চতুর্থ বর্ষ -প্রথম সংখ্যা -গল্প
প্রেম আমি আর জোনস দা
শুভ্রা রায়
আমি উচ্চমাধ্যমিক এ বিজ্ঞান এর স্টুডেন্ট ছিলাম। বায়োলজি যে স্যারের কাছে পড়তাম তার পুরো নাম টা জানি না,আসলে কখনো জানার প্রয়োজন হয়নি কারো।তবে সবাই জোনস দা বলতো।আমাদের জোনস দা বড্ড অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিল। যদিও আমরা দাদা বলার সাথে সাথে ব্যাবহার টাও দাদার মত ই করতাম,, তাই ঐ আপনি টাপনি গুলো ঠিক আসত না। আসলে টিউশনে ভর্তি হওয়ার প্রায় সাথে সাথে ই বুঝেছিলাম নামে শিক্ষক হলেও ঐ আমাদের জীবনে এক আধটা মানুষ থেকে যায় না যারা একই সাথে ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইডার হয়ে যায়,,, এই মানুষ টা ঠিক তেমনই একটা মানুষ। সাদামাটা অথচ বড্ড অদ্ভুত। যাকে হাত দিয়ে ধরা যায়, অথচ মুঠোয় রাখা যায় না। বয়সে বেশ অনেক টা বড় হলেও সেটা কখনো আমাদের সম্পর্ক গুলোর মাঝে আসেনি। পড়া না হলে ঠিক যতটা বকুনি খেতাম, অসময়ের বৃষ্টি তে অকারনে চপ, তেলে ভাজা ও ঐ মানুষ টাই খাওয়াতো, অকারণে। শুধু আনন্দ করার একটা ছুতো তুললেই হল।
ও এতক্ষণ ধরে এত কথা বলছি অথচ আমার কথাই তো বলা হয়নি,,, আমি রোশন,,, ড: রোশন ঘোষাল। আর এটা জোনস দার নয় আমার গল্প। জোনস দার গপ্প না হয় অন্য সময় বলব। আপাতত এ গল্প টা বলি। ।আর এটা যে গল্প না শুধু মনগড়া কিছু কথার জমায়েত সেটা না হয় তোমরাই বোলো। আমার শুধু বলতে ইচ্ছে হল। আর জোনস দার কথা বলতে হল কারন জোনস দার টিউশন টা না থাকলে এই গল্পটা ই হত না, তাই,,,,,,,।
বাবা ফরেস্টের অফিসার ছিল। আর দেশের বাড়ি ছিল অজ গ্রামে। আর তাই পড়াশোনা র জন্য মা, আমার আর দিদির বাবার সাথে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। আর বাবার ট্রান্সফারের জন্য এক জায়গায় কম বেশি হলেও পাঁচ বছরের বেশি আমাদের থাকা হত না। এতে আমাদের তেমন কোনো অসুবিধা না হলেও আমার দুটো কাজ হয়েছিল। এক, না চাইতেও বেশ কিছু যায়গা ঘোরা হয়ে যেত। আর দুই, খানিক শান্ত আমি বাইরের জগতের বাইরে ও নিজের ভেতর এক অন্য পৃথিবীর জোগাড় করে নিয়েছিলাম, যার খবর তেমন একটা কেউ জানত না।,,,,, আসলে তথাকথিত সমাজের চোখে আমি সব দিন ই শান্ত, মুখচোরা, পড়াশোনায় ভালো একটি ছেলে ছিলাম। তাই রেজাল্ট খারাপ হত না বলে একটু বেশি ই চুপ থাকা আমির চুপ করে থাকাটুকু কাউকে বিরক্ত করত না। বরং ঐটাই কখন যেন আমার পরিচয় হয়ে গেছল।
আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত যে স্কুলে পড়েছিলাম সেটা কো এড ছিল। আর অবশ্যই সেটা বেসরকারি স্কুল ছিল। জায়গাটার নাম ছিল বসন্তপুর। না শহর, না গ্রাম,,,, ঐ মফস্বল ধরনের শহর একটা। শহরের অত্যাধুনিক চাকচিক্য ও ছিল না। আবার গ্রামের মত পিছিয়েও ছিল না। তবে মানুষ ছিল, বন্ধুত্ব ছিল, পড়াশোনা ছিল, খেলাধুলা ছিল, আর ছিল তোয়া। সবাই তোয়া বলে ডাকত,,, পুরো নাম ছিল তোয়াশা। ফড়িং কিম্বা বাঁদরের মানুষ রূপ বলা যেত।এক মূহুর্ত চুপ করে আছে,,,, এরকম টা আমি অন্তত কখনো দেখিনি।
এখন তোমরা ভাববে এখানে তোয়া কেন এল। তবে কি এটা আমার আর তোয়া র প্রেমের গল্প।,,,, প্রেমের গল্প কি না জানি না এটা। আদোও কি এই লেখায় প্রেম বলে কিছু খুজে পাবে তোমরা তাও জানি না। শুধু জানি ঐ নামটা না থাকলে এই গল্প টা বা গল্পের মত এই কিছু একটা লিখতে আমার মত রস কষ হীন ডাক্তার কে প্রেসক্রিপশন ছেড়ে পেন চালাতে কাগজ ধরতে হত না।
আগেই বলেছি বাবার ট্রান্সফারের চাকরি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বসন্তপুরে পড়াশোনা করার পর হঠাৎ করেই বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায়। সবছেড়ে চলে যেতে হয় আমাদের। এজন্য কদিন পুরনো যায়গার জন্য মন খারাপ ছাড়া আর তেমন কিছু ই হত না আমাদের। প্রথম থেকেই কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছলাম আমরা সবাই এই জীবনে।,,, এতদূর পর্যন্ত তেমন কোন গল্প ই ছিল না বলার মত। অজান্তেই এই গল্পের সূত্র পাত হয়েছিল তখন যখন প্রায় পাঁচ বছর পর বাবার আবার ট্রান্সফার হয়েছিল বসন্তপুরে। আর আমি ইলেভেনে এসে ভর্তি হয়েছিলাম বসন্তপুর বয়েজ স্কুলে এবং বায়োলজি পড়ার জন্য জোনস দার টিউশনে।
প্রথম দিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই টিউশনে পৌঁছে একটা কোন ধরে চুপচাপ বসে পড়েছিলাম। এই কোন ঘেঁষে বসার জন্য ছোট থেকেই একটা নাম উপহার পেয়েছিলাম,,,, কুনো। ক্ষেত্র বিশেষে সেটা রোশন কেও ধামাচাপা দিয়ে দিত। এখানে এসে স্কুলে ভর্তি হবার পর পুরনো অনেক বন্ধু র সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব হয়ে গেছল খুব তাড়াতাড়ি।আর ফিরে এসেছিল আমার নাম টাও। আসলে ক্লাস ফাইভ মানে দশ এগারো বছর বয়স টা এতটাও ছোট বয়েস নয় যে চট করে কেউ কাউকে ভুলে যাবে। তাই সেই হালকা ধুলো চাপা বন্ধুত্ব গুলো ঝেড়ে মুঝে ঝকঝকে করে নিতে বেশি সময় লাগেনি। আমি যদিও তেমন একটা মিশুকে পাবলিক ছিলাম না। তবু সঙ্গ দোষে লোহা পুরোপুরি না ভাসলেও মাঝে মাঝে হাবুডুবু তো খেয়েই যায়। অন্যদের চেষ্টাতেই বোধহয় অনেক কটা ভালো সহপাঠী আর কিছু ভালো বন্ধু আমারো হয়ে গেছল। এরকম ই থাকত জীবন টা যদি না জীবনে একটা জোনস দা আসত অজান্তেই কিছু গল্প আগলে রাখা শেখাতে।
