তৃতীয় বর্ষ ✦ প্রথম সংখ্যা ✦ ভ্রমণকাহিনী
রাঢ়বাংলা : শক্তিসাধনার কেন্দ্রস্থল
পূষন ভট্টাচার্য
বর্ধমান এবং বীরভূম জেলাতে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ করেকটি একান্ন পীঠের প্রসিদ্ধ সতীপীঠ। সেরকমই তিনটি সতীপীঠ দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম গত রবিবার, 30শে অক্টোবর,2022.
শ্রীরামপুর থেকে স্কুটি নিয়ে যাত্রা শুরু ভোর সোয়া ছটা নাগাদ। আটটা নাগাদ পৌছালাম বর্ধমান। সেখানে আরেক বন্ধুর সাথে জয়েন করে কিছু জলযোগ সেরে যাত্রা শুরু আমাদের। প্ল্যান ছিল ভাগ ভাগ করে দুজনে স্কুটি চালিয়ে সেদিনের ট্যুর করবো। সেই মতোই বর্ধমান থেকে যাত্রা শুরু বেলা 8.45 নাগাদ।



প্রথম গন্তব্য ছিল মঙ্গলকোটের কাছে মা মঙ্গলচন্ডীর মন্দির। পূর্ব বর্ধমান জেলার উজানী, অধুনা কোগ্রামে এটি অবস্থিত। এখানে মায়ের বাম কনুই পতিত হয়েছিল। বেলা দশটা নাগাদ আমরা কোগ্রামে পৌঁছালাম। গ্রামের একদম ভেতরে শান্ত রমণীয় পরিবেশে মন্দিরটি রয়েছে। প্রবেশ করেই মনটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল। মন্দিরের ঠিক পেছনে বয়ে চলেছে অজয় নদ। নদীর ওপারে বীরভূম এপারে বর্ধমান।মন্দিরে মায়ের দর্শন সেরে আমরা কিছুক্ষণ ছায়াতে বসে বিশ্রাম নিলাম। তারপর একটু হেঁটে দেখে এলাম পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি। মাকে প্রণাম জানিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম 10.35 নাগাদ।



আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের অট্টহাস মন্দির। এখানে মায়ের অধর বা নীচের ঠোঁট পতিত হয়েছিল। মঙ্গলকোট থেকে অজয় নদের ওপর লোচনদাস সেতু পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম বীরভূমের নানুরে। তারপর ফুটিসাকোর মোড় থেকে ডানদিক নিয়ে চলতে লাগলাম কেতুগ্রামের উদ্দেশ্যে। পাশ দিয়ে চলতে লাগল কাটোয়া আহমদপুর লাইনের শাখা রেলপথটি। অবশেষে অট্টহাস পৌঁছালাম বেলা 11.55 নাগাদ। এই মন্দিরটির অবস্থানও অতীব সুন্দর। গ্রাম ছাড়িয়ে দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত চারদিকে। আশেপাশে বসতি নেই কোনো। পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে ঈশানী নদী। মন্দিরের ভেতরে অনেকটা জায়গা। রয়েছে একটি গেস্ট হাউস, একটা বড় পুকুর এবং সেই পুকুরের চারদিকে ঘন জঙ্গল। পুকুর পরিক্রমা করার সুযোগ রয়েছে। আছে পঞ্চমুন্ডির আসন। মায়ের দর্শন সেরে ভোগের কুপন সংগ্রহ করলাম 50 টাকার বিনিময়ে। ভোগ খেয়ে আবার আমাদের যাত্রা শুরু বেলা 1.15 নাগাদ।
পরের গন্তব্য কেতুগ্রামেরই আরেক প্রসিদ্ধ সতীপীঠ বহুলক্ষ্মী মায়ের মন্দির, যা লোকমুখে মা বহুলা নামে পরিচিত। এখানে মায়ের বাম বাহু পড়েছিল। অট্টহাস থেকে বহুলা সামান্য দূরত্ব আমরা মূল সড়কে না উঠে গ্রামের মধ্যে দিয়েই চলে এলাম। এই রাস্তাটুকুর সৌন্দর্য ছিল সত্যি চোখ জুড়ানো। গ্রামবাংলার সবুজ ক্ষেত দুদিকে, মাঝে লালমাটির রাস্তা, মাঝেমধ্যে দোয়েল ফিঙের ইতিউতি পলায়ন, আর হেমন্তের মনোরম আবহাওয়ায় কখনো জার্নির ক্লান্তি মাথাতেই আসেনি। বহুলা মায়ের মন্দিরটি কেতুগ্রাম বাসস্ট্যান্ডের একদম কাছে। চারদিকে বসতি থাকলেও মন্দিরটির অবস্থান ভারী মনোরম। মন্দির একদমই ফাঁকা ছিল ওই দুপুরে। কালো কষ্টিপাথরের মায়ের মূর্তি দেখলে বার বার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। দর্শন সেরে আবার যাত্রা শুরু আমাদের পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

