চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা- গল্প
চুরমুর
শুভ্রা রায়
(১)
বেশ খানিকক্ষণ ধরেই ডাইনিং-এ বসে উশখুশ করে যাচ্ছেন বিপ্লব বাবু। শরীর আরাম কেদারা আর সদর দরজার মাঝখানে ঘুরঘুর করছে। কান সতর্ক হয়ে জেগে আছে বিশেষ একটা আওয়াজ শোনার জন্য। রোজ তো এমন সময় চলে আসে। আজ এমন দেরি হচ্ছে কেন কে জানে? আসবে তো আজ? নাকি আজই ডুব মারবে বিপ্লব বাবুর সমস্ত প্ল্যান ডুবিয়ে দিতে?
বিপ্লব চৌধুরী। নিমতলার সাহেব পাড়ার বিখ্যাত ‘ কিপ্টে বুড়ো’। কাজে প্রাক্তন স্কুল মাস্টার হলেও, হাড় কিপ্টে বিপ্লব চৌধুরী কে দেখলে নাকি লোকের সেদিন খাওয়া জোটে না এই অপবাদ গড়াতে গড়াতে আজ তাকে পাঁচ পাড়ায় বিখ্যাত করে দিয়েছে এই নামে। আর হবেন নাই বা কেন কিপ্টে, থুড়ি সঞ্চয়ী? এই মাগ্নি গন্ডার বাজারে হাত খুলে খরচা করলে বেঁচে থাকা যায় নাকি? ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হয় মানুষকে।
যদিও বিপ্লব বাবুর বয়স তেষট্টি পেরিয়েছে মাস তিনেক হল। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া টাকা ছাড়াও রিটায়ারমেন্টের টাকাও আছে যথেষ্ট।আর সাথে রয়েছে প্রতি মাসের পেনশন থেকে পাওয়া মোটা টাকা। বিদেশে থাকা ডাক্তার ছেলেও বাবার জন্য বেশ ভালোই মোটা অঙ্কের হাতখরচ পাঠায়। তবুও ওনার আর ভবিষ্যতের চিন্তা শেষ হয় না।
স্কুলের চাকরি শেষ হওয়ার আগেই স্ত্রী গত হয়েছেন, তাও প্রায় বছর দশেক হতে চলল। ছেলে পড়তে গিয়ে বিদেশেই স্থায়ী ভাবে রয়ে গেছে। যদিও রিটায়ারমেন্টের পর বিপ্লব বাবুকে বহুবার গিয়ে ওখানে থাকতে বলেছে সে, তবে ঠিক যেয়ে উঠতে পারেননি। স্ত্রী গত হওয়ার পর স্কুলের হস্টেলেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিতেন। রাতে যা হোক দুটো মুড়ি চিড়ে দিয়ে কেটে যেতো। এই অবসর নেওয়ার পর ছেলেই একরকম ধরে বেঁধে একটি মেয়েকে কাজে রেখেছে। ঘরের যাবতীয় কাজের সাথে সাথে দুপুরে দুটি ঝোল ভাত রেঁধে দিয়ে যায়। একটি চারা পোনা মাছের সাথে সিজনের সবচেয়ে সস্তা সব্জি দিয়ে ঝোল, এই একটি মাত্র পদ আর ভাত মোটামুটি তার রোজের মেনু। রাতের খাবার তো চিড়ে মুড়ি দিয়ে সেই কবে থেকেই চলছে। বৎসরান্তে ছেলে সপরিবারে এলে দু একদিন মেনু বদল হয়।
তা এ হেন বিপ্লব বাবুর সাথে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের বড়োই সদ্ভাব, ঠিক আদা আর কাঁচকলার মতো। বচ্ছরকার পুজো গুলোর সামান্য চাঁদা চাইতে চাইতে ওদের হাল ঐ পা ভাঙা নেড়ি নেপুর মতো হয়ে গেছে। তাই বেশ কিছু বছর হল ওরা আর কষ্ট করে চাঁদা তুলতে পর্যন্ত যায় না। বুড়োর ছেলে এলে মোটা টাকা দিয়ে যায় যদিও। তবুও ভারি বিরক্ত হয় ওরা বুড়োর ওপর। ইলেকট্রিক বিল কমানোর জন্য সন্ধ্যে হতে না হতেই খেয়ে শুয়ে পড়ে। ওরা তো শুনেছিল বুড়োদের নাকি অনিদ্রার রোগ থাকে। কিপ্টে বুড়োর ক্ষেত্রে সে নিয়ম ও খাটেনি বোধহয়….