প্রথম দিন ক্লাস টা পরিচিত হতে আর টুকটাক সিলেবাস আলোচনা আর অল্প পড়াশোনা করেই শেষ হয়ে গেছল। সবাই বেরোচ্ছিল আস্তে আস্তে। আমি বসেই ছিলাম কোনে। সবাই বেরোক তারপর বেরোবো। আর স্যার কে বই কেনা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল,তার জন্য।স্যার,, হ্যাঁ স্যার কে কারন তখনো স্যার জোনস দা হননি আমাদের সবার কাছে। যারা আগে পড়তো তারা বাদ দিয়ে। অন্তত আমরা যারা নতুন ভর্তি হয়েছি তাদের কাছে। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হড়বড় করে জিজ্ঞেস করেছিল,,,, এই তুই রোশন না? সারদামণি মেমোরিয়াল এর রোশন।
হঠাৎ করেই কেমন ভেবলে গেছলাম। আসলে আমি এরকম ই। হঠাৎ করে কেউ কিছু বললে চট করে কিছু বলতে পারি না। তারপর সামনের জন যখন একটি মেয়ে,,,,।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বা যে কারনেই হোক আবার ফড়ফড় করে বলতে শুরু করেছিল মেয়ে টা,,,,,
কি রে চিনতে পারলি না আমাকে। আমি তোয়া, তোয়াশা। সারদামণি তে একসাথে পড়তাম আমরা। সেই যে দোলের পর দিন স্কুলে আবির খেলার সময় আমার চোখে রং ঢুকে গেছল। তুই তোর বোতলের জল দিয়ে আমার চোখ ধুয়ে দিয়েছিলি। আর আমি হয়তো আর দেখতে পাব না ভেবে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলি। লক্ষী ম্যাম কত বুঝিয়ে তোকে চুপ করিয়েছিল। কি রে মনে পড়েছে।
এবার সত্যিই মনে পড়ছিল আমার। হালকা হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। আসলে আমারো দোষ ছিল না। স্কার্ট টপ স্কুল ড্রেস পরা, ঘাড় পর্যন্ত চুলের একটা মেয়ে র সাথে সালোয়ার পরা এলোমেলো একপিঠ চুলের মেয়ে টা কে মেলাতে একটু সমস্যা তো হবেই।অনকটাই তো পরিবর্তন হয়েছে। অবশ্য যতটুকু পরিবর্তন হয়েছিল ততটুকু যে শুধু বাইরে আর পোষাকে সেটা বুঝতে আমার বেশিদিন লাগেনি।
কথা শুরু হয়েছিল সেদিন থেকে। একরকম নতুন করে ই। আসলে এটা তেমন বলার মত কথা নয়। সেম ব্যাচ, সেম ক্লাস, সেম টিউশন, বন্ধুত্ব হওয়া ই স্বাভাবিক। তবে তোয়া ঠিক যতটা মিশুক ছিল আমি ঠিক ততটাই অমিশুকে ছিলাম।, ছেলে মেয়ে মিলিয়ে একটা ব্যাচে ওর যত বন্ধু ছিল,,, আমার সর্বমোট ও ততগুলি বন্ধু ছিল না।,,, তবে ওর অনেক বন্ধু ছিল মানে এই নয় কেউ ওর বিশেষ বন্ধু ছিল, আবার কাউকে অবহেলা করত। সবাই ওর বন্ধু ই ছিল। সবার জন্য, সবার দরকারে ঐ একটা মেয়ে সবসময় ছিল। আর সেই দলে কখন আমিও ঢুকে গেছলাম। হ্যাঁ ছিলাম ওর সেই দলে আমি। প্রথম প্রথম বুঝতাম না। টুকটাক কথা হত। বেশিরভাগ টা ও ই বলতো। বলতে গেলে ঐ ব্যাচটাতে ওর জোরাজুরি তেই সবার সাথে মিশে গেছলাম। টুকটাক হৈচৈ ও করতাম। আর কেউ কিছু বললে গার্ড করতে মহারানী তো ছিলেন ই। শুধু আমি বলে নই। বেশ কিছু দূর্বল মানুষের রক্ষাকর্তা হতে দেখেছি ওকে। সে প্রেমের ক্ষেত্রে ই হোক আর অন্য কোন ব্যাপারেই হোক। তবে সেই আমজনতা বন্ধু দলের মধ্যেও ওর একটি বিশেষ বন্ধু দল ছিল। কি করে তার বাছাই হত আমি জানি না। আজও জানা হয়নি। শুধু বোঝা যেত কিছু কিছু মানুষ একটু বিশেষ ট্রিটমেন্ট পায় দেখে। আর সেই দলে যে আমিও ঢুকে আছি সেটা অন্যেরা বুঝেছিল কিনা জানি না, আমার বুঝতে একটু সময় ই লেগেছিল। একবার শরীর খারাপের জন্য বেশ কিছুদিন স্কুল টিউশন কোথাও যেতে পারিনি। তখনো এখনকার মত মোবাইল এত এভেলেবল হয়ে যায়নি। তাই ফোনে যে কেউ কিছু জানবে বা জানাবে সেটা সবসময় সম্ভব হত না। কি করে জেনেছিল জানি না। সুস্থ হওয়ার পর যেদিন টিউশন গেছলাম ঝাড় খেয়েছিলাম বেশ। তার সাথে সাবধান বানি, যেন সাবধানে থাকি। সামনে পরীক্ষা। আর উপহার স্বরূপ যা পড়ানো বা লেখানো হয়েছিল তার নোটসমূহ।,, না অবাক খুব একটা হইনি। আবার আমার প্রেমে পড়েছে ভেবে দু ঢোক জল ও খাইনি। কারন এরকম অধিকার বোধ দেখানোর জায়গা ওর অনেকের ওপরেই আছে। প্রথমেই বলেছিলাম না মেয়ে টা একটু অন্যরকম। শুধু বুঝেছিলাম খুব অকারনে হলেও আমি সেই মানুষ গুলোর মাঝে ঢুকে পড়েছি যাদের ওপর মহারানির দৃষ্টি বা অধিকার বোধ একটু বেশি ই।
সময় চলছিল সময়ের মত। ইলেভেনের পরীক্ষা শেষ। ততদিন স্যারের বাইরে বেরিয়ে স্যার আমাদের জোনস দা হয়ে গেছে। আমার মত ছেলেও জোনস দার সাথে টুকটাক ইয়র্কি করে। ভালোই চলছিল সব। বেশ লাগতো আমার মানুষটাকে। ভালো তো সবাই বাসত। বাবা, মা, দাদা, বৌদি, ভাইঝি,,,, বেশ সুন্দর সাজানো পরিবার। হয়তো পরিবারে আরো কিছু মানুষ ছিল, আমার জানা ছিল না। যেটুকু দেখতে পেতাম সেটুকুই বললাম। বিয়ে করেননি। স্কুল, টিউশন, ভাইঝির সাথে খুনসুটি, বই,,, আর অদ্ভুত কিছু শখ নিয়ে বেঁচে ছিল মানুষ টা। এই যেমন,,, ভারি সুন্দর সাদা রঙের বাড়ি ছিল জোনস দার। বাইরেও সাদা। ভেতরেও সাদা মার্বেল। কেমন যেন মনে হত সাদা সমুদ্রে ডুবে আছে সব। জোনস দার নিজের রুমের জানালার বাইরে একটুকরো টিন লাগানো ছিল। জিজ্ঞেস করায় বলেছিল,,, ছোটবেলায় টিনের চালের বাড়ি ছিল আমাদের। বৃষ্টি হলে মনে হত দূর থেকে একদল ঘোড়া ছুটে আসছে। বেশ যুদ্ধে যাওয়া রাজকুমার মনে হত নিজেকে। অনেক বড় পর্যন্ত শব্দ টার দাম বুঝিনি। এই বাড়িটা হওয়ার পর প্রথম বৃষ্টি র দিন কিছু একটা বড্ড মিস করছিলাম। পরে