এবারে আমাদের দিনের শেষে গন্তব্য মুর্শিদাবাদ জেলার সোনারুন্দি রাজবাড়ী। কেতুগ্রাম থেকে একটু এগিয়ে উদ্ধারণপুর রোড ধরলাম। তারপর বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে এই রাজবাড়ি। সময়ের নিয়মে বেশ কিছু অংশ ভগ্নপ্রায় হলেও রাজবাড়ীর ভেতরের স্থাপত্য অনবদ্য। এককালে বনোয়ারী রাজারা যে খুবই সমৃদ্ধ ছিলেন তা সহজেই বোঝা যায়। রাজবাড়ীর একাংশে এখন একটি অনাথ আশ্রম চলে। আর বাইরে রয়েছে একটি পুকুর, তাতে প্রচুর ১০-১২ কিলো ওজনের রুই কাতলা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ের কাছে। বিস্কুট ছুঁড়ে দিলে একলপতে ঢুকিয়ে নিচ্ছে মুখের ভেতরে। তাজ্জব ব্যাপার। বাংলার বাইরে অনেক জায়গাতে যেমন বোধগয়াতে মহাবোধী মন্দিরের পুকুরে এরকম দেখেছিলাম। কিন্তু বাঙলার মতো মৎস্যভূক দেশে প্রমান সাইজের মাছের এরকম অবাধ বিচরণ সত্যিই দেখিনি আগে। যাইহোক এবারে আমাদের ফেরার পালা আসন্ন।
সোনারুন্দি থেকে স্টার্ট করে আমরা চলতে শুরু করলাম কাটোয়ার উদ্দেশ্যে। এই রাস্তাটিও ভারী মনোরম । আবার অজয় নদের উপর কাশীরাম দাস সেতু পেরিয়ে কাটোয়া পৌঁছালাম প্রায় বিকাল সাড়ে তিনটে নাগাদ। বন্ধুকে আবার বর্ধমান ফিরতে হবে। সুতরাং ও কাটোয়া থেকে বর্ধমান লোকাল ধরে চলে যাবে। একে অপরকে বিদায় জানিয়ে এবার ফেরা শুরু বাড়ির উদ্দেশে।
আসাম রোড ধরে গাড়ি চালিয়ে সন্ধ্যা 7.45 বাড়ি পৌঁছালাম শ্রীরামপুরে। এই পুরো রুটে আমাদের চলতে হয়েছে 331 কিলোমিটার। রাস্তায় পড়েছে মোট 5টি ডিস্ট্রিক্ট (হুগলী- পূর্ব বর্ধমান- বীরভূম-নদীয়া- মুর্শিদাবাদ)। সারাদিনের শেষে ঘরে ফিরেছি একরাশ মনভরা আনন্দ নিয়ে আর আবারো এরকম বেরিয়ে পড়ার সংকল্প করে।