(২)
শ্রাবনের মাঝামাঝি সময় থেকেই মোটামুটি দূর্গাপুজার কাজ শুরু হয়ে যায়। এই চাঁদা তোলা, প্যান্ডেল ওয়ালা কে বায়না দেওয়া। ঢাকি ঠিক করা। আরো কতো কি কাজ। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়েই বাঁশ বাঁধাও শুরু হয়ে যায়। তখন আর ক্লাবের ছেলে ছোকরাদের দম ফেলারও ফুরসত থাকে না। মফস্বলের পাড়ার মোড় গুলোতে এমনি দিনেও বিকেল হতে না হতে ছোটখাটো ঠ্যালা গাড়ি আর সাইকেল নিয়ে ভিড় জমায় চপ, ঘুঘনি, ফুচকা ওয়ালারা। আর মনসা পুজোর সময় থেকে তার সাথে যোগ হতে থাকে চাউমিন, লাল সসে ভরা পাতলা খোলের এগরোল, চিকেন পকোড়া, কাটলেট। বিকেল দিকে ক্লাবের এই ছেলে ছোকরাগুলোই আধেক খাবার ভ্যানিস করে দেয়।
সেদিন পেনশনের কিছু কাজের জন্য ব্যাঙ্কে গেছলেন বিপ্লব বাবু। সারবার ডাউন থেকে হাজার একটা ঝামেলা মিটিয়ে বেরোতে বেরোতেই বিকেল গড়িয়ে গেছলো। দুদিন এলে আসা যাওয়ার খরচ দুবার হবে।সাথে শারীরিক ক্লান্তি তো আছেই। তাই দেরি হলেও একদিনের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
ব্যাঙ্ক থেকে ওনার বাড়ির দূরত্ব হেঁটে মিনিট কুড়ি। সেপ্টেম্বরের বিকেল। রোদের তাপ ও আইসক্রিমের মতো গলে যায় তাড়াতাড়ি। ওটুকু রাস্তা হেঁটেই চলে যাবেন । যাওয়ার অটো ভাঁড়াটুকু বেঁচে যেতে মন একটু বেশিই ফুরফুরে ছিল বলেই পাড়ার মোড়ে দাড়িয়ে হুল্লোড় করা ছেলে ছোকরা গুলোকে ঠিক দেখতে পাননি। নাহলে মোটামুটি দু পক্ষ- ই এড়িয়ে চলে একে অপরকে। কারনটা ঠিক কেউ ই জানে না বোধহয়।
হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্যে থেকে নিজের পিতৃদত্ত নাম শুনে একটু থমকে গেছলেন যেন। এ পাড়ায় তার নাম ধরে ডাকার মতো প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। হঠাৎ করেই সে নামে ডাকবেই বা কে? এদিক ওদিক তাকাতেই দেখেছিলেন একটা সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে জটলা করছে গুটিকয়েক ছেলে। ছেলেগুলো এপাড়ারই বলে দিতে হয় না নতুন করে। কিন্তু এতো সম্মানের সাথে ডাকার কারন। পুজোর চাঁদা নেওয়ার নতুন কোন প্ল্যান নেই তো। বুড়ো মানুষ উনি, পুজো দেখতেও আসেন না, প্রসাদ খেতেও আসেন না। চাঁদা দেবেন কি জন্য? টাকা পয়সা কি গাছে ফলে নাকি?
কিন্তু দুধের সরের মতো জমতে থাকা ভাবনার জাল হৈহুল্লোড়ের চোটে কেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে সময় লাগেনি। ততক্ষণে ওদিকে তার নাম ধরে ডাকাডাকির প্রাবল্য আরো বেড়েছে।
” ও বিপ্লব কাকু, কানেও কি শুনতে পান না আজকাল। বলি অতো টাকা রেখে করবেন কি? ডাক্তার তো দেখান। আসুন এদিকে একবার… “।
আপাতত এদের এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবে পরবর্তী কোন কথার কি উওর দেবেন এবং চাঁদা যে কোন ভাবেই উনি দেবেন না সেকথা স্পষ্ট করে কিভাবে বলবেন সেসব ভাবতে ভাবতেই ওদিকে এগিয়েছিলেন বিপ্লব বাবু।
(৩)
সাইকেলে করে আসে লোকটা। পেছনের ক্যারিয়ারে একটা ঝুড়িতে থাকে মুড়ি, নানারকম মশলা, আলু সেদ্ধ ঘুঘুনি, আর মুড়মুড়ে ফুচকার পাঁপড়। মোটামুটি মশলা মুড়ি, আলুকাবলি, ঘুঘনি থাকে।আর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সেদ্ধ আলু, ফুচকার পাঁপড় আর টক জল দিয়ে জম্পেশ করে বানানো চুরমুর। আগে ছেলেটা এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতো। কিন্তু একবার সাহেব পাড়াতে এসেই বুঝেছিল, মোটামুটি এপাড়াতেই তার সব মাল শেষ হয়ে যায়। তাই এখানেই তার আপাতত নির্দিষ্ট ঠাঁই হয়েছে। ছেলেটা আসার সময় টুঁংটাং করে সাইকেলের বেল বাজিয়ে জানান দিতে দিতে আসে। বিপ্লব বাবু জানেন। কিন্তু এসব নিয়ে তার কি। এসব খাওয়ার বয়স কিম্বা ইচ্ছে কোনটাই তার নেই। কিন্তু এই ছ্যাঁচড়া ছেলেগুলোর দৌরাত্ম্যের জন্য বাধ্য হয়ে এখানে এসে দাড়াতেই কি একটা গন্ধ যেন নাক দিয়ে ঢুকে গোটা শরীর টাকে একবার ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছলো। আড়চোখে একবার ঝুঁড়ি টা দেখে আবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ” বলো কি বলবে। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। ক্লান্ত আছি আমি। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আর হ্যাঁ চাঁদা কিন্তু আমি দেবো না, এই বলেই রাখছি “।