অনেক খুজে বুঝলাম ঐ ঘোড়ার খুরের শব্দ টা। যেটা বৃষ্টি আর টিনের চাল ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারবে না। ছোটবেলার জিনিস তো দাম ই আলাদা তার। কিন্তু এতবড় দামি বাড়িতে তো আর টিনের চাল বসানো যাবে না। কেউ অ্যালাও ও করবে না। তার চেয়ে নিজের ঘরেই থাক। আমার প্রয়োজন আমার টুকু মিটলেই হল। আসলে শব্দ টা শুধু শব্দ হয়ে আসে না রে। আমার গোটা ছোটবেলা টা নিয়ে আসে। তাই আজও ঘুমের ঘোরে বৃষ্টি হলে ঐ আওয়াজ টা পেলে আমি আজও রাজপুত্র হয়ে যাই,,,, বলে মাথার চুল গুলো ঘেটে দিয়ে হেসে ছিল মানুষ টা। শুধু কি এটা বলতে গেলে লিস্ট হয়ে যাবে। চাষের মোটা লাল চাল খেতে ভীষণ ভালোবাসত মানুষ টা। অথচ রোজগার এতটাই ছিল যে প্রতি দিন চাইলে বিরিয়ানি, মটন খেতে পারত। পূজোর শারদীয়া শুকতারা, আনন্দ মেলা, কিশোর ভারতী এমন করে পড়ত যেন স্কুলে পড়া কোন ছেলে। আর ঐ বই এর হাত ধরেই আমাদের বন্ধুত্ব টা একটু ভালোই হয়ে গেছল। তবে তোয়া র সাথে বেশ জম্পেশ ভাব ছিল। আসলে ছোট বড় সবার সাথে ই মেয়েটার বন্ধুত্ব বেশ ভালো ই জমে যেত। বন্ধুত্ব টা ওর কাছে বোধহয় সবচেয়ে সহজ সাবজেক্ট ছিল।
বাগান করার শখ ছিল জোনস দার। বাড়ির পেছনে আর চারপাশে বেশ সাজানো বাগান ছিল। তারমধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগতো আমার বাইরের দরজার পাশে দেওয়াল ঘেঁষে থাকা একটা চাঁপা ফুলের গাছ। গাছ টায় সবসময় ফুল থাকত এমন নয়। অথচ সবসময় অদ্ভুত একটা গন্ধে ভরে থাকত। আসলে জোনস দার বাড়িটা ছিল সামনে, পেছনে ছিল আসল বাগান টা। আর পাচিল থেকে বাড়ি পর্যন্ত ধার ঘেঁষে গাছ ছিল। মেন দরজার পাশের ফাঁকা যায়গায় আমরা সাইকেল রাখতাম। আর তার পাশেই ছিল ঐ চাঁপা ফুলের গাছটা। তাই চাই বা না চাই দেখা আমাদের হয়েই যেত।
খুব মজার ছিল মানুষ টা। হয়তো বুঝদার ও। তখন সবে সবে বাজারে এসেছে ভেলেন্টাইন্স ডে। আমরা খামে ভরে নাম লিখে বেতন দিতাম। হঠাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে ক্লাসে ঢুকেই বলে উঠল,,,, এই শোন সবাইকে বলছি। এ মাসে ভ্যালেন্টাইনস ডে আছে। তাই যারা যারা বেতন ঝেঁপে গিফ্ট কিনবি তারা ফাঁকা টাইমে এসে নিজেদের নাম গুলো বলে যাবি ।আমি কিছু বলবোও না, ভাববো ও না।বেতন দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু গার্জেন এনকোয়ারি করলে যাতে তোরা বা আমি কেউ ই না গাড্ডায় পড়ি,, তাই আগে থেকেই বলে দিলাম। ঠিক এরকম ই ছিল আমাদের জোনস দা।,,,, এতকথা, এত গল্প একদিনে জানতে পারিনি। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে তার জেনেছি। আর সেই জানার সীমানা য় এটাও ছিল,,, শুনেছি কোন একজন কে ভালোবাসতো মানুষ টা। ঠিক কি হয়েছিল জানা হয়নি। তার জন্যই যে বিয়ে করেনি,,, সেটাও সঠিক ভাবে জানা ছিল না কারো। শুধু তোয়া বলেছিল একবার,, একবুক গন্ধ আগলে বেঁচে আছে মানুষ টা।
এরকম ই মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া কথা বলতো মেয়ে টা মাঝে মাঝে। বলেছিলাম না একটু পাগলি টাইপের ছিল। তা বলে ভেব না আমি প্রেমে পড়েছিলাম। শুধু ভালো একটা বন্ধুত্ব ছিল আমাদের।
জোনস দার টিউশনের দৌলতেই অনেক ভালো ভালো সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। তেমনি একবার হয়েছিল কি কালিপূজো র পর প্রথম টিউশন খুলেছে। এমনিতেই ছেলে মেয়ে সেদিন টা কম আসে। তার ওপর সেদিন হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় খুব কম জন ই এসেছিল। আমার আসার একটু পরেই ঢুকেছিল তোয়া। বৃষ্টি প্রায় মাথায় নিয়ে। অল্প একটু ভিজেও ছিল। এমনিতেই কখনো মেয়ে টাকে তেমন একটা স্টাইল মেরে চুল টুল বাঁধতে দেখিনি। ঐ কোন রকমে একটা ক্লিপ বা গাডার চেষ্টা করত অবাধ্য চুলগুলো আগলে রাখতে। কিন্তু সেদিন ভিজে যাওয়ায় চুলগুলো খুলেই বসে পড়েছিল আমার পাশে। যদি ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে যায় সেই জন্য আর কি। একটা গন্ধ আসছিল ভেসে। কেমন যেন চেপে যাচ্ছিল বুকের ভেতর টা। কিছু বোঝার আগেই জোনস দা এসে পড়েছিল। একে ছেলে মেয়ে কম তাতে এই আবহাওয়া। অল্প পড়ার আলোচনা,, একটু আড্ডা র পর বৃষ্টি থামতেই সেদিন ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। আনন্দ করে ই বেরিয়ে পড়েছিল সবাই। সবে পূজো শেষ হয়েছে। এখনো অনেকের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড় রয়ে গেছে। সেই আড্ডা র লোভেই বা অযাচিত ছুটির আননদেই হোক হৈচৈ করে উঠেছিল পুরো ক্লাস। সবাই বেরোনোর পর দেখি সাইকেল স্ট্যান্ড করে বসে একটা কিছু করছে তোয়া। কাছে গিয়ে দেখি চেন খুলে গেছে সাইকেলের। পাশে বসে বলেছিলাম,,
তুই সর,আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
তুই পারবি?,,, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। হয়তো ভেবেছিল পড়াশোনা টা ছাড়া আমি আর তেমন কিছু ই পারি না।
