তৃতীয় বর্ষ ✦ প্রথম সংখ্যা ✦ গল্প
মাথুর
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
সহযাত্রী
চন্দন ঘোষ
দুটো অনুগল্প
নিলয় সমীরণ নন্দী
১. শান্তাবুড়ি
বোসেদের পুকুরের ঠিক উত্তর পূর্ব দিক জুড়ে বাঁশ বন। পশ্চিমে খেলার মাঠ আর গ্রামের অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। দক্ষিণ দিক বরাবর একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার অপর দিকে চাষের জমি। পৌষ সংক্রান্তি চলে গিয়ে মাঘ মাসের শীত জাঁকিয়ে পড়েছে গ্রামে। ফলে ক্ষেতের ধান সব কাটা হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় শূন্য জমি চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেয়। মনে হয় যেন দিগন্ত বিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ। পুকুরের যে দুই দিকে বাঁশ বন, তার পাশ দিয়ে আঁকা বাঁকা আলপথ একটা কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। শান্তাবুড়ির কুঁড়েঘর। সাতকুলে তার কেউ নেই। বয়স একশো ছাড়িয়েছে। চোখে প্রায় দেখে না বললেই চলে। মাজা সম্পূর্ণ ভাঙা। গ্রামের মানুষের বিভিন্ন রোগে মন্ত্রপুত জলপড়া দিয়ে, ঝাড়ফুঁক করে, বাড়িতে বানানো বড়ি বিক্রি করে, বাচ্চাদের জন্য কাঁথা সেলাই করে, কোনো রকমে দিন চলে যায় তার। পুকুর পাড়ের শাক, লতা পাতা, এর ওর বাগানের সবজি, এসব দিয়ে তার একবেলা যা হোক করে ঠিক দুটো ভাতে ভাত জুটে যায়। রাতের বেলা শুধু মুড়ি চিনির জল। তবে মাঝ রাতে ফসল পাহারা দিতে গিয়ে, ভরা পূর্ণিমাতে কেউ কেউ নাকি দূর থেকে অস্পষ্টভাবে দেখেছে, সাদা কাপড় পড়া কেউ একজন শান্তাবুড়ির কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে, পুকুরের জলে হাত ডুবিয়ে জ্যান্ত মাছ তুলে তুলে, পাড়ে বসে কাঁচা কাঁচা খাচ্ছে। আর সেই সাদা কাপড় পড়া মানুষটাকে ঘিরে একপাল শেয়াল কুকুর তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে। তো এই শীতেরই এক ভোরবেলা গ্রামবাসী ঘুম ভেঙে দেখল, সেই শান্তাবুড়ির লাশ পুকুরের জলে ভাসছে। আর তার চারপাশে অজস্র মরা মাছ ভেসে আছে। সূর্যের আলো পড়ে, সেই রূপালী মাছের আঁশগুলোকে একসাথে একটা বিরাট আয়নার মতো দেখতে লাগছে। গ্রামের মানুষজন দিন থাকতে থাকতেই সবাই মিলে পুকুর থেকে শান্তাবুড়ির মৃতদেহ তুলে কাছের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে, নিয়ম আচার মেনে তার সৎকার করলো। চাঁদা তুলে ঘাট কাজ, শ্রাদ্ধ শান্তি, নিয়মভঙ্গ, সে সবও মিটল। কিন্তু এরপর থেকেই গ্রামবাসীরা একা একা পুকুর পারে বা বাঁশ বাগানে যেতে ভয় পায়। ছেলেমেয়েরা স্কুল ছুটির পর, সোজা ওই চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে আসে যত দ্রুত সম্ভব। বিকেলের পর থেকেই শূন্য খেলার মাঠ, পুকুর পার, বাঁশ বন, সব খাঁ খাঁ করে। দত্তদের বাড়ির সেজ ছেলে সুভাষ শহরে কাপড়ের মিলে কাজ করে। সদরে সাইকেল রেখে, সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করে সে প্রতিদিন। কাজ সেরে সদরে ফিরতে ফিরতে সেই রাত আটটা নটা বাজবেই সুভাষের। তারপর সাইকেল করে বোসেদের পুকুরের পাশ দিয়ে, বাঁশবন পেরিয়ে, যখন সে বাড়ি ঢোকে, তখন গ্রামের মানুষজনের এক ঘুম হয়ে গেছে প্রায়। পুকুর পার দিয়ে আসার সময় প্রতিবারই সুভাষের বুকটা একটু ছ্যাঁত করে ওঠে। কিন্তু সে শান্তাবুড়ির কুঁড়েঘরের দিকে ভুলেও তাকায় না। মনে মনে ইষ্টনাম জপ করতে থাকে। কিন্তু আজ হঠাৎ পুকুরের সামনে আসতেই তার সাইকেলের চেনটা গেলো পড়ে। পিঠের ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট বের করে সাইকেল থেকে নেমে চেনটা ঠিক করতে যাবে, সহসা তার চোখ চলে গেলো শান্তাবুড়ির কুঁড়েঘরের দিকে। চাঁদের আলোয় সে দেখল সাদা শাড়ি পরা একজন পুকুর পারে বসে বসে তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। চোখের মণি দুটোয় যেন তীব্র লাল আগুন জ্বলছে। সুভাষের হাতের টর্চটা তখনই মাটিতে পড়ে নিভে গেলো। সে হাজার চেষ্টা করেও সেই বীভৎস চোখের থেকে নিজের চোখ সরাতে পারছে না। পড়িমরি করে সাইকেল ফেলে সুভাষ দৌড়ে পালাতে যাবে, এমন সময় একটা বিরাট লম্বা বাঁশ গাছ তার সামনে আড়াআড়ি এসে পড়ল। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, পুকুর পার থেকে ভয়ংকর এক হাসির শব্দ ধীরে ধীরে তার কানের কাছে এগিয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকে পাড়া গাঁয় সে অনেক ভূতের গল্প শুনেছে। এরকম সময় বাঁশ ডিঙিয়ে যাওয়া মানেই, ভূতে তোমাকে সোজা বাঁশে করে ওপরে তুলে নেবে আর নীচ দিয়ে যেতে গেলেই মাথায় এসে সজোরে পড়বে সেই বাঁশ। দরদর করে ঘামছে সুভাষ, কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে জানে এই সময় পিছনে ফিরে তাকালেই, ভূতে তার ঘাড়খানা টুকুস করে মটকে দেবে। সময় বয়ে চলেছে, সুভাষ প্রাণ হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝে। ইষ্টনাম জপ করতেও ভুলে গেছে সে। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে সুভাষের। ঠিক সেই সময় বাঁশ বনের ভিতর দিয়ে শান্তাবুড়ি তার সামনে এসে দাঁড়াল এবং শান্ত গলায় বলল,
শান্তাবুড়ি- “ভয় নেই সুভাষ, বাঁশ ডিঙিয়ে তুই ঘর যা। ওই মেছো পেত্নী তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি যখন বেঁচে ছিলাম, মাঝ রাতে ক্ষেত পাহারা দেওয়া চাষীদের তখনও ভয় দেখাতো ওই পেত্নী। কিন্তু আমার জন্য এতদিন কারোর বড় কোনো অনিষ্ট করতে পারেনি। আমাকে জলে ডুবিয়ে মেরে, ভেবেছিল এবার যা ইচ্ছা তাই করবে। কিন্তু আমি তা হতে দেবো না।“
সুভাষের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে আর কিচ্ছু না ভেবে, দিলো মরণপণ এক ছুট। বাড়ির দরজার কাছে এসে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। পরদিন গ্রামবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল শান্তাবুড়ির সেই গল্প। এখন আর বাচ্চারা ভয় পায় না মাঠে সন্ধ্যে পর্যন্ত খেলা করতে। বোসেদের পুকুরকে লোকে আজকাল শান্তাবুড়ির পুকুর বলে ডাকে।
২. লেডিস্ হোস্টেলের একটি রাত
সানি অনেক কষ্টে জিকোকে আজ রাজি করিয়েছে। আসলে যতই মুখে বড় বড় কথা বলুক সে, এইসব কাজে সঙ্গে কেউ একজন থাকলে একটু ভরসা পাওয়া যায় আর কি। কলকাতা শহরের বুকে এই ছয় তলা লেডিস্ হোস্টেলটির, খাতায় কলমে বয়স কম করে প্রায় ষাট বছর তো হবেই। ব্রিটিশরা আজ থেকে দেড়শো বছর আগে এই বিল্ডিংটা তৈরি করেছিল। তখন এখানে ইংল্যান্ড থেকে আসা রাজ প্রতিনিধিরা থাকতো। স্বাধীনতার পরে বেশ কিছু বছর বাড়িটা বন্ধ অবস্থাতেই পড়েছিল। কিন্তু পরে সরকার থেকে এটাকে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কর্মরত মহিলাদের জন্য, নাম মাত্র থাকা খাওয়া খরচে, একটা লেডিস্ হোস্টেলে পরিণত করে দেয়। এর নিচের তলায় ৮টা ঘর। বাকি প্রতিটা তলায় ঘরের সংখ্যা ১৩। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে অফিস, রান্নাঘর, স্টোররুম, গেস্টরুম, খাওয়া দাওয়া এবং মিটিংয়ের জন্য বিরাট একটা হলঘর আর স্টাফেদের জন্য তিনটে থাকার ঘর। দোতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত প্রতিটা ঘরে দুজন করে বোর্ডারদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরে ঘরে দুটো করে সিঙ্গল খাট আর চেয়ার টেবিল এবং একটা করে স্টিলের আলমারি রাখা। প্রতি তলাতে সামনের দিকে একটা লম্বা করিডোর, তার একদিকে সিঁড়ি এবং অপর দিকে দুটো বাথরুম। বিভিন্ন অঞ্চলের ও পেশার, নানান্ বয়সের আর ধর্মের, বিবাহিত এবং অবিবাহিত মেয়েরা এখানে থাকে। অবশ্য আশপাশের মানুষজন হোস্টেলের বোর্ডারদের খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। কখনো ড্রেনের সমস্যা, কখনো পথের মাঝখানে ময়লা ফেলা, রাস্তার কুকুর বিড়ালদের দুবেলা খাওয়ানো, এসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, পাড়ার প্রায় সবকটা ফ্ল্যাটের সাথে এদের দিনরাত ঝামেলা লেগেই রয়েছে।
বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে জলের পাইপ বেয়ে, সানি আর জিকো যখন লেডিস্ হোস্টেলের ছাদে উঠল, তখন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রাত এগারোটা। সানি তার গার্লফ্রেন্ডকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, কিন্তু উলটো দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। জিকো হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যঙ্গের সুরে বললো,
জিকো- “আগেই বলেছিলাম, এই লেডিস্ হোস্টেলের মেয়েগুলো ঠিকঠাক না, গণ্ডগোলের আছে। সাধে পাড়ার লোকজন এড়িয়ে চলে।“
সানি- “কিন্তু সোনালী ওরকম নয় রে। খুবই নিডি আর ভালো পরিবারের মেয়ে। এই স্কুলের চাকরিটা কত কষ্ট করে পেয়েছে জানিস?”