ছেলেগুলো এ ওর দিকে একবার করে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিল হো হো করে। তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ” আরে কাকু চাঁদা কে চাইছে। ও আপনি দেবেন না আমরাও জানি। এমনিতেই তো দেখা সাক্ষাৎ হয় না। ভাবলাম কেমন আছেন টাছেন একটু খবর নিই”।
“ভালো আছি আমি। আর কিছু… “- বেশ গম্ভীর গলাতে বলেছিলেন বিপ্লব বাবু।
” বাহ বেশ তো। ভালো থাকাই তো উচিত। তা বলছি কি একটু আলুকাবলি বা চুরমুর খাবেন নাকি আমাদের সাথে? না না চিন্তা নেই টাকা দিতে হবে না। আমরাই খাওয়াচ্ছি ধরে নিন”।
চোখদুটো পিট পিট করে একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়েছিলেন উনি। মতলব কি ব্যাটাদের।হঠাৎ করে ডেকে এসব কথা বলছে কেন? ভেতরে ভেতরে কি অন্য কোন ফন্দি আছে? নানা এসবে ঢোকা চলবে না। আবার গম্ভীর গলাতে বলেছিলেন, ” এই বয়সে রাস্তার খাবার সহ্য হবে না আমার। কি ভেবেছো এসব খাইয়ে চাঁদা নেবে। ওসব কথা ভুলে যাও। আমি অতো আহাম্মক নই”।
ওদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে হঠাৎ করেই বলেছিল, ” মানছি আমরা একটু চাঁদা তুলি, তবে সেটাও তো পুজোর জন্য। দশ টাকার চুরমুর খাইয়ে চাঁদা তোলার ইচ্ছে আমাদের অন্তত নেই। একাই তো থাকেন। আর ঐ রোগির পথ্য খান। একদিন খেয়েই দেখুন না। মস্ত জিনিস। শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে। আর শরীর খারাপ হলে? আপনার ফোন টা দিন, আমার নম্বর টা সেভ করে দিচ্ছি। অসুবিধা হলেই ফোন করবেন পৌঁছে যাবো। একটা টাকাও খরচ হবে না আপনার। আরে মা আসছে, আনন্দ করে এটুকু আমাদের সাথে খেতেই পারেন। কি বলিস রে সব… “।
শিয়ালের হুক্কাহুয়ার মতো সবাই একসাথে বলে উঠেছিল, ” আলবাত কাকু। খেয়ে ফেলুন দিকিনি এক পাতা। মন পুরো ফুরফুরে হয়ে যাবে “।
খানিকটা সন্দেহ, একটু ইচ্ছে, মারাত্মক অবিশ্বাস আর একটা হঠাৎ জন্ম নেওয়া পুরনো লোভের চাপে পড়ে এক প্লেট চুরমুর নিয়েই নিয়েছিলেন বিপ্লব বাবু। অনেক অনেক বছর পর খেয়েছিলেন টক, ঝাল, নোনতা মেশানো একটা বড়ো সাধারণ খাবার। লঙ্কার ঝাল টা কি বেশি পড়েছে? নাহলে হঠাৎ তার চোখগুলো এমন জ্বালাজ্বাল করছে কেন?
” বলছি কাকু একাই তো থাকেন। আমাদের ক্লাবে পুজোর অনুষ্ঠানের রিহার্সাল হচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে চলে আসবেন না। সবার সাথে আড্ডাও হবে। আবার আপনার সময় ও কাটবে। তারপর অতক্ষন যে বাড়িতে ফ্যান চলবে না, সেই ইলেকট্রিক বিলটাও তো বাঁচবে। চিন্তা নেই, চাঁদার জন্য কেউ বলবে না”।
“আচ্ছ, দেখবো”।
” উঁহু, ওসব দেখছি টেখছি হবে না। কাল থেকেই চলে আসুন। আরে বাবা পাড়া হল সেকেন্ড হোম। তার পুজো। আপনার মতো মানুষ গুলো মাথার ওপর না থাকলে চলে? “
একটু অবাক হয়েই ছেলে গুলোকে দেখেছিলেন উনি। বাইরে থেকে যেমন মনে হয় ততোটাও চ্যাংড়া নয় সব। এতো বছর ছেলে পিটিয়েছেন। এটুকু মানুষ চিনতে তো অবশ্যই পারেন।
খাওয়ার পর দুটো ছেলে ওনার সাথেই এসে প্রায় বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছলো। বারবার করে বলে গেছলো কোন অসুবিধা হলে যেন সেভ করে দেওয়া দু, তিনটে নম্বরের মধ্যে যেকোন একটাতে ফোন করেন। ওরা সাথে সাথে চলে আসবে।
সেদিন রাতে আর কিছু খাননি বিপ্লব বাবু। এতো বছরের জীবনে এই প্রথম বার রাতে ঘুম আসেনি তার। ছোট্ট একফালি বেলকনিতে রাখা বহু পুরনো একখানা চেয়ারে এসে বসেছিলেন রাতের বেলা। আজ কতযুগ যেন রাত দেখেননি। ওনাকে তাজ্জব করে শরীর মোটেও খারাপ হয়নি। তবে দু চারবার ঢেকুর তোলার সাথে সাথে চুরমুরের গন্ধ যতবার হালকা হয়ে উঠে এসেছে ঠিক ততোবার কেমন একটা যেন হয়ে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা। অম্বল হয়েছে কি? নাহ, তাহলে তো পেট, বুক জ্বলতো।এমন বুকের ভেতর কি ফাঁকা লাগে অম্বল হলে।
