড়ের অঞ্চলে বারবার ঘুরপাক খেয়ে মারা গেছে। জঙ্গল থেকে বেরোবার পথ খুঁজে পায় নি।
সে কী তাহলে মারাই যাবে? এখানে লেপার্ডের পেটেই যাক বা অনাহারে মারা যাক কোনো মৃত্যুই তার পক্ষে খুব আরামদায়ক নয়। সে যদিও সবসময় প্রার্থনা করেছে কোনোদিন কোনো এক পাহাড় বা জঙ্গলের কোলেই যেন তার মৃত্যু হয়। তা বলে এই চুয়াল্লিশ বছর বয়সে এমন একটা কষ্টকর মৃত্যুর কথা সে কখনও কল্পনাও করে নি।
মাত্র ঘন্টাতিনেক হয়েছে সে জঙ্গলে। এই সময়ে হঠাৎ এমন মৃত্যুচেতনা তার এল কী করে এটা ভেবেই সে খানিকটা অবাক হলো। এমন তো হতেই পারে কিছুক্ষণের মধ্যেই পবন তাকে খুঁজতে জঙ্গলের মধ্যে চলে এল। কিংবা এটা হয়ত গ্রামের লোকেদের চলারই পথ। কেউ কাঠ কাটতে এসে বা জড়িবুটি নিতে জঙ্গলে এলেই তার সাথে দেখা হতে পারে। অথবা সে একবার ফেরার চেষ্টা করলেই হয়ত রাস্তায় পৌঁছে যাবে।
তবু মৃত্যুভাবনা তার পিছু ছাড়ল না। সে শুনেছে মানুষ মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে। অনেকে তাদের চারপাশে কালো কালো অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পান। সে তার চারপাশে তাকালো। চারিদিকে এত আলো কম যে এখানে কেউ এসে দাঁড়ালেও তার ছায়া পড়া কঠিন। তবে তার মনে হতে লাগল এখনই কিছু একটা হবে। সে যেন কোনো কিছুর এক সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে। তার চারপাশের এই অরণ্য, এই অন্ধকারকে যেন অদ্ভুত এক মায়াময় জগৎ বলে মনে হল। তার মনে হল সে এমন এক জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে যেখান থেকে তার আর ফিরে আসার উপায় নেই।
এই ভাবনায় তার এমন এক আত্মমগ্নতা এল যে তার মনে হল তার সমগ্র অস্তিত্ব যেন আমিময়। তার পরিবার, প্রিয়জন, কাজের জগৎ, দুর্ভাবনা সব কিছু যেন হঠাৎ করেই অন্তর্হিত হল। আত্মচেতনার এক তীব্র ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে তুলল। কেউ যেন আড়াল থেকে কোন এক সম্মোহনী মায়ায় তাকে আবিষ্ট করে ফেলেছে।
এমন সময় দূর থেকে পাতা খসখস করার শব্দ শুনতে পেল। খুব ভারি কিছু একটা যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। শব্দ শুনে তার মনে হল এটি আর যাই হোক না কেন মানুষ নয়। আশ্চর্য! এই ভাবনায় তার একটুও ভয় লাগল না। খানিক পরে দেখল এক আধিভৌতিক জগতের বিরাট আকারের প্রাণী অনেকটা মাকড়শার মত দেখতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কালো বিরাট দুটো পুঞ্জাক্ষি তার দিকে নিবিষ্টভাবে চেয়ে আছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাকড়শা সে জানত আমাজন অরণ্যের গোলিয়াথ মাকড়শা। যে কিনা পাখি ইঁদুর এসব ধরে খায়। এই মুসৌরির বনে এত বড় মাকড়শা যে আদৌ থাকতে পারে এটা কল্পনারও অতীত। তার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে নি তো? সে ঠিক দেখছে তো? কতক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছে সে যেন ঠিকঠাক ভাবতে পারছে না। কেউ যেন তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভাবনাও আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এল। মাকড়শার চোখ থেকে সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। তার সব চিন্তা-চেতনা যেন ওই দুটো পুঞ্জাক্ষিতে আটকা পড়ে গেছে। সেটি যেন তাকে জালে ঘিরে ফেলেছে। সে বুঝতে পারল এ থেকে তার নিস্তার নেই।
চিন্তা বোধ যত আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকল তত তার মনে এক অপূর্ব প্রশান্তি জড়িয়ে আসতে থাকল। সে দেখল জঙ্গলের মধ্যে প্রচুর অর্কিড ফুটেছে। তার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রঙের প্রজাপতি। তার মনে হল সময় যেন চলছেই না কিংবা অসম্ভব ধীরে চলছে। এক লহমায় সে যেন তার চুয়াল্লিশ বছরকে একবারে দেখতে পেল। হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতি আশ্চর্য অনুপুঙ্খভাবে তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগল। সে যেন এক স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে। যে স্বপ্ন থেকে সে কিছুতেই জেগে উঠতে চাইল না।
কেউ যেন তাকে অবশ করার ওষুধ দিয়েছে। তার চোখের সামনের জগৎ তার চেনা জগৎ নয়। সে বুঝতে পারল এখন যে জগৎ সে দেখছে একেই যেন সে এতদিন ধরে দেখতে চাইত। অথচ দেখতে যে চাইত এটা আজই যেন বুঝতে পারল। তবে আগে কোনোদিন আদৌ ভেবেছিল বলে মনে করতে পারল না।