ভুলে যাস না আমি গাড়ি নয় সাইকেল ই চালাই। তাই সর,,,, বলে আলতো করে সরিয়ে চেন টা লাগানোর চেষ্টা করছিলাম। জায়গাটায় খুব একটা আলো ছিল না। আসলে এখানে র মত এত নিয়ন আলোর রমরমা ছিল না তখন। থাকার মধ্যে থাকত হাতে ধরার মত পেন্সিল টরচ। ওকে আলো টা দেখাতে বলে চেন টা লাগাচ্ছিলাম আমি।চকলেট খাচ্ছিল একটা। আর আমার প্রায় ঘাড়ের ওপর ঝুকে আলো দেখাচ্ছিল। ঝাপঝুপে একঝাড় চুল ছড়িয়ে ছিল আমার পিঠের ওপর। ভেজা মাটি, ডেয়ারি মিল্ক চকলেট, ক্লিনিক প্লাস স্যাম্পু,পন্ডস পাউডার মেশানো অদ্ভুত একটা অচেনা গন্ধ ঘিরে ধরছিল আমায়। হঠাৎ কেমন যেন থেমে যাচ্ছিলাম আমি ভেতরে ভেতরে। চাঁপা ফুলের গাছটা বেশি দূরে নেই। অন্ধকার ছিল বলে ভালো করে দেখা হয়নি। হয়তো আজ অনেক ফুল ফুটেছে,,, হয়তোবা সেটার ই গন্ধ,,,,,,
নে হয়ে গেছে,,, বলে চেনটা লাগিয়ে আস্তে আস্তে উঠে পড়েছিলাম আমি।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে চকলেট টা এগিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল,,, ঠ্যাংক ইউ বলব না।শুধু এটা খা।আজ আর একটাও এক্সট্রা চকলেট নেই রে। নাহলে গোটাই দিতাম। আমি একটুই খেয়েছি,,,,,
নিয়েছিলাম আমি। একটু ভেঙে নিয়ে ওকে ফেরত দিতে যেতেই বলেছিল,,,, পুরোটাই তোকে দিলাম। ও আমি এঁটো করেছি বলে নিবি না,,,,
আরে না না। তেমন কিছু নয়। আচ্ছা। এই নে নিলাম। হয়েছে?,,,
হয়েছে,,,, চল এবার। হেসে বলে সাইকেলে চেপে পড়েছিল তোয়া।
এতটা পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছো এই লোকটা এত উল্টো পাল্টা বকছে কেন? না এটা প্রেমের গল্প হচ্ছে না জোনস দার, না অন্য কিছু। আর ওখানেই তো। এটা তো আসলে কোন গল্প ই নয়। এভাবে তোমাদের বলতাম ও না যদি সবকিছু অন্যান্য গল্পের মত করে চলতো। শুধু আবার যদি না কখনো ফিরে আসা হত এখানে।
এরকম টুকরো টুকরো দিন নিয়েই দিন এগোচ্ছিল। এইচ এস শেষ। স্কুল লাইফ শেষ। সবাই যে যার মত ছড়িয়ে গেল নিজের নিজের পথে। আমি আর তোয়া ও। না প্রেম হয়নি আমাদের। শুধু ছোটবেলার বন্ধুত্বের বই টাতে খুব দামি নাম হয়ে রয়ে গেল। আর আমার পার্টস এ একগাদা টাকা আর আই ডি কার্ডের ভিড়ে রয়ে গেল একটা চকলেটের রেপার। কি জানি কেন ওটা সেদিন ফেলতে পারিনি। এত পার্টস চেঞ্জ হয়েছে। জামার সাইজ থেকে জুতোর নাম্বার চেঞ্জ হয়েছে,, শুধু এটা চেঞ্জ হয়নি। কেন হয়নি জানাও নেই। আর আজ এতদিন পর প্রেসক্রিপশন ছেড়ে এই কাগজ নিয়ে গল্পের মত অথচ গল্প নয় এমন কিছু লিখতে চাওয়ার কারন ও এই রেপার আর বসন্ত পুর।
পেশায় আজ ডাক্তার আমি। বিয়ে বা প্রেম কোনটাই কাজের চাপে বা সময়ের অভাবে করা হয়নি। তা নিয়ে দুঃখ বা আফসোস কোনটাই নেই। অবসর বলতে বই আর কিছু পুরনো বন্ধু। হ্যাঁ পুরনোই। কারন স্কুলের মত বনধু আর কখনো হয় না। কিছু শুধু সোশাল মিডিয়াম আছে। আর কিছু বাস্তব জীবনে। না তোয়া র সাথে কোন যোগাযোগ নেই। যে সময় টা যোগাযোগ রাখা যেত তখন তেমন মাধ্যম ছিল না। আর আজ খানিক ইচ্ছে করেই করি না। শুনেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে। চাইলে ফেসবুকে খুজে পেতে পারতাম। সেখান থেকে হয়তো হোয়াটসঅ্যাপ এর মত কাছাকাছি যায়গাতেও চলে যাওয়া যেত। কিন্তু যদি হিসেব মত না হত সব। তবে খারাপ লাগত। বদলে যাওয়া কিছু যদি না সহ্য করতে পারতাম। তারচেয়ে এই বেশ। মনের মধ্যে বেশ একটা দস্যি দামাল চকলেট খাওয়া, সর্দারি করা, চাঁপা ফুলের মেয়ে ই বরং বেঁচে থাক।ক্ষতি কি সবসময় আজ কে নিয়েই বাঁচতে হবে। কখনো কখনো পুরনো জিনিস ই ভালো হয়। দামি হয় আজকের চেয়ে অনেক বেশি।
আসলে এত কথাই আসত না। এত কথা লিখতে বা বলতেও ইচ্ছে করত না এতদিন পর। বেশ সুন্দর একটা সেলোফেন পেপারে মুড়ে কতগুলো মানুষ আর তাদের স্মৃতি কে সিন্দুকে ভরে রেখে দিয়েছিলাম আমি। এতদিন পর এই বসন্ত পুরে ফিরতেই একটা শান্তশিষ্ট ছেলে, কি যেন নাম ছিল হ্যাঁ মনে পড়েছে কুনো,,,, সব কিছু বের করে ছড়িয়ে দেখতে বসেই বিপত্তি টা লাগিয়ে দিয়েছে।
দশদিনের ম্যাডিকেল ক্যাম্পের জন্য ই হঠাৎ করে প্রায় পনেরো বছর পর আসতে হয়েছে এই বসন্ত পুরে। আর কদিন পর বিকেল দিকে একটু ফাঁকা পেতেই পা আর মন দুটোই ছটফট করে উঠেছিল ছোটবেলার শহর টাকে একটু দেখে আসার জন্য। আর সেই জন্য ই বেরিয়ে পড়েছিল এই শর্মা। অনেক কিছু বদলে গেলেও ঐ শীতকালে বারবার বেরনো নকসী কাথার মত ই কিছু জিনিস আজো এক ই রকম রয়ে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে নাকি অবচেতন ইচ্ছে র জোরে হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল জোনস দার ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হ্যাঁ যোগাযোগ আছে মানুষ টার সাথে। ঐ ফোন মারফত আজকাল যত টা থাকে। তবুও ফোনের তার সেই উষ্ণতা টা একটুও কমাতে পারেনি। বলেছিলাম গেলে যেতে পারি। তবে এসেছি বা আজ ই আসব সেটা জানানো হয়নি। তবে এসেই যখন পড়েছি তখন একবার দেখা করে যাওয়াই ভালো। না থাকলে তখন না হয় পরে আসা যাবে।