ভাদ্র মাসের বাতাসে রাত হলেই কুয়াশা, শিশির, ভেজা পাতা মেশানো অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে আসে।রাতের আকাশ টা কেউ যেন যত্ন করে মুছে দেয় বলে, দু চারটে তারা বেশি দেখা যায়। খুব মিহি ছাতিম ফুলের গন্ধ এসে ঝাপটা মারে। আজ বহু বছর পর চেয়ারে বসে বসে যেন বারোটা মাসের আলাদা আলাদা গন্ধ গুলো বোঝার চেষ্টা করছিলেন বিপ্লব বাবু।
মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিলেন। পড়াশোনা আর ফুটবল- এই দুটো নিয়ে পৃথিবী ছিল। স্কুল ফেরত এই চুরমুর পেট ভরে খেয়ে এসে খেলতে যেতেন। আর ফিরে এসে একথালা গরম ভাত উড়িয়ে দিতেন রাতের বেলা। চুরমুর খুব পছন্দের জিনিস ছিল স্কুলের বিপ্লবের। আজ মনে পড়তেই না চাইতেও আলতো একটা হাসি ফুটে উঠেছিল মুখের ওপর। একদিন তো সন্ধ্যেবেলা বিয়েবাড়ি যাওয়ার ছিল! মা বলে দিয়েছিল, উল্টোপাল্টা আজ কিছু খাবি না। কিন্তু সেই উল্টো পাল্টা খাবার আর চুরমুর কি এক হল? মনের সুখে চুরমুর ঠাসিয়ে খেয়ে এসেও আবার রাতে কেজি খানেক পাঁঠার মাংস জাস্ট উড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাস নাইনের বিপ্লব। হঠাৎ আজ মনে পড়তেই মনে হল এগুলো যেন অন্য কারো গল্প ছিল। এগুলো অন্তত এই বিপ্লব বাবুর গল্প নয়। তাই তো মনেও ছিল না এতোদিন।
বাবার সাথে একরকম ঝগড়া করেই খেলা চলতো। মাস্টার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বড়ো মাস্টার হোক। সেই আশির্বাদ কিম্বা অভিশাপেই হয়তো খেলার মাঠের একটা অ্যাক্সডেন্টে বিপ্লব বাবুর পায়ে চোট লাগলো সাংঘাতিক। ক্লাস ইলেভেন তখন। ডাক্তার বললেন হাঁটতে পারলেও ফুটবল এজন্মের জন্য বন্ধ। নাহলে পাটাই হয়তো থাকবে না। একটা বছর কেমন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। ইলেভেন আরেকবার ড্রপ দিয়ে যখন নতুন করে সব শুরু করেছিলেন তখন বিপ্লব অন্য মানুষ। তার পর থেকে দূরন্ত, মারকুটে, হুল্লোড়বাজ ছেলেটা ভয়ানক শান্ত হয়ে গেছলো। একটা মাঠ, একটা বল নয়, একটা আঠারো বছরের ছেলের জীবন থেকে কেউ যেন পৃথিবীর সমস্ত রঙ, সাধ, স্বপ্ন সব কেড়ে নিয়েছিল রাতারাতি। তখনের পর থেকে পুরনো সব কিছু ছেড়ে পড়াশোনাতেই মন দিয়েছিলেন বিপ্লব। একের পর এক ভালো রেজাল্ট, এক চান্সেই স্কুলের চাকরি। বাবা চেয়েছিলেন কলেজ সার্ভিসে বসুক সে। কিন্তু ঐ অবচেতনে রয়ে যাওয়া মাঠ আর ফুটবল কোথাও যেতে দেয়নি তাকে। হ্যাঁ মাঠেও যেমন আর কখনো কেউ যেতে দেখেনি ওনাকে। ঠিক তেমন করেই স্পোর্টস এর ছেলেদের জন্য সংগোপনে তার কাজ করে যাওয়ার খবরও জানতো না কেউ। তারপর তো বিয়ে, সংসার, ছেলের পড়াশোনা। সবার ভবিষ্যৎ গুছিয়ে রাখতে রাখতে কবে যেন নিজের কথা ভাবতেই ভুলে গেছলেন। স্ত্রীর অসুধ, ছেলের বই, বাবা মায়ের ডাক্তার চেক আপ। এসবের পরে তার জন্য কিছুই থাকতো না। সংসার সর্বস্ব স্ত্রী পর্যন্ত জানতে পারলেন না ভীষণ নিয়মানুবর্তিতার খোলসে ঢাকা একটা মানুষের বুকের ভেতর একটা কি দামাল আঠারো বছরের ছেলে কবেই চুপিসারে ঘুমিয়ে গেছে। এখন তো বেঁচে থাকার জন্য থাকা। ভালোবেসে তো নয়। কম খান, যাতে নিজের অসুস্থতার জন্য কাউকে বিব্রত করতে না হয়। খরচ করতে পারেন না, কারন ভুলে গেছেন নিজের জন্য কি খরচ করতে হয়। এক টাকাও খরচ করতে ভয় লাগে, কারন জানেন না হঠাৎ তেমন কোন সুবিধায় পড়লে কার কাছে হাত পাতবেন। টাকা থাকলে যে কোন মানুষ অন্তত একটু তো সাহায্য করেই দেবে।
হাজার একটা কথা ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এসেছিল। উঠে পড়েছিলেন বিপ্লব বাবু। হঠাৎ করেই মনে হল তার অনেক দিন তো হল। এবারের মতো খাতা বন্ধ করার সময় ও তো হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আরেকবার চেষ্টা করবেন নাকি? দশ টাকার চুরমুর পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ঘুমিয়ে যাওয়া একটা ছেলেকে খোঁচা মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। ঐ হতচ্ছাড়া ছেলে গুলো ওর হাত থেকে বেঁচে যাবে, ভাবলো কি করে ওরা?