(২)
শরীরের বোধ চলে গিয়ে শুধু চেতনায় দেবব্রত আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। কতক্ষণ পার হয়েছে সে জানে না। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সময়ের বোধটাই তার চলে গেছে। সে যে অবয়বহীন এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবয়বের কথা বলতে গেলে একটা তুলনা আসে। অন্য কিছুর সাথে তুলনা। হাড় মাংস মজ্জা চামড়া এগুলো অস্তিত্ব। যা কিছু অস্তিত্ব তাই কোনো কিছুর সাথে তুলনীয়। তুলনারহিত অস্তিত্ব হয় না। দেবব্রত কিছুর সাথেই নিজেকে তুলনা করতে পারল না।
সেসময়ই তার নিশ্চিতভাবে বোধ হল সে মৃত।
তার চেতনা সত্তা স্বাধীন। মুক্ত। তবু সে যেন কোন এক ঘেরাটোপে আটকে আছে। সেখান থেকে সহজে বের হতে পারছে না। তার চেতনাই সম্ভত তার আত্মা। জীবাত্মা। তাহলে তার দেহ কোথায়? সেটা কি এখনও সিডার গাছের নীচে পচে গলে পড়ে আছে? নাকি পবন তাকে তার বাড়ির লোকের কাছে তুলে দিয়েছে? বাড়ির কথা মনে হতেই তার ছোট মেয়ের কথা মনে হল। স্ত্রীর কথা, মায়ের কথা মনে হল। তার মন বিষন্ন হয়ে উঠল। আত্মাও তাহলে সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে নয়।
কিন্তু তার দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও সম্ভবত আত্মার মুক্তি হয় নি। আত্মার মুক্তি কীভাবে হয়? নাকি তার দেহ পঞ্চভূতে মিশে যায় নি এখনও? তার মনে হল এটি সত্যি হলেও হতে পারে। মাকড়শা হয়ত তাকে গিলে খেয়ে তার দেহকে পরিপাক করে যে লালা তৈরি করেছে সেই লালা দিয়ে জাল তৈরি করে সিডার গাছে শিকারের জন্য ওঁত পেতে বসে আছে। তাই তার আত্মাও মুক্তি পায় নি। মাকড়শার মৃত্যু না হলে তারও মুক্তি হবে না। তার জাল ছিন্নভিন্ন না হলে তার আত্মাও মুক্তি পাবে না।
আত্মার মুক্তি বলতেই বা কী বোঝায়? তার আত্মা মুক্তি পেয়েই বা কোথায় যাবে? কেউ বলেছেন জ্ঞান না হলে আত্মার মুক্তি হয় না। কেউ বলেছেন আত্মাই নাকি জ্ঞান। এই জ্ঞান সম্ভবত ব্রহ্মজ্ঞান। তার তো এই জ্ঞান নেই। এই গুহ্যবিদ্যার শিক্ষাই সে কিভাবে পাবে? নাকি যতদিন এই জ্ঞান তার হবে না ততদিন তাকে এভাবেই এই সিডার গাছের আশেপাশে আটক হয়ে থাকতে হবে? কে তাকে এই শিক্ষা দেবেন? ব্রহ্মা? তিনি কোথায়? তিনি দেখতেই বা কেমন? কেমন বা তার কন্ঠস্বর?
এই মুহুর্তে তার জ্ঞান কতটুকু হয়েছে সে তাই নিয়ে ভাবতে লাগল। সে দেখল তার সময়ের বোধ চলে গেছে। সময় বলে যে কিছু আছে, তার অভিমুখ যে সামনের দিকে এই বোধটা তার চলে গেছে। সে সময়ের অঞ্চল ছাড়িয়ে এমন এক অঞ্চলে আছে যেখানে সময় নিয়ে কোনো উৎকন্ঠা নেই। তার দেহবোধ চলে গেছে। প্রেম ছাড়া আর কোনো অনুভূতিও যেন নেই। প্রেম আছে তাই বেদনার বোধও কিছুটা লেগে আছে। তার মনে হল সে বোধও আস্তে আস্তে চলে যেতে পারে।
প্রবল আমিময়তা তাকে ঘিরে আছে। অহং নয়, অস্মিতা। নিজেকে খুলে সে যেন সামনে মেলে ধরেছে। আর সমানে কিছু খুঁজে চলেছে। কাকে সে খুঁজছে? এই যে তার আত্মন্ আর চিন্তন্ অভিন্ন হয়ে গেছে সে তীব্রভাবে অনুভব করতে পারছে এই বোধটাই যেন আনন্দ। এই আনন্দের বোধ তার যত গভীর হচ্ছে তত সে যেন আরো মুক্তি অনুভব করছে।
তবে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর? এই যে অকাল মৃত্যু এ কী তার কর্মফল? কী এমন খারাপ কাজ করেছে সে যে তার জন্য তার অসময়ে এই মৃত্যু ঘনিয়ে এল? কী পাপ? সে যা করেছে তা খুব সাধারণ পাপ। সবাই করে। তার জন্য এই পরিণতি? তার তা মনে হল না। তার মনে হল মৃত্যুটা একটা র্যানডম ঘটনা। যা যে কোনো সময় যার তার কাছেই নেমে আসতে পারে। সে হয়ত নিজের অজান্তেই সেই কালচক্রের সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
এই যে পার্থিব চেতনা তার এখনও হারিয়ে যায় নি এটার কারণ তার জ্ঞান হয়ত এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। কিংবা এও হতে পারে তার আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণ তাকে পার্থিব জগতের দিকে বারবার ঠেলে দিচ্ছে। তার আত্মা সত্যিই যদি কোনো পরমাত্মার অংশ হয় তাঁর ইচ্ছা থেকেই একদিন যেমন তার জন্ম হয়েছিল, আজ তাঁর ইচ্ছাতেই সম্ভবত তার মৃত্যু হয়েছে। ইচ্ছা হতে হলে তো দেহ লাগবে। অবয়ববিহীন কোনোকিছুই ইচ্ছাধীন নয়। তবে পরমাত্মার কি রূপ আছে? তিনি যদি অরূপ হন তবে তার ইচ্ছাই বা হয় কীভাবে?