যায়গাটা খুব একটা বদলায়নি। সেই রাস্তা, সেই বাঁক। শুধু সরকার থেকে রাস্তা গুলো ঢালাই করে দিয়েছে।আর নিয়ন লাইট লাগানো হয়েছে।শুধু আমাকে একটু কিছু মনে করিয়ে দিতে কি না জানি না রাস্তা থেকে জোনস দার বাড়ির হাফ মিটার রাস্তা আজও সেই আগে র মত লাল মোরাম জড়ানো রয়ে গেছে। কাজ পরে হবে না অন্য কোন কারণে জানি না। তবে এটুকু পথ ঐ দস্যু ছেলে র মত সবার সামনে লুকিয়ে যাওয়ার মত করে যেন সমস্ত বাঁধা ই রাস্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বমহিমায় রয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে ঢুকেছিলাম বাড়িতে। সনধ্যে হয়েছে সবে। ভেতরে ঢুকে ডাকতেই বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল মানুষ টা। পরীক্ষা শেষ হয়েছে কদিন আগে। তাই ক্লস শুরু হয়নি এখনো। আমাকে নিয়ে গিয়ে পড়ানোর ঘরেই বসিয়েছিল। সেই আমরা যেখানে পড়তাম সেই ঘরটাতেই। হঠাৎ করেই কারন ছাড়া আবার ভারি হয়ে গেছল বুকের ভেতর টা। বয়স হয়েছে আমার। ডাক্তার আমি। আমার কি এসব মানায়। তবুও,,,,,,
সামনে বসেছিল জোনস দা বয়স ছাড়া তেমন কিছু বদলায়নি। সেই ঝকঝকে চোখ, সরু ফ্রেমের চশমা, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর সেই মন ভালো করা হাসি। হাসতে হাসতে ই বলেছিল,,,,
কি রে কবে এলি?,,,,,
এই তো তিনদিন হবে।
তারপর। আজ এখানে আসব বলেই বেরিয়েছিস নাকি অন্য কোথাও যাবি?,,
না, মানে,,,, সত্যি বলতে কি কিছু ঠিক করে বেরোইনি। এদিকে এলাম ঘুরতে ঘুরতে। তারপর হঠাৎ মনে হল তোমার সাথে দেখা করে যাই।তাই চলে এলাম। ,,,,, চাইলেই হয়তো মিথ্যে কিছু বলতেই পারতাম। কিন্তু কেন জানি না পারলাম না। কিছু মানুষ বোধহয় আমাদের সবার জীবনেই থেকে যায় যাদের আমরা চেয়ে ও মিথ্যে বলতে পারি না, হয়তো চাই ও না,,, সারাজীবন।
বাহ,,,, বেশ করেছিস। , ,,, বোস, একটু চা আনতে বলি,,,,,,
কথা চলছিল। কিছু পুরনো, কিছু নতুন। কিছু পেরিয়ে যাওয়া সময়ের কিছু আগামী র। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছিলাম,,,,,,
বিয়েটা তো করতে পারতে? এভাবে একা একা,,,,,,, শেষ করতে পারিনি কথাটা। দুটো চোখ থামিয়ে দিয়েছিল আমায়। আসলে এমনিতে তো আমি কখনো তেমন কোন দুঃসাহসীক কাজ করিনি। আজ যে কি করে?,,,,, হয়তো জোনস দা র ও অবাক লেগেছিল। তবু হেসে ছিল মানুষ টা। বলেছিল,,,,,
তোদের ব্যাচের অনেকেই তো অনেক কিছু শুনেছিল। অনেক কিছু জানত। তুই কি কিছু ই শুনিসনি,,,,,
শুনেছিলাম। তবু,,,,,,,,
আসলে কি জানিস তো কিছু জিনিস আমরা যদি নিজেরা কাউকে নাও বলি তাও কিছু গল্প গল্প হয়েই ছড়িয়ে যায়। আমি জানিনা তুই কি শুনেছিস। তবু বলবো কিছু কিছু জিনিস থাকে যেটা পাওয়ার পর মানুষ কখনো একা থাকে না। কিছু পাওয়ার থাকে না।,,, অনেক বছর আগে একজন বলেছিল যখন তোর লাগানো গাছ ভরে ফুল আসবে। সেই গন্ধের সাথে তোর ভালোবাসা আসবে আমি আসব। জানিস তো বহু বছর আগে ঐ চাঁপা গাছটা লাগিয়েছিলাম। হয়তো এত বছরেও গাছ ভরে ফুল আসেনি, তাই আমার ভালোবাসা ও আসেনি। আসলে কি বলতো এক একটা গন্ধ এক একটা মানুষ কে জুড়ে থাকে। এক একটা মানুষ কে ঐ গন্ধ টার সাথে জুড়ে জীবনে এমন ভাবে রেখে দেয় যে একা হওয়ার সুযোগ হয় না।,,,, হয়তো গাছ ভরে ফুল ফোটেনি বলে সে আসেনি,,, তবে গন্ধ না আসা হয়নি। তাই ভালোবাসা ও না আসা হয়নি। এই যে তুই এমনি এদিকে এসেছিলি বলে চলে এলি এটা কি একটা আসা নয়। তোর মধ্যে দিয়ে তোদের পুরো ব্যাচটার গন্ধ , ভালোবাসা মনে পড়ে গেল। এটা কি ফিরে আসা নয়। মানুষ না এলে কি আর গন্ধ না আসা হয় রে? ভালোবাসা না আসা হয়। এই যে কারন ছাড়া তোরা আসিস,,, ঘরের বাচ্চা গুলো আবদার করে,,, দিদি, বৌদিরা বকাঝকা করে,,, কেউ অনেক দূরে গিয়েও বছরে একবার এখানে এসে দেখা করে বা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, জোনস দা কেমন আছ?,,, এগুলো কি আসা নয়। এগুলো কি ভরে থাকা নয়। এতকিছুর মাঝেও কি করে একা থাকি বল?কি করে মিথ্যে বলি একা আছি।,,, তবে হ্যাঁ গাছটার একবার ফুলে ফুলে ভরে ওঠার অপেক্ষা আজও করি। জানি একদিন ঠিক গাছটা ভরে ফুল ফুটবে।আর সেদিন,,, ,,,,,,
আরো কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বিকেল দিকে অল্প বৃষ্টি হয়েছিল। হালকা ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। সামনের লাইট পোস্টের আলোটা কোন কারনে জ্বলেনি। সামনের মোরামের রাস্তাটুকু আবছা অন্ধকার। হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া র সাথে একরাশ চাঁপা ফুলের গন্ধ এসে ঝাপটা মেরেছিল। মাথাটা ঘুরে গেছল কি না জানা নেই হঠাৎ মনে হয়েছিল চারপাশটা ভিজে মাটি, ডেয়ারি মিল্ক চকলেট, ক্লিনিক প্লাস স্যাম্পু, আর পন্ডস পাউডারের মেশানো একটা চাঁপা ফুলের গন্ধে ভরে গেছে। আর একটু দূরে একটা ছেলে বসে সাইকেলের চেন লাগাচ্ছে। পেছনে ছেলেটার কাঁধে ঝুকে চকলেট খেতে খেতে আলো দেখাচ্ছে গোলাপি সালোয়ার পরা একটা মেয়ে।,,,,,,,,,,
ঝাপসা হয়ে গেছল চোখটা। প্রেসার টা বোধহয় ফ্ল্যাকচুয়েট করছে। একটু যেয়ে দেখে নিতে হবে। অজান্তেই হাতটা চলে গেছল পার্টস এ। একটা ডেয়ারি মিল্ক চকলেটের রেপার ঠিকঠাক আছে তো। আজও ডেয়ারি মিল্ক চকলেটের প্যাকেট খুললে চকলেটের সাথে সাথে একটা ষোলো বছর মাখা পন্ডস পাউডার আর ক্লিনিক প্লাস স্যাম্পু র গন্ধ ঝাপটা মারে। এমন একটা গন্ধ যেটা কখনো একা হতে দেয় না। হয়তো সময় পেরিয়ে অন্য কোন গন্ধ জড়িয়ে অন্য অনেক মানুষ জীবনে আসবে। থাকবে।কিন্তু এমন গন্ধ আর আসবে না।অকারনে থাকতে বারবার গন্ধ রা আসে না। আসবেও না।এমন গন্ধ জীবন একবার ই আমাদের দেয়,,,,,,,
লিখতে আমি জানি না প্রথমেই বলেছি। শুধু বুঝতে পারছি না এটা কি লেখা হল?,,,,, প্রেমের, আমার না জোনস দার,,,,, বুঝতে পারলে অবশ্যই বলবে।