(৪)
মাঝের কয়েকটা সপ্তাহ হুড়মুড় করে কেটে গেছলো। রাত পেরোলেই মহালয়া। আজ বেশ কিছুদিন ধরে ক্লাবে রোজ দুবেলা করে যাতায়াত বেড়েছে বিপ্লব বাবুর। প্রথম দু একদিন ছেলে গুলো প্রায় নাছোড়বান্দার মতো ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে। তারপর অবশ্য আর কিছু করতে হয়নি। কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই অনেক অনেক কিছু করে ফেলেছেন তিনি। এই কয়েক সপ্তাহেই পরিচয় হয়েছে অনেকের সাথে। নাতি, নাতনী হয়েছে অনেক গুলো। বেশ কিছু ছেলে, মেয়ে পাওয়া গেছে। আর জুটেছে সন্ধ্যে বেলা এক খালা চুরমুর মাখা।
মহালয়া ফুরোলেই কাজের চাপ অনেক বেড়ে যাবে। ঐ হতচ্ছাড়া বাঁদরের দল কে সেই একাদশী কিম্বা দ্বাদশীর আগে আর ভালো করে পাওয়া যাবে কি না তাও জানেন না উনি। বেশ কিছুদিন ধরে আর একটা কথাও ঘুরঘুর করছে মাথার ভেতর। সেটাও একবার আলোচনা করতে হবে ওদের সাথে।
ক্লাবের ছোট ঘরটাতে সপ্তাহে নাচ, গান, আঁকা এসব শেখানো হয়। আর পাড়ার কিছু ছেলেমেয়ে গরিব বাড়ির বাচ্চাগুলো কে ফ্রিতে পড়ায় সপ্তাহে তিনদিন। যায়গার অভাবে বেশি সম্ভব হচ্ছে না। বিপ্লব বাবুর বাড়িটা নেহাত ছোট নয়। থাকেন তো নিজে একটা ঘর নিয়ে। ছেলে বৌ এলে তাদের ঘর দোতলায় আছে। এসব বাদেও নিচ তলার পুরোটাই প্রায় ফাঁকা। আজকাল ওনার মনে একটা ভারি কিম্ভুতকিমাকার ইচ্ছে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই পড়ানোর ব্যাবস্থাটা যদি কোনভাবে ওনার ঘরে করানো যায়। একা মানুষ, এতোগুলো ছেলেমেয়ে এলে সময় টাও কাটবে। মাস্টার ছিলেন, দরকার হলে সে বিদ্যে ঝালাই করে আরেকবার না হয় ফিরবেন ইস্কুলে। ওনার বাড়িতে হওয়া স্বপ্নের ইস্কুলে। ছেলেবেলায় ওর মাস্টারমশাই রা বলতো, ” বিপু টা বড্ড জেদি। একবার কোন কিছু করবো বললে, আর তাকে থামানো যায় না “। সেই বিপু না হয় হারিয়ে গেছে কিন্তু বিপ্লব তো এখনও বেঁচে আছেন। এতো বছরের অভ্যেস, ভয়, জড়তা কাটিয়ে কি সত্যিই সেই বিপু আর একবার ফিরতে পারে না। আর সেটার জন্যই ওনাকে কথা বলতে হবে ঐ বাঁদরের দলের সাথে। তাও আজকেই। কথা না বলা পর্যন্ত যেন নিজেই শান্তি পাচ্ছেন না। তার জন্যই তো ঐ চুরমুর ওয়ালার কাছে সবাইকে ডেকেছেন উনি। প্ল্যানিং আর ইটিং দুটোই বরং একসাথে হবে। আর আজকের ট্রিটের যাবতীয় খরচা বিপ্লব বাবুর। উনিও দেখবেন কে আজ কাকে হারায়। রিতিমতো কমপিটিশন হবে আজ। হুঁ হুঁ বাবা, ছোকরা গুলো তো আর জানে না দুশো পিস ফুচকা আর এক ডেকচি চুরমুর সাঁটিয়ে দেওয়া সাহেব পাড়ার বিখ্যাত ‘ বিপু রাক্ষস’ সে। তাকে হারানো মুখের কথা নয়। এই শর্মা যে আসলে কি জিনিস আজ হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাকিরা। কিন্তু হতচ্ছাড়া চুরমুর ওয়ালা আসতে এতো দেরি করছে কেন আজ?
এতক্ষনে ক্লান্ত হয়ে আরামকেদারাটাতে বসতেই কানে এসেছিল টুংটাং সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ। তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিলেন বিপ্লব বাবু। ম্যাচের দিন ‘ বিপু রাক্ষস’ মাঠে সবচেয়ে আগে পৌঁছে যায়। আজ সে নিয়ম ভাঙবে, সেটা হতে দেওয়া যায় নাকি?
(৫)
ফুচকা, আলুকাবলি খেতে খেতে চোখ গোল গোল করে, মুখ হাঁ করে বিপ্লব বাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল গোটা সাতেক ছেলে। অবাক হবে, আশ্চর্য হবে, হতবাক হবে নাকি নির্বাক হবে, কোনটা যে ঠিক ওদের হওয়া উচিত সেটাই ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছিল না ওরা। সেদিন মজা করেই চুরমুর খেতে ডেকেছিল ‘ কিপ্টে বুড়ো’কে। নিজেরা কি কি করে পুজোতে সেগুলো দেখাতেই একরকম জোর করে এনেছিল ক্লাবে। পরে এটাও ভেবেছিল – বুড়ো মানুষ, একা থাকে, এখানে এলে ভালোও লাগবে। কিন্তু সেই নেহাত মজা করে, এমনিই করা কাজগুলো এমন বুমেরাং এর মত ফিরিয়ে দিয়ে এমন একখানা ‘ হার্ট অ্যাটাক’ মার্কা প্রস্তাব যে ‘ কিপ্টে বুড়ো’ দেবে সেটা ওরা দুঃস্বপ্নের ভেতরে দেখা দু্ঃস্বপ্নের মাঝেও ভাবতে পারেনি । তাই ঠিক কি রিয়েকশন দেবে বুঝতে না পেরে খাওয়াতেই মন দিয়েছিল সবাই।
” তাহলে কি ভাবলে সবাই? কাজটা কি করা সম্ভব? “।
” আপনি ভেবে বলছেন তো কি… কাকু? “।