সে কী এখন কোনো পরমাত্মার অংশ নাকি সে নিজেই পরমাত্মা? তার মধ্যে এই যে অবিশ্বাস ঘনিয়ে উঠছে এই কী তার পাপ? তার অবিদ্যা? প্রশ্ন কি পাপ? হয়ত এটাই তার আত্মজ্ঞানের অনুশীলন।
এমন সময় তার মনে হল চারপাশে হঠাৎ যেন কিছু একটা দুলে উঠছে তীব্রভাবে। প্রচন্ড একটা শক্তি যেন সবকিছুকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। তারপর সব শান্ত। সমাহিত। সময় কত পার হয়েছে প্রশ্নই নেই। কারণ এখানে সময়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। এক কুসুমিত উষ্ণতায় ডুবে থেকে দেবব্রত ধীরে ধীরে ভুলে গেল সে দেবব্রত।
মা হিমালয়ান কোয়েল যখন বারো দিন একটানা ডিমে তা দিয়ে উঠে দাঁড়াল তখন দেখল ডিম ফুটে একটা ছোট্ট ছানা বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে ঠোঁট দিয়ে খোলস ফাটিয়ে তার বেরিয়ে আসা সহজ করে দিল। পেটের গলা নরম খাবার মুখে এনে খাইয়ে দিল।
হিমালয়ান কোয়েল হয়ত চিরতরেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর কোনোদিনই হয়ত তারা ফিরে আসবে না। যে সময় ছানাটির জন্ম হল তা বহুযুগ আগে। দেবব্রতর পূর্বপুরুষেরা তখন হয়ত সবেমাত্র মাটিতে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
অগস্ত্য যাত্রা
ঋত্বিক গঙ্গোপাধ্যায়
স্বর্গ সারথি কলেজ স্ট্রীট ক্রশিঙে বিচ্ছিরি জ্যামে ফেঁসে গেলো। সামনে বাসের পর বাস কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে,যেন সৈন্যদল। অঘোরবাবু খিস্তি করলেন। তার খিস্তি কেউ শুনতে পেলোনা। স্বাভাবিক। স্বর্গ সারথির ভেতরে যারা শুয়ে থাকে, তাদের আর্তনাদ বা উল্লাস করার দিন ফুরিয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। অঘোরবাবু এই রুটেই যাতায়াত করেছেন অটোয় চেপে,বাসে চেপে। খিস্তিটা তাই অভ্যাস বশত চলে এলো। বিড়ি খাবেন বলে হাতড়ালেন প্যান্টের পকেট। বিড়ি নেই। প্যান্টই নেই,তার জায়গায় খড়খড়ে একটা ধুতি। আর কিছুক্ষন পরে তিনি নিজেই বিড়ির মতো পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। খুবই দুঃখের কথা। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বৃষ্টি হবে আজ? বুকের ওপর দু পিস রজনীগন্ধার মালা,দুপিস শ্বেতপদ্মের চাকা। কবিতা টবিতা পড়া থাকলে তিনি হয়তো বলতেন – ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে।সেসব বালাই ওনার নেই। জীবনে কতোবার ফুল পেয়েছেন? ফেয়ারওয়েল,বিয়ে,পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকীর সেই আদিখ্যেতা…। বিয়ের আগে? সাঁওতাল পরগনা। কুরচি ফুল। ম্যানেজার সাহেবের বাংলো। সুরঞ্জনা। সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে।
ভালো থাকবেন অঘোরবাবু।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
আজ আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে বিকাশদা। বিকাশদা খুব ভালো। আমার এখানে থাকতে আর ইচ্ছে করেনা৷ বাবাটা মাতাল। মা মরে বেঁচেছে। কাকু কাকীমা সংসার জবরদখল করেছে। আমি এখন ফালতু। বিকাশদার সঙ্গে আমার চক্কর চলছে। ওকেই বিয়ে করবো। খুব আদর করে,খুব ভালোবাসে। মোবাইলে অসুব্য অসুব্য কথা লেখে। হি হি। মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হয় যায়। ওর নাকি কাপড়ের ব্যবসা। মুম্বাই আমেদাবাদ আরো সব কোথায় না কোথায় যায়। ওর বাড়ি পাশের গাঁয়ে। আমি যাইনি এখনো। বিকাশদার মা নাকি বিয়ে মানবেনা। কোই বাত নেই, পালিয়ে যাবো। বিকাশদা বলছে মুম্বাইতেই ঘর বাঁধবে।ভালো তো। আমার এখানে আছেই বা কি? কাছের লোক কেউ নেই। বন্ধুও নেই। অনেক অনেক শাড়ি পাবো। লিপ্সটিক নেলপালিশ। কি মজা। বিকাশদা,আমায় নিয়ে যাও। বিয়ে করো। ভালোবাসো। ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তো? হারিয়ে যাবেনা তো? হাত ছেড়ে দেবেনা তো?