হালখাতা
শুভ্রা রায়
ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখ, নতুন জামা আর সকালে কচুরি- ঝিলিপির সাথে যে জিনিস টার অপেক্ষা করতাম, পহেলা বৈশাখের সাথে সাথে যে দিনটা বৈশাখের দুপুরে এতো সেজেগুজে আসতো, সেটা হালখাতা। রোজের দেখা পুরনো দোকান গুলো নতুন করে সেজে উঠতো ফুলের মালা, দরজায় রাখা ঘট আর আমপল্লব দিয়ে। দোকান ঘরের একপাশে জমা হতো সারি সারি মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার আর সরবতের বোতল। যখন যেখানে থেকেছি দু চারটে নেমন্তন্ন জুটেই গেছে বরাবর। নতুন জামা পরে বাবার সাথে সেই নেমন্তন্ন রাখতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল। নেমন্তন্ন এই কারণে বললুম, কারণ তখনও হালখাতা মানে দোকানে গিয়ে সরবত খাওয়া আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসাই বুঝতাম। এর সাথে দোকানে দোকানে কোন কম্পিটিশন চলতো কি না জানি না, তবে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে চলতো। কে কতো গ্লাস সরবত খেয়েছে আর কার কাছে কতোগুলো মিষ্টির প্যাকেট জমেছে সেই নিয়ে। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনকার ছেলেমেয়ে গুলো এমন কম্পিটিশন করে? এমন রঙিন ছুটে যাওয়া আছে ওদের জীবনে? বৈশাখের সকালে মিষ্টির প্যাকেট ওদের জীবনে মেঘের ছায়া এনেছে কোনদিন? স্মৃতির মেঘেদের ছায়া…
পুরনো কথা লিখতে বসলে সেসব গল্প নিয়ে ঝুলি ভরে যাবে, তবুও এবারের মতো ফুরোবে না বোধহয়। তবে এই হালখাতা উৎসবের শুরু হওয়ার পেছনে খানিক গল্প আছে। সেগুলো বলি বরং।
হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ এবং শুরু করার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ঐ বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে “হালখাতা”-র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে।
মূলত হালখাতার আচারটি বাঙালি মুসলমানদের দারা শুরু হয়েছিল। বাঙালিরা হালখাতা শুরু করার আগে, হালখাতার প্রথম পাতায় “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” ও “এলাহি ভরসা” লেখেন। ‘হাল’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ একটি নতুন রীতি প্রচলন করেন, যেটি একসময় ‘পুণ্যাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা এখনও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। হালখাতা খোলার আগে পুরান ঢাকার মুসলমানরা হালখাতার দাওয়াতের আয়োজন করেন। এই হালখাতার দাওয়াতের পূর্বে শুভ হালখাতার দাওয়াতের পত্র বিতরণ করা হয় নিমন্ত্রণ জানাতে। এই দাওয়াতকে ঘিরে দোয়া মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলের মতন বিভিন্ন বাঙালি ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। নতুন বছরের শুরুতে ব্যবসার মঙ্গল কামনা করেন। এইসব মাহফিল শেষে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়। অনেক ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন ও পরের দিনের মাঝের যেকোন একটি দিন বেছে নেয় হালখাতার দাওয়াত, দোয়া বা বলতে গেলে নতুন খাতা শুরু করার এবং নতুন করে সূচনা পর্বে মিষ্টি মুখ করানোর জন্য। নববর্ষের দিন সকল ক্রেতা বা দর্শকদের মিষ্টি ও ঠান্ডা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে ব্যবসায়ীরা। হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। পরে হিন্দুরা এই প্রথা গ্রহণ করে। পহেলা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানী ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভাল যায়। দেবতার পূজার্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিন্দুরে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দন চর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসেব নিকেশ আরম্ভ করা হয়। এই দিন ক্রেতাদের আনন্দদানের জন্য মিষ্টি, ঠাণ্ডা পানীয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা বা শুভ মহরৎ পূজা করে থাকেন।
এ তো গেলো হালখাতা-র শুরুর কথা। কিন্তু তার পরেও কি হালখাতা শুধু ব্যাবসায়ী কিম্বা দোকানদারের হয়ে থাকতে পেরেছে? পারেনি। অন্তত বাঙালীদের কাছে একটা সময় পর্যন্ত হালখাতা ছোটখাটো একটা উৎসবের যায়গা নিয়ে নিতো। মিষ্টি খেলে বা না খেলেও ঐ একটা দিন প্যাকেটে করে বৈশাখের রোদ গায়ে মেখে হেঁটে যাওয়া পথগুলো, পরের দিন স্কুলে বসে করা হিসেব গুলো, একটা দিন দোকান থেকে কেউ ‘ শুধু মুখে ফিরে না যাওয়ার’ অদ্ভুত সব নিয়ম গুলো কেমন যেন পহেলা বৈশাখের সাথেই রঙিন কাগজের মতো জড়িয়ে রয়ে গেছে। যে রঙিন কাগজ গুলো আমাদের মতো অনেক অনেক বোকা মানুষের জীবনে দু চারটে সাদামাটা গল্প দিয়ে গেছে জমিয়ে রাখার জন্য। আমরাও ঐ দিনটাকে ‘ হালখাতা ‘ বলি।
শিলং-এর সেই বিকেল
অভিষেক রায়
শ্যামল আর অনিমেষ দু’জনেই কবি, আর দু’জনেই বন্ধু। মেদহীন এক দুপুরে, তারা ট্রেন ধরে পৌঁছাল শিলঙের পাদদেশে। পাহাড়ের হাওয়ায় চা-পাতার সুবাস, আর সিগারেটের ধোঁয়া একসাথে মিলেমিশে এক রকম ধ্যানের মতো লাগছিল।
শ্যামল বলল, এইখানেই থেকে যাই, কী বলিস অনিমেষ?