“না ভেবে কাজ এই বিপু করে না. এবার তোমাদের মতামত টা শুনি”।
“আমাদের তো সেই পুরো ‘ সোনে পে সুহাগা’ টাইপ ফিলিং হচ্ছে। ছেলেমেয়ে গুলোর পড়াশোনার একটা হিল্লে হয়। আর বাচ্চাদের সংখ্যা বাড়লেও আমাদের আর চিন্তা থাকবে না তাহলে। কিন্তু কাকু এখনই আমরা ভাড়া দিতে পারবো না। আসলে সবে তো পুজো , তাই… “।
” ভাঁড়া কে চেয়েছে আহাম্মকের দল। পয়সার অভাব আমার নেই। শুধু…. “।
“শুধু কি কাকু? “
” মাঝে মাঝেই তোমাদের এই বদন গুলো অন্তত যেন দেখতে পাই। আর সপ্তাহে একদিন চুরমুর খাইয়ো আমাকে। “
” হয়ে যাবে কাকা। নো চাপ। যতো মন ততো খাবেন চুরমুর। শুধু বাচ্চাগুলো র একটু হিল্লে হয়ে গেলেই আমরা খুশি “।
” বাচ্চা গুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তবে আমাকে পেট ভরে চুরমুর খাওয়াতে পারবে তো? “।
” আরে কতোটুকুই বা খাবেন এই শরীরে। পেট ভরে খাওয়াবো। চিন্তা করবেন না। “
” বিপ্লব মাস্টার কে চেনো তোমরা বাছা। কিন্তু বিপু কে চ্যালেঞ্জ করতে এসো না “।
” কি হবে চ্যালেঞ্জ করলে! “
” বলবো না। দেখাবো। চলো শুরু করো। দেখি আজ কে কাকে হারায়? “
” কাকু আপনার শরীরে খারাপ করবে। “।
” তোমাকে সেটা ভাবতে হবে না। নাকি শুরুর আগেই ভয় পাচ্ছো সব। “
” শিরায় গরম রক্ত, আমরা ভোলে বাবার ভক্ত। ” ‘ গাইজ ঝাঁপিয়ে পড়। আজ বুড়োকে ছাড়লে হবে না। আমাদের কে চ্যালেঞ্জ করা…. “।
চুরমুর সাইকেল ওয়ালার সামনে সার দিয়ে দাড়িয়েছিল আটজনের একটা দল। মাঝখানে অসম বয়সী, অসম সাহসী এক তেষট্টি বছরের যুবক। সবার হাতে শাল পাতার ঢোঙায় আলু, ফু্চকার পাঁপড়ি, ছোলা বাদাম, টক জল, আরো কতো কি দিয়ে মাখা চুরমুর। ছেলেবেলার চুরমুর। কাঠের চামচ দিয়ে গোগ্ৰাসে গিলছে সবাই। গলা বেয়ে নামছে স্কুল,বন্ধু,মাঠের গন্ধ মাখা টক- ঝাল- নোনতা আলুর স্বাদ। আজ কারো ছাড় নেই। বিনা যুদ্ধে আজ কেউ সূচাগ্ৰ যায়গাও ছাড়বেনা কাউকে।
সন্ধ্যে নামছিল।মাথার ওপরে জ্বলা বিরাট বড়ো নিয়নের আলো পড়ে ছায়া পড়ছিল সবার। কি অদ্ভুত, কি ভীষণ অদ্ভুত ভাবে দেখা যাচ্ছিল একটা দাঁড়িয়ে বাঁধা সাইকেলের সামনে ছায়া পড়েছে এক বছর আঠারোর ছেলের। মন দিয়ে সে চুরমুর খাওয়ায় ব্যাস্ত। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যাগ রেখেই ছুটবে সে। মাঠ ডাকছে তাকে। এবারের ম্যাচ টা অন্তত বিপু আর হারবে না। কোনভাবেই না….
(সমাপ্ত)
বইমেলা
দেবমিত্রা ঘোষ রায়
আকাশে অল্প অল্প মেঘ জমেছে। শীতকালে মেঘ করলে কেমন একটা লাগে। তার ওপর আজ কলকাতা বইমেলার শেষদিন। পিয়ালী ভাবছে কী করবে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অনিন্দ্য।
– তৈরী হ।
– যাবি? সত্যি?
– হ্যাঁ রে সত্যিই যাবো। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বাস স্ট্যান্ডে আয়। আধ ঘন্টার মধ্যে।
– আচ্ছা। আসছি।
পিয়ালী আর অনিন্দ্যর সম্পর্ক সেই ক্লাস ১১ থেকে। এখন দুজনেই প্রথম বর্ষের ছাত্র ছাত্রী। পিয়ালী ইংরেজী অনার্স। আর অনিন্দ্য? নাহ, কেউ জানেনা। শুধু অনিন্দ্য বলেছিল, “সময় হোক সব জানতে পারবি।”
পিয়ালী তাড়াতাড়ি তৈরী হলো। নীল শাড়ি, চোখে কাজল, ছোট্ট টিপ।
বাস স্ট্যান্ডে পিয়ালী কে দেখে অনিন্দ্য জিজ্ঞেস করল,
– এত সেজেছিস কার জন্য?
– ঘুরতে যাচ্ছি, তাও বইমেলা, সাঝব না? আর এত কোথায়? এইটুকু তো।
– জানি জানি, আমার জন্য সেজেছিস। খুব মিষ্টি লাগছে।
– ধ্যাত অনি, চুপ কর।
বইমেলা পৌঁছনোর পর, পিয়ালী বই কিনতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। হঠাৎ কি যেনো একটা খেয়াল আসায়, পিয়ালী পিছন দিকে ফেরে অনিন্দ্য কে কিছু বলার জন্য। কিন্তু অনিন্দ্য নেই।
ভিড়ের মধ্যে পাগলের মতন খুঁজেও অনিন্দ্য কে পাওয়া যায়নি। ফোন করেছে অনেক বার। ফোন সুইচড অফ। রাত ৮টা অবধি খোঁজার পরেও যখন অনিন্দ্য কে পাওয়া গেলো না, তখন পিয়ালী বাধ্য হয়ে একাই বাড়ি ফিরে এসেছিল। বন্ধু বান্ধব, চেনা পরিচিত কেউই আর কোনো খোঁজ দিতে পারেনি অনিন্দ্যর।
এরপর কেটে গেছে ছ’ বছর।
|০৩.০২.২০২৫|
শীতকাল। দুপুরে জমিয়ে মাংস ভাত খেয়ে সবে একটু শুতে যাবে পিয়ালী, হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।
ফোনের স্ক্রিনে নাম, সমুদ্র দা।
– কি রে পাগলি কী করছিস?