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
সেনাপতি ঘেন্নায় মুখ টুখ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো একটা মাংসপিন্ডের দিকে৷ নারকেল গাছের শিয়রে তখন হাওয়া দিচ্ছিলো শনশন। নদীর ঘাটে নৌকোর গলুই ঘা মারছিলো ঠকঠক শব্দে। ও কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিলোনা। অনিদ্রায় লাল দুটো চোখ একভাবে তাকিয়ে ছিলো। সেনাপতির বউ গুমরে গুমরে কাঁদছে আর ওটার ওপর একটা হাত আলগোছে রেখেছে। ড্যালাটার হাত পা মুখ আছে। এবং হ্যাঁ,যোনি আছে।
– আবার একটা। আবার!!!
– আমি কি করবো?
– শালার বারোভাতারি। সবার আগে তর গলা টিপে মারতে ইচ্ছা যায়।। তারপর ওটাকে গাঙের জলে…
– হাউ হাউ হাউ হাউ…
রাতের আকাশে আবছা লালের পোঁচ পড়ছে। ড্যালাটা নড়াচড়া করছে বারবার। এক্ষুনি ট্যাঁট্যা করবে। অসহ্য! সেনাপতি জান্তব ক্রোধে ওটাকে পাকড়ে ধরে। বউ আর্তনাদ করে ওঠে। সেনাপতি তার সন্তানের মুখের দিকে বিতৃষ্ণা ভরে তাকায়। চমকে ওঠে। ওর চোখদুটো মায়ের মতো না?
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে এক বৃদ্ধার দেহ ভেসে গিয়েছিলো। কেউ জানেনা কি ভাবে ছোবল মেরেছিলো মৃত্যু। নদী কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। সেনাপতি থরথর করে কাঁপতে থাকে। তারপর একছুটে উধাও হয়ে যায়।
উদ্যোগ পর্ব
বনমালী মাল
আটপৌরে কাপড় গায়ে জড়ানো। আলুথালু। পাড়ার সব মা বউয়েরা জল ছড়া দিচ্ছে উঠোনে। হাঁটু গেড়ে এক এক ছায়ামূর্তি যেন। তিন ছি শাঁখ বাজে। ঝাঁঝের ঢং ঢং ধ্বনি অনুরণন তোলে পাড়া থেকে পাড়া। দুরন্ত ছেলেমেয়েরা চুপ হয়ে গেল। নিশ্চলও।
বড়দের সাবধান বাণী —
“শাঁখ বাজলে কথা বলতে নেই।”
তারা গুটিসুটি এসে বসে ঘরের কোণে কিংবা কারো আঁচল ধরে। সন্ধ্যা নেমে এল শাঁখের শব্দ বেয়ে। তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলে উঠল।
সলতে পুড়তে পুড়তে সন্ধ্যা নেমে যায় আরো গভীরে। ঘরে ঘরে নিস্তব্ধতা জাঁকিয়ে বসে। লোককথা রূপকথার আসর বসে সুখী গৃহকোণে। দাদু ঠাকুমারা কচি-কাচাদের নিয়ে ব্যাঙ্গামা ব্যাঙ্গমির ছবি সাজায়। শিশু মনে পক্ষিরাজ ভেসে বেড়ায় ওই ভর সন্ধ্যায়ও সোনালী রঙের আভা ছড়িয়ে। একই গল্প তবুও কানে আসে একমনে হাত চলতে থাকা বাড়ির মেয়েদের, মা-কাকিমাদের। তারা বোঝে এসবের কিছু কিছু মানে। অন্ধকার আবডালে শৈশব তাদের কাছে একটু সময়ের জন্য ঢুঁ দিয়ে যায়। বাটনা বাটা হলুদ জল দেখে তাদের কারো কারো মরিচার স্মৃতি কাটে। আসরে ওঠে সেই যক্ষের কথা। যারা পূর্বপুরুষদের কাল থেকে পুকুরের ভারী জল মেখে ডাঙায় উঠে আসে। রাতের কালো মাখা একটা কলসীদেহ নিয়ে ছোটো ছোটো পা বেয়ে চলাফেরা করে কপালজোরের ভিটায়। দাগ রেখে যায় হাঁ ফাটলের। এই ফাটলের আশায় বসে থাকে প্রতি ভিটে। প্রতি জন্ম। একদিন চোখে দেখতে পাবে এই আতুরতায়। যক্ষের কথা শুনে সেঁধিয়ে যায় ছেলে-মেয়েরা। শরীর আর মুখ লুকোয় অন্ধকারের পটে। গৃহিণীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে কাজে আনমনা হয়ে ওঠে। খালি একটা শাঁখা আর লোহার বালায় ঠনঠনে হাতের দিকে তাকায়। চোখের কোণে উদাস ছায়া পড়ে পুরুষদেরও। ক্লান্তি আর নীরবতা ভেঙে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কোনো কোনোদিন সেই কালো শামুকের কাহিনী ভাসে ঘরের বদ্ধ বাতাসে। যে কিনা পুকুরের ডুবে থাকা চান বেয়ে গুটিগুটি বেরিয়ে আসে জ্যোৎস্নার নরম আলোয়। চাঁদ খেতে খেতে আনন্দে ভরে যায় তার খোলকের আত্মা। ঠাকুমা কিংবা দাদু বলে, এদিকে তারই অজান্তে বধ্যভূমি প্রস্তুত হচ্ছে। কোনো সতর্কতা ছাড়াই সে আক্রান্ত হতে পারে। নিস্তব্ধ এক শাদা মৃত্যু শিকারিকে শান্তি দিয়ে লুটিয়ে পড়বে কোনো অভিযোগ ছাড়াই।