অনিমেষ হেসে বলল, থাকাই যায়, তবে কাগজ-কলম চাই।
তারা পৌঁছে গেল একটা ছোট্ট হোমস্টেতে। বাড়ির মালকিন বুড়ি এক খাসিয়া মহিলা, নাম জুইমা। বাংলাও বোঝেন, একটু-আধটু বলেনও। বিকেলে জুইমা বানিয়ে দিলেন লাল চা আর মাটির পাত্রে গরম পিঠে।
পাহাড়ে সূর্য নামার আগে, অনিমেষ রেলিং ধরে বসে কবিতা লিখছিল
“নীল মেঘে তোমার ছায়া খুঁজি,
পাহাড়ের ঢালে বাঁশি বাজে
তুমি বোধহয় আবার ডাকছো
তাল গাছের ছায়া পেরিয়ে…”
শ্যামল হঠাৎ বলল, “তুই জানিস ? এই রকম কোনো বিকেলে সুনীলদা বলেছিলেন, পাহাড়ে বসে প্রেম চিরকাল সত্য হয়।”
অনিমেষ জবাব দিল না। শুধু ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি খেলে গেল।
সেই রাতে তারা হাঁটতে বেরোল পাহাড়ের চূড়া বরাবর। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ, আর পায়ের নিচে শহরের আলো জ্বলে-নেভে।
শ্যামল বলল, জীবনটা এমনই হোক না অনিমেষ। কবিতা, পাহাড় আর বন্ধু।
অনিমেষ বলল, আর একটা আড়াল করা প্রেম।
শ্যামল শুধুই তাকিয়ে রইল।
শিলং-এর সেই বিকেল – পর্ব ২
সকালবেলা জুইমা ঘরের বাইরে এসে ডেকে বলল, বাবু, লাহিং লাহিং, মানে ওঠো ওঠো। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
অনিমেষ চোখ খুলে দেখল জানালা দিয়ে সোনালি রোদ এসে পড়েছে কাঠের মেঝেতে। শ্যামল ঘুমিয়ে আছে পাশের খাটে, এক হাতে কবিতার খাতা ধরা, আর অন্য হাতে রাখা একটা অর্ধেক পোড়া সিগারেট।
বাহিরে বেরিয়ে তারা দাঁড়াল কাঠের বারান্দায়। সামনেই খাসি পাহাড়ের ঢাল, দূরে মেঘের ভেতর গাছে ঢাকা এক কুচকুচে ছায়াময় গ্রাম। পাখির ডাক, হালকা কুয়াশা, আর জুইমার হাতে বানানো লাল চা সব মিলিয়ে যেন একটা কবিতার ভেতর তারা দু’জন ডুবে আছে।
শ্যামল বলল, তুই বুঝলি অনিমেষ ? এই শহরের নাম শিলং হলেও, আমার কাছে এটা প্রেম। নির্বাক প্রেম।
অনিমেষ একটু থেমে বলল, তবে তোকে বলি শ্যামল, আমি এখানে একবার এসেছিলাম, এক মেয়ের সঙ্গে। নাম ছিল তার মেঘমল্লিকা।
শ্যামল হেসে বলল, এই নাম শুনেই প্রেমে পড়া যায়। তারপর ?
তারপর, হারিয়ে গেল। চিঠি লিখত, পাহাড়ের ঠিকানায়। আমি কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এবার এলাম, যদি তাকে আবার খুঁজে পাই।
শ্যামল চুপচাপ শুনল। তারপর পকেট থেকে বের করল সিগারেট, আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, তবে এবার যদি দেখিস, কিছু বলবি ?
অনিমেষ বলল, না, শুধু তাকাব। পাহাড় চেনে তাকিয়ে থাকা চোখের ভাষা।
বিকেলটা তারা কাটাল একটি চুপচাপ পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে। মাঝখানে একটা পুরনো গির্জা পড়ল। পাশেই ছিল এক খাসিয়া যুবতী রঙিন স্কার্ট, গলায় পুঁতির মালা, হাতে বাঁশের ঝুড়ি। সে দেখে একটু হেসে উঠল।
শ্যামল আনমনে বলল, এই পাহাড়ের মেয়েরা হেসে উঠলেই কবিতা লেখা যায়।
অনিমেষ হঠাৎ থেমে বলল, এই গির্জার গায়ে একটা চিঠি গেঁথে দিয়েছিল মেঘমল্লিকা। পড়েছিলাম। আজও সেই চিঠি আছে কি ?
তারা গিয়ে দেখল, না, চিঠি নেই। কিন্তু গির্জার দেয়ালে ছোট করে আঁকা আছে
তুমি এসো। পাহাড় অপেক্ষায় থাকবে।
শ্যামল তাকিয়ে রইল, আর অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। হয়তো মনে মনে বলল,
আমি এসেছি, মেঘমল্লিকা। শুধু তুই কোথায় ?