– উফ, জ্বালাতন করার জন্য আবার কি মতলব?
– তৈরী হ।
– কেনো?
– বইমেলা যাবো। আজ তো শেষদিন।
– মানে…. কিন্তু….
– কোনো মানে, কিন্তু শোনার সময় নেই। ঝটপট তৈরী হয়ে নে। আমি আসছি।
– শোনো না……..
কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেলো। অগত্যা।
আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে পড়লো। চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট টিপ আর হালকা লিপস্টিক।
বাড়ির সামনে গাড়ির হর্ন শুনে পিয়ালী বেরিয়ে এলো। গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে সমুদ্র বললো,
– আসুন ম্যাডাম।
– হুম।
– তা আমার হবু বউ এত সেজেছে কার জন্য?
– সমুদ্র দা প্লিজ।
– এই তুই দাদা বলা টা বন্ধ করবি? সামনের মাসে না আমাদের বিয়ে?
– ধুর থামো। আগে হোক তারপর ভেবে দেখবো।
দুজনেই হেসে উঠলো। হ্যাঁ ওদের বিয়ে। সমুদ্র আর পিয়ালীর দেখা ওদের কলেজে। সমুদ্র পিয়ালির থেকে দু বছরের বড়। সমুদ্র ইকোনমিক্স অনার্স আর পিয়ালী ইংলিশ। এখন দুজনেই প্রতিষ্টিত। সমুদ্র ইকোনোমিক্স এর অধ্যাপক আর পিয়ালী একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা। ওদের সম্পর্কটা ওদের বাড়িতে কেউ আপত্তি করেনি। বরং দু বাড়ির লোক ভীষণ খুশি।
বইমেলায় পৌঁছে অনেকগুলো বই কিনল দুজন মিলে।
হঠাৎ পিয়ালী বলল,
– একটু দাঁড়াও। আমি একটু লিটিল ম্যাগাজিনের ওইদিকটা ঘুরে আসছি।
– হ্যাঁ হ্যাঁ যা না, ওদিকে যা ভিড়, আমি বরং দেখি ভালো কিছু পাই কিনা এই পোর্ট্রেটের স্টলটা থেকে। আমি এখানেই থাকব, অপেক্ষা করব। তোর হয়ে গেলে এখানে আসিস।
লিটিল ম্যাগাজিনের এই জায়গাটায় খুবই ভিড়। বেশ লাগছিল পিয়ালীর । হঠাৎ গিয়ে পিয়ালী থমকে দাঁড়ালো একটি চেনা কণ্ঠস্বরে। ঘুরে তাকাতেই দেখলো অনিন্দ্য। ছ’ বছর পর। চাপ দাড়ির বদলে এখন ক্লিন শেভড। পাঞ্জাবি ছেড়ে ছেলে এখন শার্ট প্যান্ট পরছে।
চোখে চোখ পড়তেই অনিন্দ্য একটু হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
– কেমন আছিস পিয়া?
– তুই ঠিক যেমনটা রেখে গেছিলি তার থেকে অনেক অনেক ভালো।
– ও আচ্ছা। সমুদ্র কেমন আছে? বিয়ের সব কেনাকাটা হয়ে গেছে?
– ও সব খবরই জানিস দেখছি! হ্যাঁ ও ভালো আছে আর সব কেনাকাটা হয়ে গেছে।
– রাইমা কে ফোন করেছিলাম। ওই সব বলল। কাকু কাকিমা কেমন আছে?
– ভালোই।
– সরি পিয়া।
– সরি? কীসের জন্য সরি?
– সেদিন এত ভিড়ের মধ্যে তোকে একা ফেলে চলে যাবার জন্য।
– শোন হাসাস না। জানিস আমি হাসতে শুরু করলে আমার হাসি থামবে না।
ভিড়ের থেকে বেরিয়ে ওরা একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
– বিশ্বাস কর পিয়া তুই তো জানতিস আমি গান নিয়ে কতটা উৎসাহী ছিলাম। আমার মা-বাবাও আমাকে প্রচুর উৎসাহ দিত। আমি মুম্বাইতে একটা মিউজিক ইনস্টিটিউটে একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছিলাম। ওরা বলেছিল মা-বাবার অনুমতি নিয়ে সাত দিনের মধ্যে ওখানে জয়েন করতে। মা-বাবা রাজি হয়ে গেছিল এক কথায়, একটুকু আপত্তি করেনি। কিন্তু তোকে বলার সাহস আমার ছিলনা।
– তাই কাপুরুষের মতো, আমাকে এই ভিড়ের মধ্যে ফেলে চলে গেলি। দারুণ স্ট্র্যাটেজি। তোর কি মনে হয়েছিল আমি তোকে আটকাবো?
– পিয়া, আমি সরি বাবু। আমার সাহস ছিল না তোকে ছেড়ে চলে যাবো এটা বলার। আমি শেষ বারের মতন আমার পিয়া কে কাছ থেকে দেখতে ছেয়েছিলাম। আমার কেরিয়ার তৈরী করার জন্য, গান কে আমার জীবনে অন্য একটা মর্যাদা দেওয়ার জন্য আমি এত বড়ো একটা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি। আজ আমার অনেক নাম, যশ, খ্যাতি। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমিও একজন ব্যর্থ ব্যক্তি। পারলে আমাকে ক্ষমা করিস পিয়া।
– প্রথম আমি এখন আর ‘ তোর পিয়া ‘ নেই। ছ বছরটা একটা মানুষ আর তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি কে পরিবর্তিত করে দেওয়ার জন্য অনেকটা সময়। আর দ্বিতীয়ত ক্ষমা? ছার অনি। আমি অনেকদিন আগেই তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি। যেই ভিড়ের মধ্যে তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলি, ঠিক তখন সমুদ্রদা এসে আমার হাতটা ধরে। আজ আমি ভালো আছি। তাই পুরনো কিছু মনে রাখতে চাই না। তোকেও না।
– অতীত কে ভোলা যায় পিয়া?