আসরের মাঝে সবাই যখন মশগুল। সন্ধ্যা যখন পেট ভারী করে হামাগুড়ি দিচ্ছে আরো গভীরে তখন হঠাৎই ছেদ পড়ে আসরে। এক আচমকা অপ্রত্যাশিত শব্দ অসময়ে সবাইকে আছাড় দিয়ে যায়।
শাঁখ বাজছে এলোমেলো!
অসময়ে!
ছি-এর পর ছি!
আঁঠালো একটা জগৎ থেকে হিঁচকা টানে বাইরে বেরিয়ে আসে সকলে। ছেলে মেয়ে বউ বুড়া সব্বাই। প্রবীণ যারা, তারা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনুমান করে নিতে পারছে
জলকম্প…
সবাই ছুটছে পুকুরের দিকে। ঘর ঘর এসে ভিড় করে পুকুরের পাড়ে।
জলকম্প!
আরো শাঁখ বের হয়। ধ্বনি ওঠে সার দিয়ে… পুকুরের ওপর নুয়ে পড়া বাবলা গাছটার পেটে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জল বাজছে। যক্ষের ভয় কাটিয়ে শিশুরা নতুন উত্তেজনায় মেতে ওঠে। প্রবীণরা জানে এই জলকম্প মাঝে মাঝেই হয়। কাউকে না জানিয়ে। আচমকা। সেই কালো শামুক কিংবা যক্ষ যারা জলে ডুবে থেকে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। এ হয়তো তাদেরই করা-ধরা। তবে ভয় তারা কেউই পায় না। নৈমিত্তিক সাধারণ পাঁচটা ঘটনার বাইরে হলেও, শাঁখ বাজালে থেমে যায়। তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। এখন জলের দুলুনি দেখতে দেখতে তারা চোখে চোখে মায়া ছড়ায়। চাঁদের আলো জলের ওপর ভেঙে খান খান হয়ে পড়ছে পাড়ের কাদা কোলে। উথাল পাথাল।
সরু সরু কতগুলো রাস্তা এসে মিশেছে রাজপথে। প্রতিটা সরু রাস্তা থেকে অগণিত মানুষের ভিড় রাজপথকে অন্ধকার করেছে। তাদের পায়ের ধুলো আর মৌন দীর্ঘশ্বাস আবছায়া করে রেখেছে অন্য লোকজন আর গাড়ি-ঘোড়াকে। কারো মাথায় পাগড়ি। কারো গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি। ভিড় করে তারা চলেছে রাজধানীর দিকে। তাদের মাথার চুলে আটকে আছে ভুয়ো-পেট ধান। খড়ের শিস। গম-গাঁথা মালা কেউ কেউ পরে আছে গলায়। কত কাদা মাখা পা থেকে ঝুরঝুর ক’রে ঝরে পড়ছে ঝুরা মাটি। কী ভার সে পায়ের, রাজপথ জানে কেবল। শত শত কৃষক শ্রমিক জানে শুধু, কী সুখ পোয়াতী ধানের গন্ধে। নির্বল বিকিয়ে যাওয়া শস্য জানে, আধপেটা চাষীর আঁতের দুঃখ।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সবার অজান্তেই দুলছে। লালকেল্লা চারমিনার আর কুতুবমিনারের ধাতব গঠন আলগা হচ্ছে। সবার অলক্ষ্যে গোটা পৃথিবী দুলছে। কিন্তু কেউ তলিয়ে দেখছে না সহস্র পায়ের দাপিয়ে বেড়ানো রাজপথ আর তার আবছায়া। সবথেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার, যে লোকটা গোর্কি পড়ছিল বুঁদ হয়ে, একান্তে, তাকিয়ে দেখল আবার পড়তে শুরু করল।
একটি যুবক ছেলে টেরিতে আঙুল চালিয়ে এখুনি গোল মুখ করে একটা কুন্ডলিত ধোঁয়া ছাড়ল।
একজন শিক্ষক তার ছাত্রীকে শাস্তি দেওয়ার নাম করে নাভি মাপছে।
নেতার ভাষণবাজিতে হাততালি গুনছে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা মোসায়েব।
অথচ, সবার অলক্ষে রাজপথের পায়ের ধুলো এক উন্মত্ত ষাঁড়ের মত ধোঁয়া, নাভি আর হাততালিকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। গর্ত বুজিয়ে নতুন করে একটা কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করছে।
কাতারে কাতারে বাস দাঁড়িয়ে আছে আটকে। এক এক জানালা থেকে এক একরকম মুখ আর ভাব উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে বিরক্তি। কেউ উদাসীন। কেউ বুঝি মজা পাচ্ছে প্রশাসন আর মিছিলের দ্বন্দ্বযুদ্ধে। একটা বহুতল অট্টালিকার জানালার শার্সি একটা মাত্র মুখ নিয়ে রাজপথের দৃশ্য গিলতে থাকে। তার কপাল আর ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হতেই সেই জানালায় মুখের পর মুখ ভিড় করতে থাকে। সারা রাজপথ জুড়ে ব্যানার। আকর্ষণীয় রঙ দিয়ে মানুষের চোখ টানছে। কেউ দেখে। চোখ ফিরিয়ে নেয়। কেউ আটকে থাকে রঙের মায়ায়।