জিকো- “ওরে আমার কত কষ্ট উথলে উঠল রে! কি করে জানলি ও সব সত্যি কথা বলছে তোকে?”
সানি- “না রে মেয়েটা সত্যি খুব ভালো। স্কুল আসা যাওয়ার পথে প্রথম প্রথম তো কম জ্বালায়নি। তবু শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়েই ছাড়লাম।“
সানি আবার সোনালীকে ফোন করতে লাগল, কিন্তু অন্যদিক থেকে কোনো উত্তর নেই। জিকো গজগজ্ করেই চলেছে,
জিকো- “শহরের এতো জায়গা থাকতে, তোকে এই লেডিস্ হোস্টেলের ছাদেই দেখা করতে আসতে হলো?”
সানি- “আজ সোনালীর জন্মদিন। রাত ১২টায় সামনে থেকে উইশ করবো ভাই। কিন্তু শালা ফোনটাই ধরছে না।“
ঠিক এমন সময়তেই ছাদে লোহার দরজাটা প্রচন্ড জোরে আওয়াজ করে খুলে গেলো। সানিরা মুখ বাড়িয়ে দেখল একটা অন্ধকার সিঁড়ি, নিচের দিকে নেমে গেছে। কিছুটা দোনামনা করে তারা কয়েক ধাপ নীচে নামতেই, একই রকম ভাবে জোরসে ছাদের দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেলো। দুজনেই মারাত্মক ভয় পেয়েছে। তারা আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে লোহার দরজাটা খোলার খুব চেষ্টা করলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এমন সময় একটা চাপা স্বরে সমবেত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণের মত শব্দ, নিচের তলাগুলো থেকে ভেসে আসতে লাগলো। সানিরা দেখলো সাথে সাথে বেশ কিছু মোমবাতির আলোও তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সাদা সাদা রাত পোশাক পরা বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা খোলা চুলে, খালি পায়ে, জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে, মন্ত্রের মতো কিছু একটা বলতে বলতে, সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসছে। সানি দেখল তাদের মধ্যে সোনালীও আছে। কিন্তু সোনালীর চোখ দূর শূন্যে স্থির। সানি ভয়ে তাকে ডাকতে পারছে না। চারপাশে হাওয়ার চিন্হমাত্র নেই, কিন্তু প্রতিটা মেয়ের চুল অদ্ভুত ভাবে, উপর দিকে এলোমেলো উড়ছে। জিকো ক্রমাগত ছাদের দরজাটা খোলার চেষ্টা করে চলেছে। মেয়েদের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে যে মধ্য বয়স্কা মহিলা এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল, সে রক্তাভ চোখে জিকোর দিকে একবার তাকাতেই, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে শূন্যে তুলে একদম নীচের সিঁড়িতে আছড়ে ফেললো। আর সাথে সাথেই জিকোর সম্পূর্ণ মাথা থেঁতলে, সেখান থেকে সমস্ত ঘিলু বেরিয়ে এসে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়ে সানির চোখ সেদিকে স্থির হয়ে গেলো, গলা দিয়ে তার আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না। একজন খ্যানখ্যানে গলায় সেই মহিলাদের মধ্যে থেকে বলে উঠল,
মহিলা- “মেয়েদেরকে পথে ঘাটে আর জ্বালাবি?”
সানি চিৎকার করে উঠল,
সানি- “তোমরা কারা?”
এবার সানির গার্লফ্রেন্ড সোনালী অস্বাভাবিক নিচু স্বরে হাসতে শুরু করলো,
সোনালী- “আমাদের এই লেডিস্ হোস্টেলটা আসলে ডাইনিদের একটা কোভেন, সানি।“
মহিলাদের হাতের মোমবাতিগুলো এবার এক এক করে নিভে যেতে লাগলো। সানি প্রাণপণ চেষ্টা করছে ছাদের দরজাটা খুলে ফেলার, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। সানি বুঝতে পারছে, সারি সারি ঠাণ্ডা হাত তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করেছে, কিন্ত তার চিৎকার করার আর কোনো ক্ষমতা নেই।