– বর্তমানের মধ্যে আমি এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে অতীতকে ভুলতে আমি বাধ্য।
– সমুদ্র তোকে খুব ভালবাসে তাই না?
– আমাকে দেখে তোর কি মনে হয়?
– মনে তো হচ্ছে আমাকে তোর জীবন থেকে একেবারে মুছে দিয়েছে।
– একদম তাই! একদম ঠিক ধরেছিস তুই! আসলে কি বলতো? তোর তো শিল্পীর চোখ তাই এইসব ব্যাপার তুই ভালো বুঝবি। সমুদ্রদা আমাকে সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছে। আমি যেমন ঠিক তেমন ভাবেই আমাকে মেনে নিয়েছে। আমাকে খুব ভালো রেখেছে।
– বাহ তুই ভাল আছিস দেখে খুব ভালো লাগলো।
– আসলে কি জানিস তো অনেক তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও, গান আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যায় নি। আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যায় নি। আমি হয়তো তোর মতন অত ভালো গান গাইতে পারতাম না, কিন্তু গানকে আমি খুব ভালবাসতাম। তাই হয়তো তোর সাথে জড়িয়ে পড়ে ছিলাম। সমুদ্রদা হয়তো তোর মতন খুব বড় গায়ক নয়, কিন্তু মেঘলা দিনে বা বর্ষার সন্ধ্যেতে রবীন্দ্রনাথকে আমার সাথে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি আর সমুদ্রদা একে অন্যের পরিপূরক।
– হবু বরকে দাদা বলিস?
– অভ্যেস হয়ে গেছে। বিয়ের পর ঠিক করে নেব।
– দেখা করাবি না?
– অতীত আর বর্তমান মুখোমুখি হয় না অনি। তুই আমার অতীত আর সমুদ্রদা আমার বর্তমান।
– আচ্ছা বেশ। তোদের পরবর্তী জীবনের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল।
– ধন্যবাদ।
পিয়ালী একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল যে দেরি হচ্ছে। অনিন্দ্য আর ও কে আটকালো না। পিয়ালী চলে গেল। অনিন্দ্য অনুভব করল বুকের বাঁ পাশটা কেমন যেন চিন চিন করছে।
– কী কী বই কেনা হলো?
– ভালো লাগছে না সমুদ্রদা। বাড়ি চলো।
– কেন রে? আইসক্রিম ফুচকা কিছু খাবিনা?
– ইচ্ছে করছে না একদম। বাড়ি চলো।
– আচ্ছা বেশ। চল।
– তোমার হাতে ওটা কী গো? পেলে ভালো ছবি?
– এটা? এটা তোর জন্য।
– কী আছে এতে?
– খুলে দেখ।
পিয়ালী প্যাকেটটা খুলে দেখল তার ভেতরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “গল্প গুচ্ছ”। যার প্রথম পাতায় লেখা,
“যেথা আমি যাই নাকো,
তুমি প্রকাশিত থাকো,
অকূল নয়নে ঢালো গো কিরণধারা।
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।”
পরী
সুরঞ্জন
অনেক ঝগড়ার পর রণজয়ের যখন মিল হয় পরীর সাথে, তখন ওর ছোট্ট মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে সে স্বপ্ন দেখে – ছাদের অচেনা গাছটায় কখন একটা বেগুনি রঙের বাহারি ফুল ফুটেছে, আর তার বুকের মধ্যে রয়েছে একটা ছোট্ট হলদে ছোপ। যেন কোন বাচ্চা খেলতে এসে লুকিয়ে পড়েছে ছাদে। পরী গভীর ঘুমে রণজয়কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বেগুনি রংটা আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।
পাঠকরা কেউ জানেনা, কাল সকালবেলাতেই একজন পার্সেল নিয়ে আসবে। অনলাইনে যে শাড়িটা আসবে তার রংটাও ঐরকম গাঢ় বেগুনি। মাঝে হলদে সুতোর ফুলের কাজ। একদম পরীর নিষ্পাপ ঠোঁট দুটোর মত।
ফেরো-মন
গৌরব রায়
মেয়েটি জ্বরে ভুগলো অনেকদিন।তারপর তার সে আর গন্ধ পায় না।ডাক্তার বললেন anosmia।পুজো আসছে।পুজো আসছে শিউলি সকালে, কাশফুলে।মেয়েটি পুজোর গন্ধ পায় না আর। মেয়েটি ছোটবেলার গ্রামের বাড়িতে যায়।ঠাকুমা আছেন এখনো।গ্রামের কয়েকজন বাচ্চাকে জামাকাপড় দেয়। খাবার কিনে দেয় ওদেরকে।কর্পোরেট,টার্গেট appraisal, অন্যদের ইগো মেসেজ করতে করতে ভুলেই গেছিল নিজেকে।আকাশ দেখেনি কতদিন।ঠান্ডা কিউবিকলের মর্গের মত জীবন।
বাচ্চারা ওকে জড়িয়ে ধরার পরেই মনে হল একটা গন্ধ এসে লাগলো ভালোবাসার।তারপর ঠাকুমার কাছে গিয়ে বসল মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ও আবার চেনা চন্দন কর্পূরের গন্ধ পেল।মায়ার গন্ধ।বিকেলে নদীর ধরে গিয়ে বসল তিরতির করে নদী বইছে দূরে কোথাও ঢাক বাজছে।এবার ও গন্ধ পেল,পুজোর।