“এক কদম স্বচ্ছতা কি ঔর”
একদল ভিখিরি সেখানে ময়লা হাত পেতে ভিক্ষা করছিল বলে প্রশাসনের তরফ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“পঢ়েগা ইণ্ডিয়া তো বঢ়েগা ইণ্ডিয়া”
জলবায়ু আর দাবানলের সম্পর্ক বোঝাতে বোঝাতে এক রিক্সাচালক টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোট টাই পরা এক বাবুকে।
“আপনার লিঙ্গ সরু! ছোটো! বাঁকা! আমাদের কবিরাজি ঔষধ আপনার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একশ শতাংশ কাজ করবে। পরীক্ষা করে দেখুন”
ব্যানারের ওপর কতগুলো রোদের ছায়ামূর্তি। কাউকে পরোয়া না করেই কালো কাপড় ঢাকা দিয়ে একটা মেয়েকে তারা তুলে নিয়ে গেল। আবার ফেলে যাবে পরীক্ষা শেষে।
কাল সন্ধ্যায় যে জলকম্প শুরু হয়েছিল, তার রেশ এখনো আছে। ভোর আসার সাথে সাথে শৈশব এসে জুটেছে পুকুরের পাড়ে পাড়ে। কাঁচা রাস্তাটা টাল সামলাতে সামলাতে চলে গেছে পাড়া থেকে পাড়া থেকে গ্রামে। ষাটোর্ধ শরীরটাকে রাস্তায় এনে দাঁড় করায় বুধুলাল। একটু হাঁপিয়ে নেয়। হাঁটু লুঙ্গি আর খালি গায়ের যে ছায়া পড়েছে, তাতেও বুধুলাল বেশ শক্ত সবল। দিন দিন খাটুনির চিহ্ন তার পেশী আর চোয়ালে। সে এখন এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশের মুদি দোকানটার দিকে।
–পঞ্চাশ তেল দে দিকি…
–জাগা আনছ?
–নাহি লায়া বাপ…
একটা পুরনো বোতল খুঁজে তেল দিয়ে বুধুলালের সামনে রেখে দোকানি বলে–
–আট টাকা।
–কত!
আকাশ থেকে পড়ার কথা শুধু শিক্ষিত আর অর্থবানরাই বলতে পারে। বুধুলাল পারে না। জানে না। সইতেও পারে না। শুধু চোখের দুপাশের চামড়া কতগুলো ভাঁজ হয়ে ফর্সা আলো আসতে বাধা দিচ্ছে।
–সেদিন আর নাই কাকা… জিনিসের দাম আগুন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
রাস্তার দুপাশে ফাঁকা মাঠের খোঁচা খোঁচা নাড়ার দিকে চেয়ে থাকে বুধুলাল। কয়েকদিন আগেই ধান কাটা শেষ হয়েছে। বক আর শামকলের ঝাঁক সন্তর্পণে পা ফেলে নাড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা পোকা ধরে খাচ্ছে। দোকানীর শেষের কথাগুলো বুধুলালের চিন্তাকে কাটতে পারল না। ডুবে ডুবে সে এখনো কী সব ভেবে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়েই লুঙ্গির ট্যাঁক থেকে মুড়ে যাওয়া ময়লা একটা দশ টাকার নোট বের করে দোকানীর হাতে দেয়। রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করে। ধাপানো শরীর। দৃষ্টি নীচু। এবড়োখেবড়ো মাটিতে চঞ্চল নয়। তার চোখ স্থির চিন্তায়।
–কাল থেকে আরেক পালি কাজ বেশি করতে হবে…
মনে মনে উচ্চারিত এই কথাটির সুর ধরে সূর্যের আগুন ঢাকা পড়ে একটা আধ খাওয়া রুটির মত মেঘে। পুকুরের ঘাটে ভিড় করে আছে ছেলে-মেয়েরা। কুটো খড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে জলের ঢেউয়ে। কেউ চেটো ছুঁইয়ে রাখছে জলের পিঠে। মাথা নাড়িয়ে ঢেউ ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চেটো।
পাড়ার লোক প্রতিবার ভোট দেয় দীনুকে কিংবা দীনুবাবু যাকে বলে, তাকে। এই যে হাত তিনেক কাঁচা রাস্তা, এটা ত দীনু বাবুরই প্রসাদে। পাড়া থেকে গ্রাম থেকে গ্রাম ছাড়িয়ে দীনুর প্রতিপত্তি। সবাই বলে, দীনু না থাকলে আমরা বেজান নাড়া হয়ে পড়ে থাকতাম। মাঠ থেকে ফোলা ফোলা ধান ঘরে আসা কিংবা ধান বিক্রির ওজন এবং দর কষাকষি সবজায়গায় দীনুর ছায়া পাক খায় যক্ষের ভাবনার মতন।