শিলং-এর সেই বিকেল – শেষ পর্ব
রাত নেমেছে শিলং-এর পাহাড়ে। পাইন গাছগুলোয় অন্ধকার ছায়া পড়ে গেছে। গির্জার পাশে বসে আছে অনিমেষ আর শ্যামল। দু’জনেই চুপচাপ। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশি বাজনার মতো একটা পুরনো লোকগীতি।
অনিমেষ ধীরে ধীরে বলল,
শ্যামল, ভাবতে পারিস ? আমি এত বছর ধরে এই একটা চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম। এখন এসে দেখি, চিঠিটা নেই, কিন্তু তার চিহ্ন রয়ে গেছে।
শ্যামল তার কাঁধে হাত রাখল, বলল,
তুই তো কবিতা লিখিস, অনিমেষ। তোকে তো জানতেই হবে সব শেষ হয় না। কিছু অপেক্ষা থেকেই যায়। আর সেই অপেক্ষার মধ্যেই বাঁচে ভালোবাসা।
খিদা
ব্রতেশ দাস
মতি পিসি এখন আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না… চৌষট্টিটা বছর ধুঁকতে ধুঁকতে পার হতে গিয়ে ওইটেই অভ্যাস হয়ে গেছে। ওপার বাংলা থেকে চলে আসার সময় সবাই একসাথেই ছিল। পিসি, পিসির বর, বুড়ো বাপ, শ্বশুর-শাশুড়ি, পেটে ধরা সন্তান… সবাই। কিন্তু, কীভাবে যেন ছিটকে যায় পিসি… শুধু ওই সন্তানখানি ছাড়া। উদ্বাস্তু শিবিরেই জন্মেছিল মেয়েটা। ক্লিষ্ট শরীরগুলোর মাঝে এক নির্মল জন্মচিহ্ন। বয়সের তুলনায় ওজন কম ছিল। কখনও কখনও পিসি ক্ষুধার্ত শরীরে ওকে দুহাতে কাছে টেনে নিয়ে হাসত, খালি হাসত… মেয়েটা হাসত না। ওই বয়সও তো ক্ষুধা বোঝে! খুব কাঁদত ও… পিসি তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে, পলক পড়ত না। কখনও কোলে নিয়ে আদর করতে করতে গল্প করত নিজেদের বাড়ির… এক্কেবারে নিজেদের। সামনে একচিলতে মাঠ, তারপরেই শুরু চাষের জমি, উঠোনের পাশে সার বাঁধা কলাগাছ, পিছনে এক বহু পুরনো এক নিমগাছ, সমস্ত এসে ভিড় করত ওদের গল্পে। তার সাথে সাথে হাত দিয়ে কত কিছুর ভঙ্গি করে দেখাত পিসি… হাত দুটোকে অনেক উপরে লম্বা করে বলত ‘গাছ’… দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বলত ‘মেঘ’ অথবা ‘আকাশ’। আর ‘বৃষ্টি’ নামলে হাত দুটো কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে আসত পিসির। সবশেষে, হাত দুটোকে ত্রিভুজের মতো উপরে নিয়ে গিয়ে বলত ‘বাড়ি’… ‘আমাদের বাড়ি’। ওই সময় চোখদুটো কী অসীম গভীরতায় ডুবে যেত… কিচ্ছু দেখা যেত না আর!
চোখের ভেতরে ওই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পিসি যেন গড়ে নিত নিজেদের একচিলতে বাড়ি… আলোছায়াময় ঘর… আর ওই শব্দটুকু উচ্চারণ করতে করতে হাত বাড়াত সদ্য গড়া বাড়িটুকুর দিকে। কিন্তু যতই এগোত, ছুঁতে চাইত ওকে, ততই দূরে সরে যেত ওই ছবিগুলো, কিছুতেই আর নিজের করতে পারত না। তখন সেই সুদূর মাটির আকর্ষণে বৃষ্টি নামত হঠাৎ। আমরা দেখতাম, মেয়ের কান্না ভোলাতে ভোলাতে কখন যেন পিসির চোখ বেয়ে নেমে এসেছে বৃষ্টি… অঝোর বৃষ্টি।
দেড়মাসের মাথায় মারা গেল মেয়েটা, ডায়েরিয়ায়। জন্ম ইস্তক কোন নাম দিতে পারেনি পিসি। যাবার কালে তাই কোন চিহ্ন নিজের করে নিয়ে যেতে পারল না ও। তবে রেখে গেল অঢেল। এর পরপরেই বেশ কদিন পিসির খাওয়া এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেছিল। এমনি দিনেও যে খাওয়াটুকু হতই, তা নয়… তবে ওই আকুল হয়ে চেয়ে থাকাগুলো হত… হয়তো অভ্যাস অথবা প্রবৃত্তি। আর কিছুর কথা তো মনেই আসত না। পরে বুঝেছিলাম, ক্ষুধা বোধ হয় প্রেম বা স্নেহ কোন কিছুর থেকেই বড় নয়… হতে পারে না। পিসিকে আমরাই জোর করে কিছু খাওয়াতে পেরেছিলাম… প্রায় সাতটা দিনের পর।
মহিলা রিফিউজিদের জন্য তখনকার মুখ্যমন্ত্রী একটা আশ্রয় শিবির গড়ে তুলেছিলেন। সেখানেই ঠাঁই মেলে পিসির। ছোট্ট টিনের চালের অন্ধকার ঘর, একটিই দরজা। সরকার থেকে মাসে মাসে চাল, ডাল আসত। তখন বহুদিন খিদের অনুভবটুকুই ভুলে ছিলাম। প্রয়োজন হয়নি খাবার খোঁজার।
এভাবে অনেক কটা দিন কেটে গেল…প্রায় চৌষট্টিটা বছর… শুধু অন্ধকার আর একাকীত্বের সাথে ঘর করে। অনেকখানি কষ্ট থেকে থেকে উঁকি দিয়ে যেত পিসির চোখের ওই গাঢ় শূন্যের মধ্যে। আজ চোদ্দ মাস হল, বরাদ্দ ডাল আসা বন্ধ হয়েছে। আর ঠিক সাত মাস আগে শেষবারের মতো চাল নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সরকারের ভ্যান-রিক্সা। খুব প্রাণ ভরে গরম ভাত খেয়ে ঘুমোতে গিয়েছিল পিসি। তখন তো বুঝিনি… তারপর সে চালও ফুরল। এখন পিসি কুঁজো হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে রোজ সকালে বেরিয়ে পড়ে। কখনও দুটো বুনো কচু, কখনও একটু শাকপাতা, যা পাওয়া যায়, কোঁচড়ে করে নিয়ে আসে।
কিন্তু, কদিন আগে হঠাত মাথা ঘুরে পড়ে গেল পিসি…আচমকা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে পা দুটোর সাড়ও গেল চলে। আর না… আর দাঁড়াতে পারে না পিসি। শুধু ওই অন্ধকারে ডুব দিতে পারে…একলা। টিনের ঘরে সারাটা দিন শুয়ে শুয়ে দিন কেটে যায়। জিজ্ঞেস করি, “সারাদিন চোখ বন্ধ করে কী ভেবে যাও পিসি?”
অল্প হেসে পিসি বলে ওঠে, “টিনের আড়ালে আধমরা হয়েই তো চৌষট্টিটা বছর কাটিয়ে দিলাম। এখন চোখ বুজলেই শুধু দেখতে পাই, এক থালা গরম ভাত!”