দীনু থাকতে কেউ মোদেরকে ঠকাতে পারবেনি…
শিরিষ পাতা লেপ্টে আছে চাঁদের গায়ে। জ্যোৎস্না খচা খচা নাড়ার বুকে বুলিয়ে দিচ্ছে তার নরম হাত। এই জ্যোৎস্নার প্রান্তরে কালো শামুক তার ডানা মেলবে। বধ্যভূমি প্রস্তুত হবে হয়তো কাছে পিঠেই। দীনু সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় পাড়ায় আসে। গল্প করে। সময় কাটায়। আজ জলকম্প নিয়ে সবার মনে একক উত্তেজনা। দীনুকে মধ্যমণি করে তাদের চোখে সমীহ জাগানো নরম চাউনি। আজ তারা জলকম্পের বিষয়ে জানতে চাইবে। বুধুলালও এসে বসে এককোণ অন্ধকারে। কেবল দীনুর সারা শরীরে একটা মৃদু হলদে আলোর প্রলেপ ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে একজন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মেখে সেই সুরেই কাদা কাদা হয়ে এই দীর্ঘ জলকম্পের রহস্য জানতে চাইবে, এমন সময় নির্জীব নাড়ার স্থির হাঁ মুখ থেকে একটা কচি ঘাস বেরিয়ে আসার মত বুধুলাল বলে ওঠে–
জিনিসের দাম দিন দিন এমন বাড়ছে কেন কত্তা বাবু!
গোটা আসরে যেন এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা জাঁকিয়ে এল। সকাল থেকেই বুধুলালের মাথা ঝিম হয়ে ছিল। এখন এই প্রশ্নটি করে সে তার অসুখ হয়তো ছড়িয়ে দিতে চাইছে আসরসুদ্ধ সবার মাথায়।
বাবলা গাছের তলপেটের খোঁদলে পুকুরের জল এসে তালি দিচ্ছে। নীরবতার নীচের সুর ক্রমে ভাঙতে থাকে। কালো শামুকটা উঠে এসেছে চান বেয়ে। নরম ভিজে মাংস মেলে দিয়েছে চাঁদের আলোয়। চকচক। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আছে একটা কুকুর। রুগ্ন। খিদে-পেট। ক্লান্ত। চোখের পর্দায় খেলে যায় চকচকে নরম মাংস। খাদ্য অখাদ্য ভুলে এগিয়ে আসছে একটা খিদে। শিকারি। থাবার ভেতর নখ লুকোনোর কোনো তাগিদ নেই তার। মাটিতে নখের চিহ্ন এঁকে একটা বধ্যভূমি ছবি হয়ে ফুটে উঠছে।
নীরবতার উপরের সুর খান খান ভেঙে পড়ে ফাঁকা মাঠের শেয়ালগুলোর চিৎকারে। এতক্ষণের হিম পাংশুটে দীনু মুখ উঁচু করে প্রত্যয়ী স্বরে বলে…
এই স অ অ ব বিরোধীদের চক্রান্ত…
অবুঝ অথচ দূরভেদী আলোর মত আসরের সকলে দীনুর দিকে ঝুঁকে বসে। যেন একটা মায়াময় পালা শুরু হওয়ার আগে ভক্তরা পালক হতে চাইছে।
শেষ রাতে ওরা রাজধানীতে। একটা একটা হাঁটু ভেঙে ভেঙে বসে পড়ে রাজপথে। ক্লান্ত শুকিয়ে যাওয়া মুখ। তবুও অনেকগুলো অনাগত কালের কালো ছায়া লক্ষ্য করে তারা থেকে থেকেই মুখের আব তুলে থুতু ফেলছে। তাদের চোখের দৃষ্টি অমোঘ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি ব্যারিকেড আর জলকামান লজ্জা পাচ্ছে সেই চাউনির তীক্ষ্ণতায়। রাজধানীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা মরা গাছে ভিড় করে বসেছে কাক। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। পচা গলা কোনো ব্যবস্থা ন্যাঙটো হলেই তারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নগরে নগরে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে —
“আপনারা কেউ প্ররোচনায় পা দেবেন না। এই চক্রান্তকে বিফল করতে প্রশাসন সদা তৎপর।”
সকাল হতেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পাড়া। জলকম্প নিয়ে ছেলে-মেয়েদের আর সেই উৎসাহ নেই। কেবল দু’ একজন মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় চেপ্টে যাওয়া নাড়াগুলো। পাড়া ঝাঁপিয়ে লোক যাচ্ছে দেখতে। কাল অব্দি চখা চখা নাড়াগুলো এক রাতেই লেপ্টে গেছে মাটির সঙ্গে! সঙ্গে সঙ্গে একটা সিদ্ধান্তে এসে তারা আশ্বস্ত হল —
“অজস্র কালো শামুক কিংবা যক্ষ কাল সারারাত ধরে হেঁটেছে জমি জুড়ে!”
শুধু বুধুলাল সবার মধ্যে দাঁড়িয়েও, চোখ-মুখ আর মনে একটা পচা কালো শামুকের খোলক আর না-আঁকা যক্ষের কালি দিয়ে অন্য পালার মঞ্চ এঁকে চলেছে।
পলিপড
সৌগত বালী
আমাদের নিবিড় গুলো প্রকারেণ চুষে নিচ্ছিল সেখানে জানলা। হাইপার চাঁদ তার প্রোটোকল ভাঙতে সেভাবে ডুবে যায়। ভোর হল কিনা নালক জানেনা হাই গো ওভেনে ফুটছে গাঢ় হচ্ছে এসব শুখ্নো পাতাদের ঘ্রাণ যেন চা বাগানের চিতার কামড়ে ছিটকে যাচ্ছিল এক ছটাক রক্ত তার শুখা গন্ধ নাকি চিতার ঘনিষ্ট বাস ছাড়ছে। নালক কী যে দূরদূরান্ত আঘ্রাণ পেতে পারে তার যোগ্যতার খামতি নেই। এগারো সালে সে এমন একটা গন্ধ পেয়েছিল রাজ্যজুড়ে বমি উঠে আসত । কেন সে বেসিন ভাসাচ্ছে । কেন যে তার আপার কাসপিড পোকারা বেরিয়ে এসে খাবারে স্তূপ করছিল সে কথা বোঝাটা কষ্টকর ছিল মোহরীণার। পরে অবশ্য সে দেখেছিল গোটা রাজ্যময় ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। কীসব উল্লাস !
এত বছর পর আবার বেসিনে যেন হেগে রেখে দিচ্ছে নালক । এ কেমন ঘ্রাণ ! একী সত্যি ছিল । আমরা কি তাহলে হিপ্নাগগিক হয়ে যাচ্ছি?
নালক তখন কথা বলার কথায় ছিল না । এবার কি তাহলে পোকার এই আপাত বর্ষায় ফুলে ঢোল হতে হতে ফিরে যাবে। আমরা ওভেনে জ্বেলে দেবো বা ছাদে কিছু প্রদীপ । বরং সেতো দীপাবলী হোক কিবা দশেরা কী যায় আসে। নালক খাবার সেরে উঠে যাচ্ছিল একটা তীক্ষ্ণ আয়নার দিকে। একবার চেক করে দেখা যাক কাসপিডের গর্তটা চলে গেছে সেখানে তো সিরো কিউমুলাস মেঘ । একেবারে পেঁজা তুলোর মত পাউরুটি ছিড়ে রাখছিল মোহরীণা। এবার সে রোদ্দুর থেকে নেমে এসে তার সারাদিনের শুকিয়ে আসা জামা কাপড় নিয়ে আবার ওয়াশিং মেশিনে ফিরে যাবে একটা জলের ঘূর্ণি । ওটা টেনে নিয়ে যায় আরো নিচতর তলদেশে সেখানেও পোকাদের বাড়বাড়ন্ত এই হীন বর্ষায় ফুলে ফেঁপে … জানলাটা আটকে গেছে। ভিজে গেছে । ভিজে একেবারে সপসপে।
মোহরীণা আরো ঘুর্ণনের ভেতরে ভেতরে সাগরে চলে আসে তা ক্যাটামেরন প্রবল গতি জলে তাহিদির সুবাস ম ম করছে। আরো পোকাদের ভীড় বাড়ছে আয়নার সামনে তীক্ষ্ণতর নালক।
এত বছরেও তাহিদির কথা মনে পড়ে তোমার। তবে তো সে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ দূরতম।
টিভি অন করে বসে পড়ে মোহরীণা । এখন তার রাত বাড়ছে। নালক বেসিন ভাসাচ্ছে ও তার গোঙানি । এভাবে রাত ভোর চলছে। পোকাদের উল্লাস বাড়ছে । তাদের লিপিড প্রোফাইল তাদের হুইলচেয়ারে এগিয়ে যাওয়া তাদের সারিবদ্ধ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত আমরা বরং ওভেনে জ্বালিয়ে রাখি।
মোহরীণা বলল এগারো বা বাইশ লিনিয়ার। এগারোর সঙ্গে দুই গুণ করলে বাইশ। আবার বাইশ আর এগারোর অন্তর করলে … আমাদের এগারো বা বাইশ বছর আগে দেখা হয়নি।
এই হিপ্নাগগিক রাত । মোহরীণা কাসপিডের গর্ত দিয়ে নিচে নেমে একবার দেখবে ভাবছিল আরো কত নিচে নেমে যেতে পারে পোকারা।